দিলীপ কুমার আগরওয়ালা

  ১৯ মার্চ, ২০১৯

আলোচনা

বাংলাদেশের শিল্পায়নের পথিকৃৎ

ক্ষুদ্র ও হালকা শিল্পে গত সাড়ে চার যুগে নীরবে বিপুলভাবে এগিয়েছে বাংলাদেশ। এ ক্ষেত্রে যে সাফল্য অর্জিত হয়েছে, তাকে নীরব বিপ্লব বলে অভিহিত করাই যথার্থ হবে। এ বিপ্লবে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন ঢাকার কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরা এলাকার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাহীন ইঞ্জিনিয়াররা। যে কোনো যন্ত্রের আদলে যন্ত্র তৈরিতে যাদের জুড়ি নেই। জিঞ্জিরার চেতনা ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। দেশীয় প্রযুক্তির ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ উদ্ভাবন, উৎপাদন ও বাজারজাতে বদলে গেছে দৃশ্যপট।

মাত্র কয়েক বছর আগেও অতি প্রয়োজনীয় যেসব যন্ত্রপাতি শতভাগ আমদানিনির্ভর ছিল, আজ দেশের চাহিদা মিটিয়ে তা বিদেশে রফতানিও হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রস্তুত মেশিনপত্র এখন চীন-ভারতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিশ্ববাজারে ঠাঁই করে নিচ্ছে। ব্যক্তি পর্যায়ের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের প্রচেষ্টায় অর্জিত হয়েছে অভাবনীয় এ সাফল্য। এ ক্ষেত্রে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে হালকা ও মাঝারি শিল্পে সাফল্যের নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত গড়ে ওঠার সম্ভাবনাও রয়েছে। হালকা শিল্পে ব্যতিক্রমী সাফল্যের দৃষ্টান্ত হয়ে আছে জিঞ্জিরা।

এখানকার ঝুপড়ি বস্তির অজস্র কারখানায় খুদে ইঞ্জিনিয়ারদের তৈরি হাজারো পণ্যের কদর রয়েছে সর্বত্র। দেশ-বিদেশে ‘মেড ইন জিঞ্জিরা’ হিসেবে ব্যাপক পরিচিতিও আছে এসব পণ্যের। রাজধানীর বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষা জিঞ্জিরা-শুভাঢ্যা থেকে শুরু করে কেরানীগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়েই হালকা ও ক্ষুদ্র শিল্পের অভাবনীয় বিস্তার ঘটেছে। এ শিল্পের পরিসর এখন আর জিঞ্জিরা-কেরানীগঞ্জে সীমাবদ্ধ নেই, সম্প্রসারিত হয়েছে রাজধানীর আনাচে-কানাচে, দেশজুড়ে। ক্ষুদ্র ও হালকা শিল্পের সূচনা হয়েছিল জিঞ্জিরায়। অন্য দেশের যন্ত্রপাতি হুবহু নকলের মাধ্যমে প্রযুক্তির ক্ষেত্রে সক্ষমতা অর্জনের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল তা ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। গড়ে ওঠছে ক্ষুদ্র ও হালকা শিল্পের লাখ লাখ দক্ষ কারিগর; যাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকলেও অভাব নেই উদ্ভাবন শক্তির। পুঁথিগত বিদ্যায় ঘাটতি থাকলেও প্রযুক্তিগত কলাকৌশল আয়ত্ত করার সক্ষমতার তুলনা নেই। জাপান, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া শিল্পায়নের পথে এগিয়েছে এভাবেই দক্ষ কারিগরদের ওপর ভরসা করে। বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করেছেন তারা। জিঞ্জিরার পথ ধরেই আগামী দিনে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান উৎপাদন কেন্দ্রে পরিণত হবে এ প্রত্যাশা আমাদেরও।

জিঞ্জিরা মডেল অনুসরণে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠেছে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান। ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ ও যন্ত্রপাতি নির্মাণে তারা পারঙ্গমতা দেখাতে সক্ষম হয়েছেন। জিঞ্জিরার ঝুপড়ি বস্তির ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ কারখানার খুদে ইঞ্জিনিয়ারদের তৈরি হাজারো পণ্য-সামগ্রীর কদর রয়েছে ব্যবহারকারীদের কাছে। ‘মেড ইন চায়না’ তকমা পরিয়ে বিক্রি হচ্ছে জিঞ্জিরার তৈরি পণ্য।

রাজধানীর বুড়িগঙ্গা নদীর তীর ঘেঁষা জিঞ্জিরা-শুভাঢ্যা থেকে শুরু করে কেরানীগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে গড়ে ওঠেছে হাজারো কারখানা। অনর্গল ইঞ্জিনের ধস ধস, গড় গড় শব্দ, কারিগরের হাঁকাহাঁকি, শ্রমিকদের কোলাহল রাত-দিনের ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছে। ১২ লাখ কারিগর ও শ্রমিকের উদয়াস্ত পরিশ্রমে সুঁই, ব্লেড, আলপিন থেকে শুরু করে নাট-বল্টু, রেলের যন্ত্রাংশ, ফ্লাস্ক, মোবাইল ফোন, সমুদ্রগামী জাহাজের যন্ত্রাংশ পর্যন্ত তৈরি হচ্ছে এখানে। সর্বাধুনিক প্রযুক্তির এসব মালামাল তৈরি করছেন লেখাপড়া না জানা ইঞ্জিনিয়াররা। এখানকার খুদে কারিগরদের দক্ষতা অবাক করে দেওয়ার মতো। বছরের পর বছর গবেষণার পর জাপান, কোরিয়া, চীন যেসব সামগ্রী আজ উৎপাদন ও বাজারজাত করছে, সেসব জিনিস হাতে পাওয়ার পরদিনই তা তৈরি করে ফেলছেন জিঞ্জিরার কারিগররা। জাহাজ ভাঙা স্ক্র্যাপ, বিভিন্ন শিল্প-কারখানা, রোলিং মিল, নির্মাণাধীন স্থাপনার পরিত্যক্ত লোহা ও শিট থেকে তাক লাগানো নানা যন্ত্রপাতি তৈরি করছেন তারা।

আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে কেরানীগঞ্জের এই নীরব শিল্পবিপ্লব যে অসামান্য ও সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখছে তাতে সন্দেহ নেই। কেরানীগঞ্জের পোশাক শিল্প, লৌহজাত পণ্য উৎপাদন এবং শিপইয়ার্ড ও ডকইয়ার্ড শিল্প ১৫ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান করে দিয়েছে। বিপুল জনসংখ্যার এ দেশে একটি ছোট এলাকাকে ঘিরে ১৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সাধারণ ঘটনা নয়। কেরানীগঞ্জে গত কয়েক বছরে গড়ে ওঠা এই তিনটি শিল্প খাতের উৎপাদন যে কী বিপুল সাড়া জাগিয়েছে ওই এলাকায়, তা ঘটনাস্থলে না গেলে কেউ কল্পনাও করতে পারবেন না। সেখানে দৈনিক গড়ে ২৭০ কোটি টাকার পণ্য কেনাবেচা হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা, কেরানীগঞ্জে বেতন-ভাতা, ওভারটাইম আর বোনাস নিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে কোনো ধরনের অসন্তোষ নেই। তার মানে শ্রমিকদের ন্যায্য প্রাপ্য পরিশোধে সংশ্লিষ্ট শিল্প মালিকরা সততা ও নিষ্ঠার পরিচয় দিচ্ছেন।

জিঞ্জিরায় বিভিন্ন পণ্য অবিকল তৈরির যে বহু বছরের দক্ষতা, যথার্থ পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তা কাজে লাগিয়ে উন্নতমানের নানা পণ্য উৎপাদনে সাফল্য পেতে পারত দেশ। উপেক্ষার পরও জনসাধারণের কাছে মেড ইন জিঞ্জিরার পণ্য বেশ সমাদৃত। এমনকি মধ্যপ্রাচ্যেও বাজার পেয়েছে কেরানীগঞ্জ ও জিঞ্জিরার পণ্য। ধোলাইখালে যানবাহনের চেসিস, ইঞ্জিনসহ বিভিন্ন খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরির যে অসামান্য দক্ষতা আমাদের অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত শ্রমিকরা দেখাচ্ছেন, তারাও পৃষ্ঠপোষকতা পেলে একটা নতুন বিপ্লব ঘটাতে পারতেন। দেশের অর্থনীতিতেও কেরানীগঞ্জ-জিঞ্জিরা বিশাল ভূমিকা রাখতে পারে।

লেখক : পরিচালক, এফবিসিসিআই

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close