আবুল কাসেম ফজলুল হক

  ৩০ এপ্রিল, ২০১৯

মতামত

শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠতাবোধ ও কৃষ্ণাঙ্গ হীনতাবোধ

১০-১২ বছর আগে ফ্রান্সে শ্বেতাঙ্গরা কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে বেশ প্রবল আন্দোলন করে। সে দেশে এখনো কৃষ্ণাঙ্গবিরোধী মনোভাব প্রবল। শ্বেতাঙ্গদের বক্তব্য, ফ্রান্স শ্বেতাঙ্গদের রাষ্ট্র, সে রাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গরা এসে বেকার সমস্যা ও সামাজিক অপরাধ বাড়িয়েছে, জাতীয় ঐক্যে বিঘœ সৃষ্টি করে চলছে। এর মধ্যে ফরাসি সরকার ফ্রান্সে কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য কিছু অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণমূলক বিধিবিধান প্রবর্তন করেছে, এখন কৃষ্ণাঙ্গরা সেখানে গিয়ে নাগরিকত্ব নিতে পারে না। এর মধ্যে যুক্তরাজ্যেও কৃষ্ণাঙ্গদের নিয়ন্ত্রণের জন্য অতিরিক্ত বিধিবিধান প্রবর্তন করা হয়েছে। শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে ধারণা দেখা দিয়েছে যে, কৃষ্ণাঙ্গরা তাদের দেশে নাগরিকত্ব নিয়ে বেকার সমস্যা ও আরো নানাবিধ সমস্যা সৃষ্টি করে চলছে। ঢাকার পত্রপত্রিকায় কেউ কেউ লিখছেন যে, ইউরোপজুড়ে শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গবিরোধী মনোভাব এখন প্রবল রূপ নিয়েছে। কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতা ও দল এখন প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে শ্বেতাঙ্গদের পক্ষে দাঁড়িয়ে জনপ্রিয়তা লাভ করছে। তাদের বলা হচ্ছে, জনপ্রিয়তাবাদী সংরক্ষণবাদী, উগ্র জাতীয়তাবাদী। শ্বেতাঙ্গদের দুর্বল জাতিগুলোর জাতীয়তাবাদের ঘোরবিরোধী। দুই বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প ভোট চাইতে গিয়ে প্রচার করেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র শ্বেতাঙ্গদের রাষ্ট্র, তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে যুক্তরাষ্ট্রকে শ্বেতাঙ্গদের গৌরবজনক রাষ্ট্ররূপে গড়ে তুলবেন, যুক্তরাষ্ট্রের গৌরব ফিরিয়ে আনবেন। তিনি নারীবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে মানববাদের পক্ষে কথা বলেন। তিনি নারী ও পুরুষের বেলায় আইনের মাধ্যমে মানুষের সৃষ্ট সব বৈষম্য দূর করার প্রতিশ্রুতি দেন। ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রচারে মুসলমানদের বিরুদ্ধেও অনেক কথা বলেন এবং জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। তিনি ইসলামকে মনে করেন জঙ্গিবাদী ধর্ম। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকালে এবং নির্বাচনের পরে পৃথিবীর নানা স্থানে ট্রাম্পের বর্ণবৈষম্যবাদী ও নারীবাদবিরোধী বক্তব্য নানাভাবে নিন্দিত হয়েছে। ঢাকার নারীবাদীরা ও মানবাধিকারকর্মীরা ট্রাম্পের নির্বাচিত হওয়ার আগে ঢাকায় প্রতিবাদ সমাবেশ ও মানববন্ধন করে ট্রাম্পের নারীবাদবিরোধী, শ্বেতাঙ্গবাদী, কৃষ্ণাঙ্গবিরোধী, মুসলমানবিরোধী বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন। তারা যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের প্রতি ট্রাম্পকে ভোট না দেওয়ার জন্য আবেদন জানান। ট্রাম্প তার বক্তব্য ও অবস্থান পরিবর্তন করেননি। ইউরোপে ট্রাম্পের এসব বক্তব্যের সমর্থক বাড়ছে বলে মনে হয়। ইউরোপজুড়ে কৃষ্ণাঙ্গবিরোধী মনোভাব বাড়ছে। আগামী নির্বাচনে ট্রাম্প কি ক্ষমতা হারাবেন? মুসলমানদের বিরুদ্ধে ইঙ্গ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা কেন এত সক্রিয় বিশ্বশান্তির প্রয়োজনে তা তলিয়ে দেখা দরকার। আশির দশকের একেবারে শুরু থেকে বিবিসি রেডিওর বাংলা কর্মসূচি এবং ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা কর্মসূচি প্রচারের দ্বারা মৌলবাদবিরোধী আন্দোলন পরিচালনায় অত্যন্ত সক্রিয় ছিল। ২০ বছরের বেশি সময় ধরে তারা এ প্রচার-আন্দোলন চালিয়েছে। পাশাপাশি বৃহৎ শক্তিবর্গ নিজেদের রাষ্ট্রের বাইরে গণতন্ত্রকে নির্বাচনতন্ত্রে পর্যবসিত করার, সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে যতটা সম্ভব দুর্বল করার, ধনতান্ত্রিক মনোভাব আর অবাধ প্রতিযোগিতাবাদকে প্রবল করার, বহুত্ববাদ প্রচার করে জাতীয় ঐক্য ও রাষ্ট্রকে দুর্বল করার কার্যক্রমও চালিয়ে যায়। এসব আন্দোলন ও কার্যক্রম বাংলাদেশে কী ফল ফলিয়েছে তা অনুসন্ধান করে দেখা দরকার।

তথ্যপ্রযুক্তি ও জীবপ্রযুক্তির বিপ্লবের সময় থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা এবং দলমত নির্বিশেষে বুদ্ধিজীবীরা প্রায় সবাই যুক্তরাষ্ট্রের ও তার সহযোগী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিবর্গের অন্ধ অনুসারী হয়ে চিন্তা ও কাজ করছেন। পশ্চিম সভ্যতা যে দারুণভাবে অবক্ষয় ক্লিষ্ট, মানবিক গুণাবলি যে ওই সভ্যতায় দারুণভাবে পীড়িত, পাশবিক প্রবণতা প্রবল হয়ে চলছেÑ এটা তারা বুঝতে চান না। যেকোনো কিছুর অন্ধ অনুসারীরা কখনো মূল্যবোধ ও স্বাধীন বিচারপ্রবণতার পরিচয় দিতে পারেন না। পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গ এখন আগের চেয়ে অনেক দৃঢ়ভাবে আধিপত্য ও নির্ভরশীলতা নীতি নিয়ে চলছে। দুর্বল জাতিগুলোকে তারা নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে উঠতে দেয় না। তাদের হয়ে বিশ^ব্যাংক দুনিয়া চালাচ্ছে। বিশ^ব্যাংকই কার্যত বিশ^ সরকার। জাতিসংঘও বৃহৎ পশ্চিমা শক্তিবর্গেরই সংঘ মাত্র। চীন ও রাশিয়া ভেটো পাওয়ারের অধিকারী হয়েও বিশ্বশক্তির প্রশ্নে এখন নিষ্ক্রিয়প্রায়।

এ বাস্তবতায় উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন সত্ত্বেও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অবস্থা ভালো নয়। অর্থনৈতিক উন্নয়নের যে প্রবাহ দুনিয়াজুড়ে চলছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ আছে। তবে আত্মনির্ভরতার নীতি নিয়ে বাংলাদেশ চলছে না। বাংলাদেশে ধনী অত্যন্ত দ্রুতগতিতে আরো ধনী হয়ে চলছে এবং স্বাভাবিকভাবেই ধনী-গরিবের বৈষম্য দ্রুতগতিতে বাড়ছে। মানবসৃষ্ট অসাম্য বাড়ছে। সামাজিক অবিচার বাড়ছে। নারী নির্যাতন বাড়ছে। জুলুম-জবরদস্তি বাড়ছে। সমাজ যেন পরিণত হচ্ছে জালেম ও মজলুমের সমাজে। বিশ্বব্যাংকের উন্নয়নতত্ত্ব অনুযায়ী যে উন্নয়ন চলছে, তা বড়জোর উচ্চশ্রেণির শতকরা ১০ ভাগের উন্নয়ন। বাকিরা এ উন্নয়নের সুবিধা সামান্যই পাচ্ছে। শিক্ষাব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, প্রশাসনব্যবস্থা নিরাপত্তাব্যবস্থা গণবিরোধী রূপ নিয়ে আছে। জনগণের জন্য, জাতির জন্য, রাষ্ট্রের জন্য রাজনীতির অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। একটু অনুসন্ধান করলে প্রায় সবাই এসব বুঝতে পারবেন। চিন্তার জগৎটাও স্থবিরতার মধ্যে পড়ে আছে। শিল্প-সাহিত্যে প্রগতিশীল চিন্তাভাবনা দুর্বল। খ্যাতিমান প্রতিপত্তিশালী বুদ্ধিজীবীরা হয়ে আছেন সাম্রাজ্যবাদের অন্ধ অনুসারী আত্মবিক্রীত, দলদাস, সুবিধাবাদী। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলোর অন্ধ অনুসারী থেকে বাংলাদেশ মুক্ত স্বাভাবিক অবস্থায় উত্তীর্ণ হতে পারবে না। তাকে দাঁড়াতে হবে স্বাধীনসত্তা নিয়ে। তার জন্য নতুন বৌদ্ধিক কর্মকান্ড দরকার। চলমান রাজনীতি ও রাষ্ট্র, জাতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বাভাবিকতা লাভের ও উন্নতির প্রতিকূল।

যে অবস্থা চলছে তাতে রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থার উন্নতির জন্য, বিশ্বশান্তির জন্যÑ সব কিছুরই আমূল পরিবর্তন দরকার। তার জন্য নতুন বৈশি^ক আন্দোলন ‘আরম্ভ করা’ দরকার। প্রথমে দরকার বৌদ্ধিক আন্দোলনের। বৌদ্ধিক আন্দোলনের বিকাশের একপর্যায়ে গিয়ে গড়ে তুলতে হবে গণজাগরণ ও গণ-আন্দোলন। মনে রাখতে হবে, গণজাগরণ আর হুজুগ এক না। হুজুগ কাম্য নয়, গণজাগরণ কাম্য।

বাংলাদেশে অনেক লোকের মধ্যে বিদেশে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে নাগরিকত্ব গ্রহণের সীমাহীন তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। অনেকেই তাদের ছেলেমেয়েদের ওইসব রাষ্ট্রে নাগরিক করে চলছেন। শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠতাবাদ এখন যে রূপ নিচ্ছে, তাতে ওইসব রাষ্ট্রে গিয়ে নাগরিকত্ব গ্রহণের আগ্রহে অবশ্যই ভাটা দেখা দেবে। যারা নাগরিকত্ব নিয়েছে, তাদেরও অনেকে হয়তো ফিরে আসবে বাংলাদেশে। বাঙালি যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রগতিশীল জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি গ্রহণ করে উন্নত বাঙালি হতে পারে, কিন্তু নিজের কালো দেহ পরিবর্তন করে সাদা করতে পারেন না। এই বাস্তবতায় রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশে গড়ে তোলার সুযোগ বাড়ছে। দূতাবাসমুখী রাজনীতি যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের ওপর নির্ভরশীল রাজনীতি- সর্বোতভাবে পরিত্যাজ্য। এ ব্যাপারে প্রবল জনমত দরকার। সর্বাত্মক প্রচেষ্টা দরকার বাংলাদেশের রাজনীতিকে উন্নত করার এবং রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তোলার ও শক্তিশালী করার জন্য।

কৃষ্ণাঙ্গ হীনতাবোধ ত্যাগ করে শ্রেষ্ঠতাবোধ অর্জন করার জন্য সর্বাত্মক গবেষণা দরকার। তার জন্য যোগ্যতা অর্জন দরকার। শ্বেতাঙ্গরা কৃষ্ণাঙ্গদের পরিকল্পিতভাবে হীনতাবোধের দিকে ঠেলে দেয়। এ থেকে আত্মরক্ষা করতে হবে এবং আত্মশক্তি ও শ্রেষ্ঠতাবোধ অর্জন করতে হবে। নিজেদের শক্তিমান রাষ্ট্র গঠন করে নিজেদের যোগ্যতা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে হবে।

লেখক : প্রগতিশীল চিন্তাবিদ; প্রাক্তন অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close