মোহাম্মদ আবু নোমান

  ২২ মার্চ, ২০১৯

বিশ্লেষণ

নিয়ম লঙ্ঘনই যখন নিয়ম

নিয়ম মেনেই জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছিলেন আবরার। অন্যদিকে নিয়ম ভেঙে সুপ্রভাত বাসের চালক অন্য একটি বাসের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে আবরারকে প্রথমে ধাক্কা ও পরে চাপা দিয়ে খানিকটা টেনেও নিয়ে যায়। এতে প্রাণ চলে যায় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরীর। পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, শিক্ষার্থীদের বহনকারী বিইউপির একটি বাস সকালে যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। সকাল সাড়ে ৭টার দিকে আবরার বাসে উঠতে যাচ্ছিলেন। এ সময় পাশে থাকা গাজীপুরগামী সুপ্রভাত পরিবহনের একটি বাস তাকে চাপা দিলে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। পরে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসী সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন।

ঘটনাটি খুবই পরিতাপ ও কষ্টের বিষয়। আবরারের মৃত্যু ঘটনায় কোনোভাবেই মনকে সান্ত¡না দেওয়া ও বরদাশত করার মতো নয়। একটি প্রাণ ঝরে পড়ল; পত্রিকার নিউজ হলো; কদিন একটু চিল্লাপাল্লা; টিভিতে টক-ঝাল-মিষ্টি শো! ব্যস, শেষ! তারপর যা আছে তাই। যারা বা যাদের এই কাজগুলো নিয়ে চিন্তা-ফিকির করার ও আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। টাকার গন্ধে তাদের মগজে পচন ধরে গেছে, তাই আজকাল কিছু বললেও খুব বেশি একটা কাজ হয় না। রাস্তায় অহরহ গাড়িচালকের নিয়ম ভাঙার ভয়াবহ প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। এদের লাগাম টেনে ধরার কেউ আছে বলে মনে হয় না। রাস্তায় গাড়ির ওভারটেকিং, কতটুকু নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে পাশাপাশি চলতে হবে, এ জন্য কঠোর বিধিবিধান করে তা কার্যকর করার কি কোনো উপায় নেই! ইতোপূর্বে একই রুটে জানালে নূর পরিবহনও দুর্ঘটনা ঘটিয়ে এখনো স্বদম্ভে চলছে। বাস মালিক চক্র কি এতই শক্তিশালী? আর কত প্রাণ হরণের পর মালিক ও ড্রাইভার চক্র শান্ত হবে? নিরাপদ সড়ক উপহার দিতে পারবে প্রশাসন? এ প্রশ্নের জবাবটা জানার অধিকার নিশ্চয়ই আমাদের তথা দেশবাসীর আছে। আমরা জবাব পেতে চাই।

রাজধানীর যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে বাসচাপায় শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার জেরে সেখানে সড়ক অবরোধ করে শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসী। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম ঘটনাস্থলে গিয়ে অবরোধ তুলে নেওয়ার অনুরোধ, সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিতকরণ, সুপ্রভাত পরিবহনের কোনো বাস ওই রুটে চলতে না দেওয়া ও নিহত আবরারের নামে সেখানে তিন-চার মাসের মধ্যে একটি পথচারী সেতু নির্মাণ করে দেওয়া হবে জানালেও তাতে সাড়া দেয়নি অবরোধকারীরা।

আবরারের জীবনের বিনিময়ে তার নামে একটি ফুট ওভারব্রিজ কি অনেক বড় কিছু? এত সস্তা মানুষের জীবন! কোমলমতি শিক্ষার্থীরাও বোঝেÑ এসবই ছেলেভোলানো কথা। বাস্তবায়ন সুদূরপরাহত। মেয়র যত সাবলীলভাবেই বলুক না কেন, দেশে এসব বাস্তবায়ন অত সহজ নয়। প্রকৃতপক্ষে মিথ্যা কথা বলে কোনো খারাপ ফল ভোগ করতে হয় না বলেই আজ সত্যের এত আকাল। নিয়ম না মানা দানবের জিম্মায় পরিবহন সেক্টরকে রেখে রাষ্ট্র কীভাবে দুর্ঘটনা প্রশমন করবে? এজন্য পাবলিক পরিবহন সেক্টরে অরাজকতার দায় প্রশাসনকেই নিতে হবে। রাস্তা আটকিয়ে প্রতিবাদ করা যদিও সর্বসাধারণের জন্য কষ্টের কারণ। কিন্তু কারো আপনজন যখন এমন দুর্ঘটনায় পতিত হন, তাদের অবস্থান থেকে মেনে নেওয়াও যায় না।

যখনই কোনো মৃত্যু হয়, হোক সেটা বাসচাপায়, অথবা আগুনে পুড়ে; আমরা সবাই শোকাহত হওয়াসহ লেগে যাই সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধান করতে। যেমনÑ ওই কোম্পানির বাস চলবে না, ফ্যাক্টরিগুলোতে তালা ঝুলবে ইত্যাদি। কিন্তু এই সমস্যাগুলোর মূল উপসর্গ অনুসন্ধানে আমরা ব্যর্থ। আমরা সাময়িক উপসর্গগুলোর চিকিৎসা করতে থাকি এবং মূল সমস্যাটা তার জায়গাতেই রয়ে যায়।

জানা গেছে, ইতোমধ্যে আবরার আহাম্মেদ চৌধুরীকে চাপা দেওয়া বাসটির রেজিস্ট্রেশন বাতিল করেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। বিআরটিএর সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ার) রফিকুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক পত্রে জানানো হয়েছে, ‘মোটরযান অধ্যাদেশ, ১৯৮৩ এর ৪৩ ধারা মোতাবেক ঢাকা-মেট্রো-ব-১১-৪১৩৫ নং বাসের রেজিস্ট্রেশন সাময়িকভাবে বাতিল করা হলো।’ কিন্তু প্রশ্ন হলো, গাড়িটি কি নিজে নিজেই এসে আবরারকে চাপা দিয়েছে। মনে হয়, বাসের কোনো চালক ছিল না! তাই বাসের নিবন্ধন বাতিল! পরবর্তীতে নতুন নামে নিবন্ধন হবে! বিআরটিএর কর্তৃপক্ষের কিছু উপরি কামাইও হবে। সামনে আর অ্যাক্সিডেন্টও হবে না...!

সরকার বা প্রশাসন সড়কে হত্যাগুলোর যথাযথ বিচার, গাড়ি ও চালকের লাইসেন্স ও ফিটনেস যথাযথ পরীক্ষা করলে সড়ক দুর্ঘটনা অনেক কমে আসত। ইতোপূর্বের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল তার কিছুই বাস্তবায়ন হয়নি। ঢাকার রাস্তায় বাসগুলো এখন বরং আগের চেয়েও বেশি বেপরোয়াভাবে চলছে। কারণ তারা জানে, তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাদের পক্ষে সরকার আছে।

বাংলাদেশের মানুষের জীবন আজ কিছু অর্থলোভী বাসের মালিক, বিআরটিএর কতিপয় অসাধু কর্তৃপক্ষ ও ড্রাইভারদের হাতে জিম্মি! তা না হলে বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া এমন মেধাবী তরতাজা একটা জীবন পঞ্চম/অষ্টম শ্রেণি পাস মাতাল ড্রাইভারের হাতে যেতে পারে? এ জিজ্ঞাসা সবার। জেব্রা ক্রসিং কি; জেব্রা ক্রসিংয়ে গাড়ির গতি কমাতে হয়, অধিকাংশ ড্রাইভার তাও জানে না। তা হলে এই রকম জেব্রা ক্রসিং দিয়ে কী লাভ? এজন্য সব জেব্রা ক্রসিংয়ের আগে স্পিড ব্রেকার দেওয়া জরুরি।

অনেক কষ্টে সন্তান মানুষ করতে হয়। মায়ের পেটে ১০ মাস থেকে শুরু। তারপর হামাগুড়ি, হাঁটি হাঁটি পা পা, তারপর ‘প্লে’ ক্লাসে ভর্তি। সোনামণিদের ছোট ছোট বায়না। ধীরে ধীরে বড় হয়ে স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি। যখন সোনামণি তার জীবন শুরু করতে যাবে, আর তখন যদি এ রকম অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনায় পতিত হয়, তখন কি বলে মা-বাবা মনকে সান্ত¦না দেবে? রাস্তায় যাত্রী নেওয়ার জন্য বাসচালকদের যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা, এটা কোনো সভ্য মানুষের কাজ নয়। কোনো সভ্য দেশে এ রকমটা চলতে পারে না। এ জন্য সরকারি উদ্যোগে দক্ষ গণপরিবহন চালক তৈরির ব্যবস্থা করতে হবে। না হলে এভাবে রাস্তায় মানুষ খুন চলতেই থাকবে। কারণ আমাদের পরিবহন সেক্টরটা পুরোপুরি অদক্ষ ও অমানুষদের হাতে চলে গেছে। আর সর্বসাধারণ প্রতিনিয়ত এমন অনিরাপদ সড়কে চলাচল করছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ, অনেক হয়েছে, এবার কার্যকর ব্যবস্থা নিন। সরকার বা প্রশাসনের চেয়ে ক্ষমতাবান যে কেউই নয়, এটা বাস মালিক ও শ্রমিকদের বোঝানোর চেষ্টা করুন।

বিইউপির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী আবরারে নিহত হওয়ার ঘটনায় শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েছেন তার শিক্ষক ও সহপাঠীরা। মেধাবী এ ছাত্রের এভাবে চলে যাওয়া মেনে নিতে পারছেন না তার শিক্ষকরা। প্রিয়বন্ধুর মর্মান্তিক পরিণতিতে শোকাতুর তার সহপাঠীরাও। বিইউপির একাধিক শিক্ষার্থী বলেন, খুব শান্ত ও অমায়িক স্বভাবের ছিলেন আবরার। কারো সঙ্গে কখনো মনোমালিন্য হতো না তার। সহপাঠীদের সবার সঙ্গেই ভালো বন্ধুত্ব ছিল। আবরারের শিক্ষক বিইউপির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শায়লা সুলতানা বলেন, ‘... এককথায় মনে রাখার মতো ছাত্র ছিল আবরার। যেমন পড়াশোনায়, তেমনি আচার-আচরণে। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা ও বিতর্ক প্রতিযোগিতাতেও তার সরব উপস্থিতি ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব প্রতিযোগিতায় আবরার প্রথম হতো...।’

পথচারী পারাপারের জন্য ব্যস্ত রাস্তায় আড়াআড়ি সাদা-কালো ডোরাচিহ্নিত দাগ দেওয়া নির্দিষ্ট অংশ জেব্রা ক্রসিং নামে পরিচিত। সাধারণত স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল বা যেখানে পাবলিক সমাগম বেশি থাকে, সেখানে মানুষ যাতে সহজে রাস্তা পারাপার হতে পারে, সেজন্যই জেব্রা ক্রসিং দেওয়া হয়। নিয়ম হলো জেব্রা ক্রসিংয়ের সামনে চালক গাড়িকে একটা নির্দিষ্ট গতিসীমার নিচে নিয়ে আসবে, যাতে পথচারী সহজেই রাস্তা পার হতে পারে। ঢাকা শহরের বেশির ভাগ জেব্রা ক্রসিং তিন রাস্তা, চৌরাস্তা অথবা রাস্তার মোড়ে দেওয়া হয়েছে চলাচল সুগম করতে। কিন্তু আমাদের দেশের অধিকাংশ যানবাহন চালক কোনো তোয়াক্কাই করছে না জেব্রা ক্রসিং।

আধুনিক শহরগুলোতে রাস্তা পারাপারে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় জেব্রা ক্রসিং। আবার পারাপারের জন্য ক্ষেত্রবিশেষে পথচারী সেতুও ব্যবহার করা হয়। কিন্তু ঢাকার মতো জনবহুল নগরের পথচারী সেতুগুলো নারী, শিশু, অসুস্থ, বয়স্ক, প্রতিবন্ধী কিংবা ভারী ব্যাগ বহনকারীদের জন্য উপযোগী নয়। এগুলো যথাযথ স্থানেও তৈরি হয়নি। ফলে নাগরিকদের মধ্যে পথচারী সেতু ব্যবহারে অনীহা দেখা যায়। এ ছাড়াও পথচারী সেতুর উচ্চতা, নোংরা পরিবেশ, হকার ও মাদকসেবীদের দখল করে রাখা, সবকিছু মিলে এই সেতু পথচারীদের জন্য অনিরাপদ। এ জন্য মানুষ নিরাপদে জেব্রা ক্রসিং দিয়ে সড়ক পার হতে চায়।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close