অলোক আচার্য

  ২২ আগস্ট, ২০১৯

মুক্তমত

উল্টোপথেই চলছে সভ্যতা

মানুষ সৃষ্টির শুরু থেকেই সভ্যতার যাত্রা সামনের দিকে ধাবমান। সময়ের চাকায় পেছনে যাওয়ার সুযোগ নেই। তাই সামনের দিকে অন্তহীন যাত্রায় এগিয়ে চলেছে এ মানবসভ্যতা। আমাদের কর্মে ও মননে প্রতি পদক্ষেপে মানুষ নিজের শ্রেষ্ঠত্বের স্বাক্ষর রেখে চলেছে। সৃষ্টির অন্য প্রাণী থেকে মানুষ শ্রেষ্ঠÑ এটা তার কর্ম দিয়েই প্রমাণ করেছে। সভ্যতা বিকাশের পথে মানুষের ভেতর হিংসা, ক্রোধ, লোভ-লালসাও বিকশিত হতে লাগল। নিজেদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব চরমে উঠল। বহু সভ্যতা মানুষের দুষ্কর্মে ধ্বংস হয়েছে। গড়ে উঠেছে নতুন কোনো সভ্যতা। চাপা পড়েছে সেসব উন্নত সভ্যতার সব নিদর্শন। এভাবে মানবসভ্যতা বিকশিত হতে হতে আজকের এই আধুনিক বা অতি আধুনিক সভ্যতায় এসে উপনীত হয়েছে। এই সমাজকে সভ্য সমাজ বলা হয়। কিন্তু

প্রশ্ন হলোÑ এই সভ্য সমাজ প্রকৃতপক্ষে কতটা সভ্য হতে পেরেছে। আদিম যুগে পশুদের সঙ্গে বসবাস করতে করতে সভ্য হতে বহু বছর সময় নিয়েছে। আজ পশুরা বনে আর মানুষ শহরে। তবে মানুষ কিন্তু পশুত্বকে দমন করতে পারেনি। মনের ভেতর পশুটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।

যে সমাজে প্রতিনিয়ত ধর্ষিত হয় শিশু থেকে বৃদ্ধা, যে সমাজে মেয়েদের নিরাপত্তা বলে কোনো জায়গা অবশিষ্ট নেই, মেয়েদের জন্য কোনো ব্যক্তিই নিরাপদ নয়, যে সমাজে সবাই সবাইকে ঠকানোর জন্য ব্যস্ত, দুহাত পেতে বাইরে ভিক্ষুকের ছদ্মবেশে কর্মক্ষম মানুষ হাত পেতে ভিক্ষা করতে সম্মানবোধ করে আর ভেতরে সুট্যেড-বুট্যেড মানুষরা ঘুষ নামক ভিক্ষা নিয়ে জীবনধারণ করে, মানুষ মানুষকে মারার জন্য নিত্যনতুন অস্ত্র তৈরি করে, ধর্মে-ধর্মে, বর্ণে-বর্ণে প্রতিনিয়ত রেষারেষি, শিক্ষার নাম করে বাণিজ্যের দুয়ার খুলে বসে থাকে, আতঙ্ক আর অস্থিরতায় সময় পার করতে হয় সে সমাজকে কেবল বড় বড় দালানকোঠা, ব্যবসা বাণিজ্য প্রবৃদ্ধির মানদন্ডে আধুনিক সভ্য সমাজ বলা যায় কি না, তা ভেবে দেখতে হবে। সমাজের উৎকর্ষ সাধন কেবল পোশাকে-আশাকে হয়েছে, মননে-মানবিকতায় হয়নি। সভ্যতা এগিয়েছে, কিন্তু মানসিকতা পিছিয়েছে। সভ্যতার শুরুতে মানুষের পোশাক ছিল না। লজ্জা নিবারণের জন্য গাছের বাকল ব্যবহার করত। এখন বাহ্যিক লজ্জা নিবারণের জন্য স্যুট-ব্যুট আবিষ্কার হয়েছে। কিন্তু চক্ষুলজ্জা প্রায় নেই বললেই চলে। এখন ইচ্ছা করলেই মিথ্যা বলা যায়, কারো সঙ্গে প্রতারণা করা যায়, কাউকে মঞ্চে দাঁড়িয়ে মিথ্যা আশ^াসের বাণী শোনানো যায়। এ লজ্জা ঢাকার কোনো পোশাক নেই। এ দেশে একটা বালিশ কিনতে হাজার হাজার টাকা খরচ দেখানো হয়, কেরানীর চাকরি করে বড় বড় বাড়ি-গাড়ির মালিক হওয়া যায়। অন্য চিত্রও আছে। সারা দিন হাড়ভাঙা খাটুনি শেষে পান্তা ভাত দিয়ে

রাতের খাওয়া শেষ করা মানুষগুলোও এ সভ্যতারই মানুষ। ভদ্র পোশাক পরা মানুষগুলো যারা সভ্যতার দোহাই দিয়ে অবলীলায় অসভ্য কার্যক্রম করে যাচ্ছে তাদের ভেতর থেকে আজও সেই আদিমতা ধুয়ে মুছে যায়নি। মনুষ্যত্বের কোনো বিচারেই এদের মানুষ বলা ঠিক হবে না।

এই সমাজকে সে দৃষ্টিকোণ থেকে সভ্য বলতে দ্বিধা হয়। সভ্য হলে সামিয়ার মতো নিষ্পাপ শিশুরা কেন ধর্ষণের শিকার হবে? কেনইবা শ্রদ্ধার শিখরে থাকা শিক্ষক সিরিয়াল ধর্ষক হবে? তাই আজ ভাবতে বাধ্য করছে এটা সভ্যতার উত্তরণ আর অবনমন। পোশাক সর্বস্ব সমাজে এসব কুৎসিত মনের মানুষগুলো ভালো মানুষের আশপাশেই ঘুরে বেড়ায়। তাদের আলাদা করে চেনার কোনো উপায় নেই। এসব ঘটনা এক দিনের নয় বা কোনো একটি ঘটনাতেই এসব শেষ হয়ে যাচ্ছে না। একের পর এক ঘটনা আমাদের সামাজিক মূল্যবোধকে দুর্বল করে ফেলেছে। বারবার সভ্যতার দোহাই দিয়ে নিজেদের জাত উঁচু করার চেষ্টা করছি। তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে সব অস্বীকার করার চেষ্টা করছি। অথচ আজকের এই সভ্যতার পেছনে কত যুদ্ধ-বিগ্রহ জড়িয়ে রয়েছে। কত মানুষের রক্ত লেগে রয়েছে তার হিসাব নেই।

বিবেকবোধ, জ্ঞান, সংযম, প্রেম সব কিছু বর্জন করে আঁকড়ে ধরে আছি মিথ্যে অহমিকাকে। যান্ত্রিক সভ্যতার উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে মানবিক সভ্যতা বিলীন হতে শুরু করেছে। দিন যত এগিয়ে যাচ্ছে এই মানবতার সংকট তত ঘনীভূত হচ্ছে। নিত্যনতুন ডিজাইনের পোশাক গায়ে দিয়ে রাস্তায় বের হচ্ছি, কিন্তু প্রকৃত লজ্জার মাথা খেয়ে বসে আছি। আজ ঘুষখোর, চাঁদাবাজ, লম্পট বললেও কেউ তেমন একটা রাগ করে না। ঘুষ খাওয়ার মধ্যেই যেন আনন্দ নিহিত! যেখানে মন নেই, রুচি নেই, মনুষ্যত্ব নেই, বিবেক নেই, ঘৃণা নেই, মানবিকতা নেই; সেখানে কোন সভ্যতার উত্তরণ ঘটছে জানি না। প্রতিদিন পত্রিকার পাতায়, টেলিভিশনের খবরে সমাজের অস্থির চিত্র দেখি। দেখতে দেখতে চোখ সয়ে গেছে। মনের বোধের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। কোনো অনুভূতি হয় না। মনটা অজানা আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। কিছুই করার থাকে না। সভ্যতার বিকাশ সাধন হয়েছে ঠিকই; কিন্তু সেই যাত্রা তো ফের উল্টোদিকে টানছে না আমাদের। পশুর সঙ্গে বসবাস করতে করতে পশুর আচরণ বেশ রপ্ত করতে পেরেছে মানুষ জাতি। পশুর মতোই হিংস্রতা, পশুর মতোই লোভ, আপন-পর, ছোট-বড় বোধশূন্য। সময়ের উল্টোযাত্রায় আজ আমরা সবাই শামিল হয়েছি। অল্প কজন ভালো মানুষ এ সমাজে আজ বড় বেকায়দায়। তারা এই আড়ম্বরপূর্ণ সমাজ নিয়ে কিছুটা বিরক্ত। বিপরীতে যারা অন্যের কাঁধে ভর করে নানা অপকৌশলের আশ্রয় নিয়ে পকেট মোটা করে বসে আছে, তারাই সমাজের হর্তাকর্তা। তাদের মুখের কথাই আইন। তাদের কথায় সবাই ওঠবস করে। তাদের দেখলে রাস্তাঘাটে সালামের হিড়িক লেগে যায়। কেউ ভয়ে আবার কেউ তোষামোদ করে চলছে প্রতিনিয়ত। তেল দেওয়াই যে এ সমাজের ওপরে ওঠার সবচেয়ে কার্যকর ওষুধ। যে যত দক্ষ হাতে তেল দিতে পারবে; সে তত ওপরে উঠতে পারবে। তারপর এক দিন তাকেও তেল দেওয়া শুরু হবে। এই তেলে কোনো ভেজাল নেই। এরা কিছু না বুঝলেও সব বোঝেন, কিছু না করলেও ফরমাশ দিতে ওস্তাদ, তারাই সমাজের দন্ডমুন্ডের কর্তা। এসব কর্তার চোটপাটে বাকিরা ভর্তা হওয়ার জোগাড়, সেদিকে কারো লক্ষ নেই! এরাই আজ সভ্যতার অগ্রগতি মাপার বড় মাপকাঠি।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close