মাহমুদুল হক আনসারী

  ২৬ মে, ২০১৯

মুক্তমত

ঈদ আনন্দের সেকাল একাল

ঈদ মানে খুশি, সব জাতি ধর্ম গোত্র সবার একটি বিশেষ দিনকে খুশি বা ঈদ হিসেবে ব্যবহার করে। পৃথিবীর সবগুলো গোত্র ও ধর্মানুসারীদের আনন্দ বা ঈদ আছে। ইসলাম ধর্মে মুসলমানদের খুশির বড় ঈদ দুটি। একটি রমজান মাসের রোজা পালনের পর যে খুশি উদযাপন করা হয় সেটি হচ্ছে ঈদুল ফিতর। এ ঈদ মুসলিম বিশ্বে সবচেয়ে বড় ঈদ বা খুশি। আরেকটি হচ্ছে হজের সময় পশু কোরবানির ঈদ। এ দুটি ঈদ ছাড়াও ছোট বড় আরো কিছু মুসলমানদের খুশির দিন থাকলেও এগুলো ঈদের পর্যায়ে পড়ে না। সবচেয়ে বড় খুশির নাম ঈদুল ফিতর। এ ঈদকে ঘিরে আনন্দ আর উল্লাসের জন্য মুসলিম বিশ্ব বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। ঘরে ঘরে, পাড়া, মহল্লা ও সমাজে ব্যাপক প্রস্তুতি থাকে।

রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রশাসন জনগণের ধর্মীয় আবেগ ও উল্লাসকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করে। বাংলাদেশ মুসলিম প্রধান দেশ হলেও এখানে সবধরনের মানুষের সমান সুযোগ-সুবিধা ও সাহায্য সহযোগিতা দেওয়া হয়। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ ধর্ম নিরপেক্ষ। সব ধর্ম গোত্র মানুষের সমান সুযোগ প্রদানে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। সব ধর্মের সব অনুষ্ঠান রাষ্ট্রীয়ভাবে সর্বাত্মক সহযোগিতা পেয়ে থাকে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে মনিটরিং রাখা হয়। বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যার দেশ হিসেবে বিশ্বে পরিচয় হলেও এদেশ উদারপন্থি একটি মুসলিম দেশ। এখানে সুন্নি, খারেজি, রাফেজি যত ধরনের গ্রুপ থাকুক না কেন সবাই তাদের নিজস্ব চিন্তা-চেতনা ও স্বাধীনভাবে ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালন করে থাকেন। রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো গোষ্ঠীকে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ধর্মীয় অনুষ্ঠান উদযাপনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয় না। বাংলাদেশের মানুষ সে যে ধর্মেরই অনুসারী হোক না কেন, সবাই খুশিতে আনন্দে নির্দি¦ধায় নিজ নিজ ধর্ম পালন করে আসছে। এ দেশে কেউ কারো ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ বা বিরোধিতা প্রতিবন্ধকতা করার মতো ধৃষ্টতা দেখাতে সাহস পায় না। এ দেশ লালনের দেশ। এ দেশ হাছনের দেশ। এ দেশ বারো আউলিয়ার দেশ। আর সে কারণেই সব ধর্ম ও গোত্রের মানুষের সমান সুযোগ কেবল এ মাটিতেই পাওয়া যায় এবং সম্ভব।

পৃথিবীর খুব কম দেশেই মুসলমানদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান উদযাপনের সুযোগ সীমিতভাবেই দেখা যায়। অনেক দেশে মুসলমানরা সংখ্যালঘু হিসেবে তাদের ধর্ম আচার অনুষ্ঠান পালনে চরমভাবে বাধাপ্রাপ্ত হন। বাংলাদেশ সেসব দেশের তুলনায় মুসলিম প্রধান দেশ হলেও এখানে মুসলমানরা অত্যন্ত উদার ও শান্তিপ্রিয়। তারা অন্যান্য ধর্ম গোত্রের প্রতি সর্বদা সুদৃষ্টি নিরাপত্তা ও ভালোবাসা দিয়ে থাকে। রাষ্ট্র হিসেবে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক হলেও অপরাপর ধর্মপালনকারী গোষ্ঠী শতভাগ নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণভাবে এদেশে বাস করছেন। কথা ছিল ঈদ বা খুশি উদযাপন নিয়ে। এদেশে যে কোনো ধর্মের ঈদ বা খুশির দিনে রাষ্ট্রীয়ভাবে সবাই একে অপরের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ রেখে চলতো। দেশ স্বাধীনের পর আমরা এদেশের সবগুলো ঈদ, খুশি এভাবে দেখে আসছি। ঈদ সেটা যে ধর্মেরই হোক না কেন জাতি হিসেবে বাঙালি জাতি সম্মিলিতভাবে সবগুলো অনুষ্ঠানে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রদর্শন করতে দেখি। হিংসা বিদ্বেষ কোনো প্রকারের বাধা প্রতিবাধা তখন ছিল না। কেউ কাউকে ধর্ম কর্মে বাধা সৃষ্টি করেনি। একে অন্যের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সার্বিক সহযোগিতা করতে এগিয়ে যেত। সাদামাটা অনুষ্ঠান তখন সম্মিলিতভাবে হতো। মুসলমানদের ধর্মীয় খুশির সময়ে অন্য ধর্মের অনুসারীদের আসা যাওয়া দেখা যেত। অন্য ধর্মের অনুষ্ঠান ও খুশিতে মুসলিমরাও অংশগ্রহণ করতো। খানা আপ্যায়নে একে অপরের অতিথি হতো। সাহায্যের হাত বাড়াতো একে অন্যকে। ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের পরিবেশ ও চরিত্র সবার মধ্যে তখন দেখা যেত। আজকালের মতো তখন এত অধিক ধনী ও অর্থবিত্তশালী মানুষ ছিলেন না। খেটে খাওয়া শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে এক ধরনের গভীর মায়া মমতা আর ভালোবাসা দেখা যেত। একে অপরের সুখে দুখে ধর্মের পর্দা ছেদ করে এগিয়ে যেত। মানুষ হিসেবে মানুষের প্রতি ছিল গভীর ভালোবাসা। খুশির সময় সবাই আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতো।

সেদিনের কথা মনে পড়লে আজকের দিনের ঈদ খুশি মøান হয়ে যায়। এখন ঈদ খুশিতে সে আনন্দ পাওয়া যায় না। মুসলমানদের ঈদ খুশি হয়ে গেছে আত্মকেন্দ্রিক। কথা ছিল এক মুসলমান অপর ভাইকে খুশি উদযাপন সাহায্য করবে। কিন্তু সে প্রথা মুসলিম সমাজে চালু করা যায়নি। এখনো যাদের আছে অট্টালিকা অর্থ সম্পদ, তারা আত্মকেন্দ্রিকভাবে ভোগবিলাসে মত্ত। তাদের সম্পদে দুর্বল দুস্থ মুসলমানদের অধিকার থাকলেও সে অধিকার থেকে বঞ্চিত। মুসলমানদের সম্পদে অন্য মুসলমান ভাইদের অধিকার দেওয়ার কথা থাকলেও তার বাস্তবায়ন নেই। এখনো দুস্থ, দরিদ্র অসংখ্য মানুষ মুসলিম পরিচয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মানবেতর জীবনযাপন করছে। ধনী দেশের স্বাবলম্বী মানুষগুলো তাদের পাশে সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। ইসলামী বিধান মতে, যে পরিমাণ সাহায্য ও আন্তরিকতা নিয়ে দুস্থদের পাশে দাঁড়াবার কথা মুসলিম দুনিয়া অনুসরণ করছে না। সত্যিকার অর্থে সামর্থ্যবান ব্যক্তি পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্র, দরিদ্র ও অভাবী মানুষের দিকে সাহায্যের হাত প্রসারিত করতো তাহলে মুসলিম বিশ্বে আর কোনো দুস্থ মানুষ খুঁজে পাওয়া যেত না। পার্শ্ববর্তী দেশ বার্মার রোহিঙ্গা মুসলিম জনগণ তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।

বর্তমানে নির্যাতিত বিতাড়িত মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম নরনারীর প্রায় ১২ লাখের অধিক মানুষ বাংলাদেশে আশ্রিত। সবাই মুসলমান। নিজ দেশে নির্যাতনের আঘাত সহ্য করতে না পেরে তারা পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এসব মানুষের পাশে মুসলিম দুনিয়ার যেভাবে এগিয়ে আসার কথা ছিল কেউ তা করেনি। একইভাবে পৃথিবীর নানা দেশে অসংখ্য নির্যাতিত মুসলিম উদ্বাস্তু হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে তাদের পাশে দাঁড়ানোর কথা ইসলাম ধর্মে বারবার উচ্চারিত হয়েছে। কিন্তু সে বাণী আজ নীরব নিভৃতে আহাজারী করছে। তাই ঈদ আনন্দ সেকাল আর একালের মাঝে অনেক তফাৎ। তখন মানুষে মানুষে এত ভেদাভেদ হিংসা আর বিদ্বেষ ছিল না। এখন আছে। মানুষ সে যে ধর্মেরই হোক না কেন আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। কেউ আনন্দে অথবা বিপদে এগিয়ে আসছে না। সমাজ পৃথিবী চোখ কান থাকার পরও কেন জানি প্রতিবন্ধী হয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞান ও আধুনিকতায় পৃথিবী প্রতিটি মুহূর্তে এগিয়ে গেলেও মানবতা সেভাবে এগোচ্ছে না। এখন আর সেদিনের ভালোবাসা মানুষে মানুষে হৃদ্যতা, সৌহার্দ দেখা যায় না। ফিরে আসুক সেদিনের মতো অনেকটা অহংকার মুক্ত ঈদ। সব মানুষের কাছে হয়ে উঠুক সর্বজনীন।

লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close