নিতাই চন্দ্র রায়

  ০৯ মে, ২০১৯

পর্যালোচনা

চাল রফতানির দাবি কতটুকু যৌক্তিক

কৃষকের উৎপাদিত চালের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে বিদেশে সরু ও লম্বা চাল রফতানি করতে চায় বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতি। বাংলাদেশ হতে এক-দুই লাখ টন চাল রফতানির জন্য অনুমতি চেয়ে বাণিজ্যমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখেছেন তারা। মিল মালিকদের দাবি, দেশে দেড় কোটি টন চাল উদ্বৃত্ত আছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মতে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশে ১ কোটি ১৬ লাখ ১ হাজার ৩৯০ হেক্টর জমি থেকে মোট ৩ কোটি ৬২ লাখ ৭ হাজার ৯৩০ টন চাল উৎপাদিত হয়। এর আগের বছর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১ কোটি ১০ লাখ ৭ হাজার ২৩০ হেক্টর জমি থেকে ৩ কোটি ৪২ লাখ ১৪০ টন চাল উৎপাদিত হয়।

চাল রফতানির ব্যাপারে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্শির কথাÑ দেশে যদি উদ্বৃত্ত চাল থাকে তা হলে রফতানি হতেই পারে। তবে এ বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয় ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মতামত নিতে হবে। দেশে রফতানিযোগ্য চালের পরিমাণ সঠিকভাবে খতিয়ে দেখেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ চালের দামের উত্থান-পতনের সঙ্গে দেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয় ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। বছরে ৩ কোটি ৬২ লাখ টন উৎপাদিত চাল থেকে ১ থেকে ২ লাখ টন সরু ও চিকন চাল রফতানি করলে কৃষক কতটুকু ন্যায্যমূল্য পাবেন? বাজারেইবা তার কতটুকু প্রভাব পড়বে, তা এ মুহূর্তে বলা মুশকিল।

২০১০ সালে সর্বশেষ বাংলাদেশ এক লাখ টন চাল রফতানির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। কিন্তু ৫০ হাজার টন রফতানির পর বাংলাদেশ আর চাল রফতানি করেনি। ২০১৭ সালে হাওর অঞ্চলে অকাল বন্যা ও দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অতিবৃষ্টি ও ব্লাস্ট রোগের কারণে ১০ লাখ টন চাল কম উৎপাদিত হয়। ওই সময়ে শুল্ক হ্রাসের সুযোগ গ্রহণ করে চাহিদার প্রায় চার গুণ অর্থাৎ ৩৭ লাখ টন চাল বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। তখন থেকেই ধানের দাম কমতে শুরু হয়। কপাল পুড়ে দুর্ভাগা কৃষকের। কৃষক ধান বিক্রি করে আসল টাকাও ঘরে তুলতে পারছেন না। কুমিল্লার এক কৃষক দুঃখ করে বলেন, দেড় মণ ধান বিক্রি করে যদি একজন কৃষিশ্রমিকের এক দিনের ধান কাটার মজুরি দিতে হয়, তা হলে ধান করার চেয়ে জমি পতিত রাখাই ভালো। বর্তমানে তিন বেলা খাওয়াসহ ধান কাটতে একজন কৃষিশ্রমিককে মজুরি দিতে হয় ৭০০ টাকা। আর বাজারে নতুন ধানের দাম ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। প্রতি কেজি বোরো ধানের সরকার নির্ধারিত দাম ২৬ টাকা হলেও কৃষক তো সে দাম পাচ্ছেন না। কৃষকে ধান বিক্রি করতে হচ্ছে ১৫-১৬ টাকা কেজি দরে। তা হলে সরকার নির্ধারিত মূল্য কৃষকের কাছে অর্থহীন। দেশে বোরো চাল উৎপাদিত হয় প্রায় ১ কোটি ৯৫ লাখ টন। এ বছর সরকার কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনবে দেড় লাখ টন। এতে কৃষক কতটুকু লাভবান হবেন, তা বোধগম্য নয়। সরকার এবারের বোরো মৌসুমে ১০ লাখ টন সিদ্ধ চাল কিনবে প্রতি কেজি ৩৬ টাকা দামে এবং দেড় লাখ টন আতপ চাল কিনবে প্রতি কেজি ৩৫ টাকা দামে। এতে লাভবান হবেন মিল মালিক ও ধান ব্যবসায়ীরা। বিদ্যমান ব্যবস্থায় যেসব মিল মালিক সরকারি গুদামে চাল সরবরাহ করবেন তারা যদি কৃষকের কাছ থেকে সরকারি নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে ২-৩ টাকা কম দামেও ধান কিনতেন, তা হলেও কৃষক ধানের ন্যায্যমূল্য পেতেন। অথবা সরকার যদি চাল না কিনে কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান কিনত তা হলেও কৃষক এত বঞ্চিত হতেন না।

বর্তমানে ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন হাটবাজারে প্রতি মণ ব্রি-৪৯ জাতের আমন ধান ৭৫০ থেকে ৭৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। বাজারে এখনো পর্যাপ্ত পরিমাণে নতুন বোরো ধান উঠেনি। সামান্য পরিমাণে আগাম জাতের যে বোরো ধান বাজারে উঠছে , তা বিক্রি হচ্ছে ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা মণ দরে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসেবে বর্তমানে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি চাল ৩২ থেকে ৩৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি চাল বিক্রি হচ্ছে ২৬-২৭ টাকা দরে। আবার ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)-এর হিসাব অনুযায়ী রাজধানী ও তার আশপাশের এলাকায় গত এক মাসে চালের দাম আড়াই শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। আগাম জাতের বোরো ধান কাটা শুরু হওয়াতে সারা দেশে ধানের দাম কমতে শুরু করেছে। বর্তমানে হাওর এলাকায় প্রতি মণ বোরো ধান ৫৫০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এতে কৃষক আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। রংপুর ও দিনাজপুরের হাটবাজারগুলোতে প্রতি মণ বোরো ধান বিক্রি হচ্ছে ৬০০ টাকায়, যার উৎপাদন খরচ হয়েছে প্রতি মণ ৭০০ টাকা।

এ বছর শিলাবৃষ্টি, কোল্ড ইনজুরি ও নেক ব্লাস্টের আক্রমণে সারা দেশে বোরো ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, নেত্রকোনা হাওর এলাকার ৪টি উপজেলায় কোল্ড ইনজুরির কারণে ৬ হাজার হেক্টর বোরো ধান চিটা হয়ে গেছে। কৃষকদের মতে, কোল্ড ইনজুরিতে ক্ষতিগ্রস্ত জমির পরিমাণ আরো বেশি। কিশোরগঞ্জ জেলার নিকলি উপজেলায় নেক ব্লাস্টের আক্রমণে ব্রিধান-২৮ জাতে চিটা হয়ে গেছে। শুধু নিকলি নয়, নেক ব্লাস্টের আক্রমণে ময়মনসিংহ , জামালপুর, নেত্রকোনা ও কুমিল্লা জেলার অনেক এলাকায় ধান চিটা হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এ বছর ব্রিধান-২৮, ব্রিধান-২৯, ব্রিধান-৫৮ ও হাইব্রিড জাত ছক্কা জাতে নেক ব্লাস্টের আক্রমণ পরিলক্ষিত হচ্ছে বেশি। ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধানীখোলা দক্ষিণ ভাটিপাড়া গ্রামের আব্দুস সালামের ২৫ শতক ব্রিধান-২৮ জাতে নেক ব্লাস্টের আক্রমণে শতভাগ বিনষ্ট হয়ে গেছে। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ২৫ শতক জমিতে বোরো ধানের আবাদ করতে খরচ হয়েছে ৫ হাজার টাকা । ব্রিধান-২৮ জাতের ভিত্তি বীজের চারা রোপণ এবং মাত্রা মোতাবেক সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করার পরও ধানখেতটি একেবারে নষ্ট হয়ে গেল। তাই সরকারের উচিত নেক ব্লাস্টে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করা। অন্যথায় কৃষক বাঁচবে না। এ বছর চলনবিল এলাকার বোরো ধানে গত বছরের চেয়ে বিঘাপ্রতি ৫ থেকে ৭ মণ করে ফলন কম হচ্ছে।

বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এ কে এম লায়েক আলী স্বাক্ষরিত চাল আমদানির ওই চিঠিতে বলা হয়, ১৯৭১ সালে দেশে মোট ধান উৎপাদিত হয় ১ কোটি ৫০ লাখ টন। দুবার বাম্পার ফলনের পর দেশে প্রায় চার কোটি টন চাল উৎপাদিত হয়েছে। পাশাপাশি প্রয়োজনের তুলনায় বিগত দিনে অতিরিক্ত চাল আমদানি করা হয়েছে। বছরে চালের প্রয়োজন হয় সাড়ে তিন কোটি টন। ফলে এখন প্রায় দেড় কোটি টন চাল উদ্বৃত্ত রয়েছে। চলতি মৌসুমে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)-এর কে এ এস মুরশিদের মতে, দেশে উদ্বৃত্ত চাল থাকলে তা রফতানি করাই যেতেই পারে। তবে সামনে ঈদের বাজার। তখন সুগন্ধি চালের চাহিদা বেড়ে যাবে। আর ওই সুগন্ধি ও সরু চাল রফতানি শুরু হলে বাজারে সংকট তৈরি হয়ে দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যেতে পারে। তাই সরকারকে বুঝেশুনে হিসাব করে রফতানির সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

চাল উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ। অভ্যন্তরীণ বাজারে দাম বৃদ্ধির কারণে সরকার ২০০৮ সালের মে মাসে কিছু জাতের চাল রফতানি নিষিদ্ধ করে। এর আগে ২০০৭ সালে বন্যার কারণে চালের দাম বৃদ্ধি এবং সরকারি মজুদে টান পড়ায় বাংলাদেশ সরকার বিপুল পরিমাণ চাল আমদানি করে। তবে এর কয়েক বছরে সরকারের কৃষকবান্ধব নীতির কারণে বাম্পার ফলনের ফলে চালের মজুদ ও উৎপাদন ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ)-এর মতে, বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৮১ লাখ। কক্সবাজার এলাকায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী আছে আরো ১৩ লাখ। সব মিলিয়ে সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশকে ১৬ কোটি ৯৪ লাখ মানুষের অন্ন জোগাতে হবে। পৃথিবীতে বার্ষিক জনপ্রতি সবচেয়ে বেশি চাল গ্রহণ করে মিয়ানমারের মানুষ। দেশটিতে বছরে জনপ্রতি চাল পরিভোগের পরিমাণ ৩০৬ কেজি। এরপর বেশি চাল পরিভোগ করে ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডের মানুষ। তাদের জনপ্রতি বার্ষিক চাল গ্রহণের পরিমাণ যথাক্রমে ২৮৫ ও ২৩৩ কেজি। আর বাংলাদেশে জনপ্রতি বার্ষিক চাল ভোগের পরিমাণ হলো ২২৯ কেজি। বর্তমানে হাওর এলাকায় বোরো ধান কাটা চলছে। আমন চাল পেতে আরো ৮ মাস সময়ের প্রয়োজন হবে। জনপ্রতি বার্ষিক ২২৯ কেজি হিসেবে আগামী ৮ মাসে ১৬ কোটি ৯৪ লাখ লোকের জন্য চালের প্রয়োজন হবে প্রায় ২ কোটি ৫৯ লাখ টন। এবারের বোরো মৌসুমে যদি গত বছরের সমপরিমাণ, ১ কোটি ৯৫ লাখ টন চালও উৎপাদিত হয় এবং এর সঙ্গে সরকারি গুদামে মজুদ ১৩ লাখ টন যোগ করা হলেও চালের পরিমাণ দাঁড়ায় ২ কোটি ৮ লাখ টন। কথার কথা, মিল মালিক, ব্যবসায়ী ও কৃষকের ঘরে যদি আরো ৫০ লাখ টন চাল মজুদ থাকে, তা হলেও আমাদের রফতানির মতো কোনো উদ্বৃত্ত চাল নেই। এ ব্যাপারে কৃষি মন্ত্রণালয় ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষজ্ঞরা আরো ভালো করে বলতে পারবেন। কৃষকের সঙ্গে কথা বলে, বোরো ধানখেত সরজমিনে পরিদর্শন করে এবং পত্রপত্রিকা মারফত যে বিষয়টি প্রতীয়মান হয়েছে, তা হলো এ বছর শিলাবৃষ্টি, কোল্ড ইনজুরি ও নেক ব্লাস্ট রোগের আক্রমণে বোরো ধানের কাক্সিক্ষত ফলন নাও হতে পারে। তাই চাল রফতানির মতো একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সরকারকে আরো গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করতে হবে।

লেখক : সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি)

নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস্ লিমিটেড, নাটোর

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close