মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী

  ০৩ আগস্ট, ২০১৯

মমতা

ডেঙ্গু প্রতিরোধে ব্যবস্থা জরুরি

এ মুহূর্তে ডেঙ্গুর প্রকোপ বলতে গেলে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। বিশেষত ঢাকা শহরে এবার ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব এতটা ঘটবে, তা কোনো মহলই আগে অনুমান করতে পারেনি। যতটা করেছিল তার চেয়ে এই রোগের জটিলতা সম্পর্কে অনেকেরই ধারণার থেকেও নতুন নতুন উপসর্গ দেখা দেওয়ায় স্বয়ং ডাক্তাররাও অনেক কিছু বুঝে উঠতে পারছেন না। তার পরও ঢাকার চিকিৎসকরা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন ডেঙ্গু রোগীদের সারিয়ে তোলার চিকিৎসা দিতে। তাদেরও ডেঙ্গুর চিকিৎসা সম্পর্কে আগের ধারণা অনেকটাই এখন বদলাতে হচ্ছে। কারণ ডেঙ্গুর এডিস মশা এত সব জটিল বংশবৃদ্ধি নিয়ে আবির্ভূত হবে, সেটি কারো কারো জানা থাকলেও সব চিকিৎসকের তা ছিল না। তার পরও আমাদের চিকিৎসকরা দ্রুতই তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে চিকিৎসার প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতে তৎপর রয়েছেন।

এ মুহূর্তে ঢাকার সরকারি হাসপাতালগুলো ডেঙ্গুসহ নানা ধরনের জ্বরে আক্রান্ত রোগীদের আগমনে একেবারেই কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে আছে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোও চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে ঢাকায় এখন ডেঙ্গুর প্রকোপ এতটাই০০................................. বেশি যে, সাধারণ মানুষ অনেকটা এডিস মশার আতঙ্কেই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছে। সেটি হওয়ার কথাই। কারণ কোনো মানুষই ভাবতে পারেনি মশা থেকে এত সব জটিল রোগে মানুষ খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারে। ঢাকার বাইরেও এখন বেশ কিছু শহরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা চলছে। তবে তাদের বেশির ভাগই ঢাকা থেকে আক্রান্ত হয়েছেন বলে স্থানীয় ডাক্তাররা জানিয়েছেন।

আসলে কিছুদিন আগেও মানুষ মনে করত যে, ময়লা, নর্দমাসহ পচা জায়গাতেই যেসব মশা ভনভন করে; সেগুলোই মানুষকে কামড়ালে মানুষ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এখন ডাক্তাররা মিডিয়ার মাধ্যমে যে ধারণাটি দিচ্ছেন, সেটি একেবারেই ভিন্ন কথা। মোটেও কোনো পচা, নর্দমার মশার উৎপত্তিস্থল ডেঙ্গুর জন্মদাতা এডিস নয়। এডিস অত্যন্ত অভিজাত শ্রেণির মশা। এরা স্বচ্ছ পানিতে ডিম পাড়ে, মানুষের বাসাবাড়িতে এদের বসবাস বেশি। দিনের বেলায় এরা মানুষকে কামড় দেয়। তাই সবাইকে দিনের বেলাতেও মশারি টাঙিয়ে ঘুমাতে হয়, শরীরে কাপড়চোপড় বেশি রাখতে হয়। বড় বড় নির্মাণাধীন দালানকোঠায় এরা স্বচ্ছ পানিতে ডিম ছাড়ে সেখান থেকেই এদের বংশবিস্তার দ্রুতগতিতে বেড়ে যায়। আবার এসব এডিস মশা মানুষের শরীরে কামড় দিয়ে যে রক্ত চুষে নেয়, তা থেকেই তারা আরো বেশি ভয়ানকভাবে বংশবৃদ্ধি ঘটায়। এসব তথ্য গত কয়েক দিন আমরা কয়েকজন স্বনামধন্য ডাক্তার এবং কীটতত্ত্ববিদের কাছ থেকেই শুনেছি। আগে আমরা এসব তথ্য খুব একটা শুনিনি। এখন এডিশ মশার ভয়াবহতা কী হতে পারে; সেটি সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচার হওয়ার কারণে আমরা জানতে পারছি। আমরা এ কথাও জানতে পারছি যে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিভিন্ন গবেষণা থেকে যেসব তথ্য-উপাত্ত ও ধারণা লাভ করেছে, তা থেকে সংস্থাটি দাবি করছে যে, বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এডিস মশার প্রকোপ এখন এশিয়াসহ আরো কয়েকটি অঞ্চলে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এটি আরো জটিল রোগ ধারণ করতে পারে বলে সংস্থাটি আভাস দিয়েছে। এ মুহূর্তে প্রায় ২৫০ কোটি মানুষ ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আছে। তা হলে বোঝাই যাচ্ছে ডেঙ্গু রোগের বিষয়টিকে হালকা বা সাধারণভাবে নেওয়ার কোনো বাস্তবতাই এখন আর নেই। এটিকে নিয়ে আমাদের দেশেও ব্যাপক গবেষণা করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে কীটতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ এবং চিকিৎসাবিদ্যায় যারা গবেষণা করছেন তাদের নিজ নিজ অথবা যৌথভাবে ডেঙ্গু এবং এডিস মশা নিয়ে ব্যাপক গবেষণায় হাত দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। রাষ্ট্র ও সরকার এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করবে বলেই আমরা আশা করি। কেননা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভবিষ্যদ্বাণী যদি বাস্তব হতে থাকে, তা হলে ডেঙ্গুর নানা ধরনের প্রকরণ শিগগিরই দেখা দিতে পারে। সেটি ঘটলে অসংখ্য মানুষ মৃত্যুঝুঁকিতে পড়বেই, এতে কোনো সন্দেহ করার কিছু নেই। ডেঙ্গু জরাক্রান্ত রোগীরা সাময়িকভাবে সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরে যেতে পারেন, কিন্তু শরীরের ভেতরে নানা ধরনের সংক্রামক ব্যাধি রোগীকে ভয়ানকভাবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারে। সুতরাং ডেঙ্গুর এসব বিশেষত্ব নিয়ে এখনই যদি আমরা ব্যাপক গবেষণায় মনোনিবেশ না করি, এডিস মশার নিধনে কার্যকর ও ওষুধ আবিষ্কার এবং ব্যবহারের পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে না পারি; তা হলে আমাদের মৃত্যুঝুঁকি কতটা বেড়ে যাচ্ছে, সেটি সহজে অনুমেয়।

আমাদের পরিবেশ রক্ষার বিষয়টি নিয়ে আমরা যত কথাই বলি না কেন, পরিবেশ নষ্ট ও ধ্বংস করার জন্য আমাদের শিল্পপতি থেকে নিচের সব আতিপাতি কম দায়ী নয়। তারা খুব বেশি রাষ্ট্রের প্রচার-প্রচারণায় সচেতন হবেন বলে মনে হয় না। সুতরাং পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে আমরা কতটা নিজেদের রক্ষা করার জন্য সচেতন হব; সেটি নিয়ে মস্তবড় প্রশ্ন রয়ে গেছে। ঢাকা শহরে ডেঙ্গু জ্বরের শুরু থেকে ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলোতে বেশ কিছু টকশোর অনুষ্ঠান হতে দেখছি। যত দিন যাচ্ছে তত বেশির ভাগ টিভি চ্যানেলই ডেঙ্গু নিয়ে নির্ধারিত সংবাদে গুরুত্ব দিয়ে খবর প্রচার করছে, আবার টকশোগুলোতেও এ নিয়ে মন্ত্রী, মেয়র, সরকারি আমলা, ডাক্তার, কীটতত্ত্ববিদ এবং সাংবাদিকরা নানাভাবে আলোচনা করছেন। বিশেষজ্ঞদের আলোচনাগুলো অনেক বেশি সহায়ক হয়। তাদের আলোচনা থেকেই আমরা এডিস মশার বিশেষত্ব সম্পর্কে অনেক বেশি তথ্য পাচ্ছি। দুয়েকজন কীটতত্ত্ববিদও এসব আলোচনাকে অর্থবহ করে তুলেছেন। প্রয়োজন এ ধরনের জ্ঞানভিত্তিক আলোচনা ব্যাপকভাবে করা। তবে মাঝেমধ্যে দেখা যায়, সংবাদগুলোতে বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে সরেজমিন প্রতিবেদন প্রদানের মাধ্যমে যেভাবে বক্তব্য দেওয়া হয়, তাতে অনেক সময় মানুষের মধ্যে আতঙ্কের বিষয়টি আরো যেন বেড়েই চলে। একইভাবে কর্তৃপক্ষের অজ্ঞানতা ও সীমাবদ্ধতাকে অবচেতনে হলেও প্রচারে আনার ফলে একশ্রেণির দর্শক-শ্রোতা ডেঙ্গু রোগের সর্বশেষ ব্যাপকতা উপলব্ধি না করতে পেরে কারো কারো অবহেলাকেই দায়ী করতে দেখা যায়। আবার অনেক টকশোতেও কিছু কিছু আলোচক নানা ধরনের প্রশ্ন তুলে মেয়রদের অদক্ষতা, অযোগ্যতা, ব্যর্থতা ইত্যাদি শব্দ উচ্চারণের মাধ্যমে যে আবহটি তৈরি করেন; তাতে ডেঙ্গু জ্বরের সর্বশেষ প্রকরণ সম্পর্কীয় ধারণাটি গুলিয়ে ফেলা হয়। আমরা লেখার শুরুতেই যে বিষয়টি বোঝাতে চেষ্টা করেছি, তা হচ্ছে এডিস মশার সর্বশেষ বৈশিষ্ট্যসমূহ নিয়ে কারোরই তেমন বিশেষ সুনির্দিষ্ট ধারণা ৬-৭ মাস আগে স্পষ্ট ছিল না। মেয়ররা হয়তো এটি নিয়ে সাধারণ মশার ওষুধ ছিটানোর প্রকল্পের মধ্যেই আবদ্ধ ছিলেন। এই সীমাবদ্ধতা তাদের থাকতেই পারে। কারণ মেয়ররা কীটতত্ত্ববিদও নন, ডাক্তার তো ননই। অথবা সিটি করপোরেশনে যেসব ডাক্তার রয়েছেন তারাও এসব বিষয়ে কতটা সর্বশেষ জ্ঞান রাখেন; সেটি একটি প্রশ্ন। এখন মেয়রদের নানাভাবেই সমালোচনা ও ব্যর্থ বলে দাবি করতে পারি। কিন্তু তাতে কি সমস্যা সমাধান হবে? তবে মিডিয়ায় যেকোনো মানুষের বক্তব্যদানের ক্ষেত্রে বেশ সতর্ক থাকা ভালো। সেটি মন্ত্রী বা মেয়র কিংবা সাংবাদিক অথবা যেকোনো সাধারণ মন্তব্যদাতাও হতে পারেন।

আমাদের বিভিন্ন অবস্থান থেকে আমরা সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন এবং ঢাকা শহরের স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের যথাসম্ভব নতুন জটিলতায় ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধে এবং এডিস নিধনে তাদের করণীয় এবং জনগণের বাড়িঘর পরিষ্কার রাখার নিয়মাবলি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা প্রয়োজন। আমরা এখন কাউকে অভিযুক্ত করে ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ থামাতে পারব না। এই মৌসুমে এডিস মশার নিধন, বংশবিস্তার রোধ ইত্যাদি কাজে মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন আরো কীভাবে উদ্যোগ নিলে মানুষ ভয়াবহ এই অসুখ থেকে মুক্তি পাবে, একই সঙ্গে এডিস মশা এবং ডেঙ্গু জ্বর যেন ঢাকার বাইরে খুব বেশি বিস্তার লাভ করতে না পারে; সে ব্যাপারে প্রতিটি শহর, সিটি করপোরেশন, পৌর করপোরেশন, সরকারের স্বাস্থ্য অধিদফতর এখনই যেন সেখানে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে থাকে। মনে রাখতে হবে, আর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই কোরবানির ঈদ উপলক্ষে অনেক মানুষই হয়তো ঢাকা থেকে মফস্বল শহরে যেতে পারেন। সেই শহরগুলোর জন্য ডেঙ্গু জ্বর ঝুঁকিপূর্ণ, গ্রামগুলো নয়। সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, এই বর্ষা শেষে আগামী বছর আমাদের প্রস্তুতিটা কীভাবে নিলে শুধু এডিস মশাই নয়, চিকুনগুনিয়া বা অন্য ভাইরাসগুলোর প্রাদুর্ভাব থেকেও আমরা মুক্ত হতে পারব; সে ব্যাপারে এখনই কার্যকর প্রস্তুতি নেওয়া দরকার। এর জন্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, সুপারিশ নেওয়া এবং নির্বাহী সব প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ বাস্তবায়নে কার্যকর ভূমিকা নেওয়া প্রয়োজন। তা হলেই আমরা এমন একটি সমস্যা ও সংকট থেকে বের হয়ে আসার পথ খুঁজে পাব।

লেখক : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close