সাধন সরকার

  ২০ মার্চ, ২০১৯

পর্যালোচনা

আশীর্বাদের নদী এখন অভিশাপ

একসময়ের খরস্রোতা ডাকাতিয়া নদী দূষণ আর দখলের কবলে পড়ে মৃতপ্রায় নদীতে পরিণত হয়েছে। ডাকাতিয়া নদী মূলত বাংলাদেশ ও ভারতের একটি আন্তসীমান্ত নদী। এটি মূলত মেঘনার একটি উপনদী। নদীটি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে আসা কাঁকড়ী নদী থেকে উৎপন্ন হয়ে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার উজিরপুর ইউনিয়নের কাশিপুর এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশে করেছে। এরপর চৌদ্দগ্রাম হয়ে হাজীগঞ্জ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চাঁদপুরের মেঘনা নদীতে মিশেছে। নদীটির দৈর্ঘ্য প্রায় ২০৭ কিলোমিটার, প্রস্থ প্রায় ২২০ ফুট (৬৭ মিটার)। নদীটির ধরন-প্রকৃতি সর্পিলাকার। নদীটির নামকরণ নিয়ে বিভিন্ন মতবাদ প্রচলিত আছে। এ নদী দিয়ে একসময় মগ-ফিরিঙ্গ জলদস্যুরা নোয়াখালী ও কুমিল্লা জেলায় প্রবেশ করত এবং নদীতে এরা ডাকাতি করত। ডাকাতের উৎপাতের কারণে নদীটির নাম ডাকাতিয়া হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। আবার ধারণা করা হয়, ডাকাতিয়া নদীর করালগ্রাসে দুই পারের মানুষ সর্বস্ব হারাত। জীবন বাঁচাতে ডাকাতিয়া পাড়ি দিতে গিয়ে বহু মানুষের সলিলসমাধি রচিত হয়েছে। ডাকাতের মতো সর্বগ্রাসী বলে এর নামকরণ হয়েছে ডাকাতিয়া নদী।

কুমিল্লা ও চাঁদপুরের বেশ কয়েকটি উপজেলার মানুষের কাছে আশীর্বাদের ডাকাতিয়া নদী এখন অভিশাপে পরিণত হয়েছে। কুমিল্লা, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী জেলায় একসময় প্রধান যোগাযোগমাধ্যম ছিল নৌপথ। ডাকাতিয়া নদীর বদৌলতে লাকসামসহ বিভিন্ন উপজেলায় ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটে। ব্যবসায়ীদের যাতায়াতের প্রধান মাধ্যমও ছিল এ নৌপথ। একসময় পালতোলা নৌকা চলত ডাকাতিয়া নদীতে। বিভিন্ন পণ্যবাহী বড় বড় জাহাজ ও লঞ্চ ডাকাতিয়ার বিভিন্ন নৌপথ দিয়ে চলাচল করত। শুষ্ক মৌসুমে কৃষকরা ফসল আবাদের সময় এ নদী থেকে পেতেন পর্যাপ্ত পানি। এ ছাড়া আগে খরস্রোতা এই নদীতে ছিল প্রচুর দেশীয় মাছের প্রাচুর্য। স্থানীয় হাজার হাজার জেলে এই নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। সেই ডাকাতিয়া এখন দখল-দূষণ আর নাব্য সংকটে রীতিমতো অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে। এককথায়, লাখো মানুষের প্রাণের স্পন্দন হিসেবে পরিচিত নদীটি এখন পরিণত হয়েছে মরা খালে। নদীটি ঘিরে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সেচ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। নদীতে বিভিন্ন সময় বাঁধ নির্মাণ ও স্লুইসগেট স্থাপন করা হয়েছে। ডাকাতিয়া নদীর দুই পার অবৈধভাবে দখল ও ভরাট করে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন স্থানে কল-কারখানার দূষিত বর্জ্য ও আবর্জনা ফেলে বিষাক্ত করে তোলা হয়েছে। নদীতীরের আশপাশের বসতবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ময়লা-আবর্জনা ফেলার কারণে ভাগাড় গড়ে তোলা হয়েছে নদীর বুকে। পানিদূষণের ফলে নদীতে জলজ প্রজাতি ও মাছের বংশবিস্তার ব্যাহত হচ্ছে। এককথায়, নদীর সৌন্দর্যবিলীনে উঠে-পড়ে লেগেছে নদীখেকোরা। যুগ যুগ ধরে নদীটি খনন না করায় পলি জমে ভরাট হয়ে নাব্য সংকটে ভুগছে। নদীর তলদেশে মাইলের পর মাইল বালুচর পড়েছে। এর কুফল ভোগ করতে হচ্ছে স্থানীয় অধিবাসীদের। নদীটি পলি পড়ে ভরাট হয়ে যাওয়ায় অল্প বৃষ্টিতেই ভেসে যায় নদীর দুই কূল। বর্ষা মৌসুমে নদীটি হয়ে ওঠে দক্ষিণ কুমিল্লাসহ আশপাশের এলাকার বন্যার প্রধান কারণ। এ সময় বন্যায় ভেসে যায় শত শত গ্রাম। আবার শুষ্ক মৌসুমে দেখা যায় তার উল্টোচিত্র। বোরো মৌসুমে বা সেচের সময় ডাকাতিয়া নদী হয়ে উঠে ধু-ধু বালুচর। সেচের অভাবে তখন ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়। আগে ডাকাতিয়া নদীর পানি দিয়ে হাজার হাজার একর জমিতে কৃষি আবাদ হতো। বর্তমানে ইরি-বোরো আবাদের মৌসুমে ডাকাতিয়া ও এর শাখা খালগুলো পানিশূন্য হয়ে পড়ে।

ব্যবসা-বাণিজ্য ও যাতায়াতের প্রধান ক্ষেত্র হয়ে ওঠা সেই ডাকাতিয়া নদীর অবস্থা এখন কাহিল। ২২০ ফুট প্রস্থের নদীটি কোথাও ৪০, আবার কোথাও ৩০ ফুটের মরা খালে পরিণত হয়েছে। ডাকাতিয়া নদী স্থানীয় মানুষের জীবন-জীবিকার সঙ্গে জড়িত। ফসল উৎপাদনের জন্য ডাকাতিয়া নদীর পানি না পাওয়ায় কৃষিকাজে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। তাই অবিলম্বে দখল-দূষণের কবল থেকে নদীটিকে রক্ষা করে জরুরিভিত্তিতে খনন করা প্রয়োজন। ডাকাতিয়া নদী দখল-দূষণ আর ভরাটের পেছনে কারা জড়িত, তা কর্তৃপক্ষের অজানা থাকার কথা নয়! এমনিতেই নদী দখল-দূষণ আর ভরাটের প্রভাব পড়েছে দেশ জুড়ে। সময়ের ব্যবধানে অনেক নদী ইতোমধ্যে হারিয়ে গেছে, আবার অনেক নদী হারিয়ে যাওয়ার পথে। নদ-নদী তথা প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষতি অপূরণীয়। তাই ডাকাতিয়া নদীসহ দেশের অন্যান্য নদ-নদী রক্ষায় দ্রুত প্রয়োজনীয় ও পরিকল্পিত পদক্ষেপ নিতে হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close