রায়হান আহমেদ তপাদার

  ১০ এপ্রিল, ২০১৯

বিশ্লেষণ

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও একটি জিজ্ঞাসা

মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু এই মানবিকতার কারণেই এখন নানা ঝুঁকিতে পড়েছে দেশটি। খুব সহসাই এ সংকটের সমাধান হবে না। ফলে সারা দেশে রোহিঙ্গাদের ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে, আছে নানা চ্যালেঞ্জও। রোহিঙ্গাদের মধ্যে আছে এইডস আক্রান্ত মানুষ। বাংলাদেশে এখন কলেরা না থাকলেও রোহিঙ্গাদের মধ্যে রয়েছে সেই সমস্যাও। বন উজার হচ্ছে, পাহাড় কেটে ধ্বংস করছে তারা। দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক ঝুঁকিও আছে এর সঙ্গে। আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যাও প্রকট হতে পারে, বাড়তে পারে নিরাপত্তা ঝুঁকিও। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ এই সমস্যাগুলো কীভাবে মোকাবিলা করবে সেটা ঠিক করাই এখন একটা চ্যালেঞ্জ। বিশ্লেষকরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের নিয়ে সরকারকে এবার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে। না হলে দেশকে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হতে পারে। উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অদূরে অবস্থিত নৌকার মাঠের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ক্যাম্প ইনচার্জসহ পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থলে পৌঁছালে রোহিঙ্গারা তাদের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। আত্মরক্ষার্থে পুলিশ সাত থেকে আট রাউন্ড রাবার বুলেট ছুড়লে রোহিঙ্গারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়। রোহিঙ্গাদের মধ্যে সংঘর্ষ, খুনোখুনি নতুন কোন বিষয় নয়। তারা এদেশে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকেই নানা রকম সন্ত্রাসী কর্মকা- ও অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। তারা নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি এবং স্থানীয়দের সঙ্গে সংঘর্ষে রোহিঙ্গাসহ স্থানীয় মানুষও খুন হয়েছে তাদের হাতে।

উল্লেখ্য, তারা আমাদের দেশের আইনকানুন মানতে চায় না, তোয়াক্কা করতে চায় না বলেও পুলিশের অভিযোগ। তারা এ দেশে সুখে-শান্তিতে বসবাস করলেও নিজেরাই সব সময় নিজেদের মধ্যে বিবাদে জড়িয়ে পড়ছে। পাশাপাশি ছিনতাই, ডাকাতি, গুম, অপহরণসহ নানা অপরাধ কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েছে বলেও জানা যায়। তাদের কারণে স্থানীয় অধিবাসীরা নানা সংকটের মধ্যে দিন যাপন করছেন। কাজের অভাব হচ্ছে, নিত্যব্যবহার্য পণ্যদ্রব্যের দাম বেড়েছে। সুপেয় এবং ব্যবহার্য পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় পানির অভাব দেখা দিয়েছে। স্থানীয় নি¤œবিত্তদের জ্বালানি কাঠের অভাব দিন দিন তীব্রতর হচ্ছে। রোহিঙ্গারা বিভিন্ন ত্রাণসামগ্রী বিক্রি করার ফলে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা লোকসান গুনছে। মোটা দাগে বলতে গেলে স্থানীয় অধিবাসীরা বিরাট সংখ্যক রোহিঙ্গাদের চাপের কাছে যেন সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন দাতা ও সেবা সংস্থাগুলো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বিভিন্ন ধরনের, অনেক ক্ষেত্রে একাধিক দাতাসংস্থা প্রয়োজনের তুলনায় একই ধরনের অতিরিক্ত ত্রাণসামগ্রী দিচ্ছে। ফলে বিভিন্ন কেনাকাটার জন্য তাদের নগদ টাকার প্রয়োজনে তারা ত্রাণসামগ্রী বাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় কেউই তাদের রান্নার জন্য জ্বালানির ব্যবস্থা করছে না। প্রতি মাসে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য ৬ হাজার ৮০০ টন জ্বালানি কাঠের প্রয়োজন হয় বলে জানা যায়। এরা এসব জ্বালানি কাঠ সংগ্রহে বাংলাদেশের বনাঞ্চল ধ্বংস করছে। কক্সবাজার শিবিরে বাসস্থানচ্যুত রোহিঙ্গারা গাদাগাদি করে আছে। ফলে সেখান থেকে ভাসানচরে তাদের স্থানান্তরে আপত্তি জানিয়ে আসছিল জাতিসংঘ। এদিকে তারা আবার জানিয়েছে, ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরে তাদের আপত্তি নেই তবে তাদের জোর করে পাঠানো যাবে না।

রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় যেতে চাইলে যাবে অন্যথায় নয়। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী এ কে এম মোজাম্মেল হক গত ১৩ মার্চ-’১৯ আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক এক বৈঠকের পর জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় কোথায় হবে সেটি বাংলাদেশের নিজস্ব বিষয়। বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে তাদের আশ্রয়, নিরাপত্তা ও খাদ্য দেওয়া, মানবিক আচরণ, শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো মৌলিক চাহিদাগুলো নিশ্চিত করা। এখানে জাতিসংঘের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। তাদের দেখার বিষয় মানবিক দিকগুলোর কোনো ঘাটতি আছে কিনা। তিনি অভিযোগের সুরে বলেন, এ পর্যন্ত দাতাসংস্থাগুলোর কর্তাদের হোটেল বিল বাবদ হয়েছে দেড়শ’ কোটি টাকা, সেই হিসাবে রোহিঙ্গাদের পেছনে ২৫ শতাংশও খরচ করা হয় না বরং কর্মকর্তাদের তদারকিতেই ৭৫ ভাগের বেশি অর্থ তারা ব্যয় করছেন যা খুব দুঃখজনক। এখানে অনেক এনজিও কাজ করছে তবে তাদের কিছু সংখ্যক এনজিও অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করছে যা আমাদের গোয়েন্দা রিপোর্টেও উঠে এসেছে বলে মন্ত্রী জানান। ভাসানচরের আশ্রয় শিবিরের রোহিঙ্গাদের রাখার জন্য সব প্রস্তুতি প্রায় সমাপ্ত করা হয়েছে বলে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, আগামী ১৫ এপ্রিলের আগে পর যে কোনো সময়ে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের কাজ শুরু হতে পারে। রোহিঙ্গাদের অতিদ্রুত ভাসানচরে স্থানান্তরের ব্যাপারে সরকারের সর্বোচ্চ চেষ্টা রয়েছে বলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী সাংবাদিকদের অবহিত করেন। এ পর্যন্ত ৮ লাখ ৭২ হাজার ৮৮০ জন রোহিঙ্গা বনাঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছে। রোহিঙ্গাদের জন্য ২ লাখ ১২ হাজার ৬০৭টি গোসলখানা, ত্রাণ সংরক্ষণের জন্য ২০টি অস্থায়ী গুদাম, ১৩ কিলোমিটার বিদ্যুতের লাইন, ৩০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ এবং ২০ কিলোমিটার খাল খনন করা হয়েছে।

বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক একটি অবকাঠামো তৈরি করবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার বনভূমি ও বনজসম্পদ পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে। এছাড়া রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে গেলেও জায়গা জবরদখল হয়ে যেতে পারে এবং স্থাপনাগুলো অপসারণ করে বনায়ন করা কঠিন হবে এমতাবস্তায়, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়ে, মানবিকতা, সহানুভূতি, মহানুভবতা, উদারতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করার পাশাপাশি সমসাময়িক সময়ে একমাত্র বাংলাদেশই বিরাট সংখ্যক শরণার্থী আশ্র্রয় দিয়ে সারা বিশ্বে মর্যাদা, সুনাম, খ্যাতি অর্জন করলেও বাংলাদেশ এখন নিজেই মানবিক, সামাজিক, নৈতিক, আর্থসামাজিক, প্রাকৃতিক, পরিবেশ বিপর্যয়ের ভয়াবহ, ভয়ংকর সংকটের মুখোমুখি। বাংলাদেশের উন্নয়নের অব্যাহত অগ্রযাত্রা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর চাপে পিষ্ট, ভূলুণ্ঠিত হওয়ার সমূহ আশঙ্কা করছেন রাষ্ট্র ও সমাজবিজ্ঞানীসহ অপরাধ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। দেশ ও জাতির গভীর প্রত্যাশা জাতিসংঘ বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের তাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে বিশ্বনেতাদের নিয়ে যথাশিগগির সম্ভব বাস্তবসম্মত ও কার্যকর উদ্যোগ ও ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। অন্যথায় বাংলাদেশের সব অর্জন ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যেতে পারে। মিয়ানমারে ফেরত যাওয়া বাসস্থানচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নাগরিক এবং রাজনৈতিক অধিকার, মানুষের বেঁচে থাকার ন্যূনতম অধিকার কোনো শাসকগোষ্ঠী কেড়ে নিতে পারে না। অথচ অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে মিয়ানমারে মানবতার মৃত্যু ঘটেছে। মানুষ তাদের জন্মগত অধিকার হারিয়েছে। কোনো সুস্থ মানুষ এমন মানবিক, নৈতিক বিপর্যয় আশা করে না।

জাতিসংঘ নানা কথা বললেও মিয়ানমারকে বাধ্য করার ব্যাপারে কোনো কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অত্যাচারী সেনাসদস্যদের অভিযুক্ত করে শাস্তি দিতে না পারলে মিয়ানমারকে কাবু করা যাবে না। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পুনর্বাসনে যথাসাধ্য করছে। ভাসানচরে প্রত্যাবাসন তারই একটি অংশ মাত্র। এই প্রচেষ্টায় আমরা জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গোষ্ঠীর সমর্থন কামনা করি। পশ্চিমা দেশগুলো রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে বাংলাদেশকে রাজনৈতিক সমর্থন দিয়ে আসছে এবং মানবিক সহায়তাও দিচ্ছে। কিন্তু তাদের সঙ্গেও কিছুটা মতপার্থক্য আছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যতের বিষয়ে পশ্চিমা দেশগুলো চায় বাংলাদেশে তাদের ওপর বিনিয়োগ করতে যাতে মানবসম্পদের উন্নতি করা যায়। কিন্তু সরকার চায় এই বিনিয়োগ রাখাইনে করার জন্য, যাতে করে তারা ফেরত গিয়ে সেখানে সুন্দর জীবনযাপন করতে পারে। একজন কর্মকর্তা বলেন, আমরা সবাই চাই রোহিঙ্গাদের নিরাপদ এবং সম্মানজনক প্রত্যাবাসন। কিন্তু কয়েকটি বিষয়ে তাদের ওপর আমাদের মতপার্থক্য আছে এবং আমরা চেষ্টা করছি কীভাবে একটি কমপ্রোমাইজে পৌঁছানো যায়। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র আমাদের সর্বোতভাবে সহায়তা করছে এবং আমরা চাই তারা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে আরো বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণ করুক। এদিকে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের তৃতীয় দেশে স্থানান্তরের (রিলোকেট) বিষয় নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের মিডিয়ার অপপ্রচারণা নিয়ে বিরক্ত।

আশ্রিত হিসেবে রোহিঙ্গাদের আয়ের কোনো উৎস নেই? জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু ব্যয় প্রায় ৭০০ ডলার। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ব্যয় থাকলেও বৈধপথে আয়ের কোনো উৎস নেই। সেই হিসাবে এই ৭ লাখ রোহিঙ্গার পেছনে সরকারের বছরে ব্যয় হবে প্রায় ৪৯ কোটি ডলার বা ৩ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা, যা অর্থনীতির চাকা সচল রাখার ক্ষেত্রে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। বর্তমানে কিছু সাহায্য সহযোগিতা পাওয়া গেলেও দীর্ঘমেয়াদি এই সাহায্য অব্যাহত থাকবে সেটা বলা মুশকিল। যখন পাওয়া যাবে না তখন বাংলাদেশকেই এই টাকা খরচ করতে হবে। রোহিঙ্গাদের কারণে বাংলাদেশ বড় ধরনের আর্থিক চাপে পড়তে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞ মহল। কারণ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পেছনে বাড়তি মনোযোগ দিতে হয়। সে জন্য সেখানে পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিজিবিসহ বিভিন্ন বাহিনীর লোকজন নিয়োগ করতে হয়েছে। ফলে রাষ্ট্রীয় ব্যয় বাড়ছে। আর এই ব্যয়টা খরচ হচ্ছে বাজেট থেকে। অথচ রোহিঙ্গা সমস্যা না থাকলে এই টাকা অন্য জায়গায় ব্যয় করা যেত। সেটা করা গেলে দেশের কিছু মানুষ অন্তত ভালো থাকার সুযোগ বঞ্চিত হতো না।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close