নিতাই চন্দ্র রায়

  ১৯ মার্চ, ২০১৯

পর্যালোচনা

গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি ও জনদুর্ভোগ

গ্যাসের দাম বাড়লে ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেবেন। বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে দেবে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। পরিবহন ব্যবসায়ীরা বাড়িয়ে দেবেন গাড়ি ভাড়া। এর সব প্রভাব পড়বে জনসাধারণের ওপর। তেল, চিনি, লবণ, আটা, ময়দা, সুজি, মাছ ও মুরগির খাবার তৈরিতে প্রচুর গ্যাস-বিদ্যুতের দরকার হয়। গ্যাসের দাম বাড়লে তারও প্রভাব পড়বে এসব পণ্য উৎপাদনে। এছাড়া গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিতে জ্বালানি কাঠ ও কয়লার ব্যবহার বাড়বে। এতে হুমকির মুখে পড়বে দেশের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য।

গত বছর এপ্রিল থেকে দেশে তরলীকৃত গ্যাস (এলএনজি) আমদানি শুরু হয়। প্রাকৃতিক গ্যাসের পাশাপাশি কাতার থেকে এলএনজি আমদানি করে সরবরাহ শুরু করে পেট্রোবাংলা। প্রতি হাজার ঘনফুট এলএনজি ১০ হাজার ডলারে আমদানি করে ভাসমান টার্মিনালের মাধ্যমে প্রাকৃতিক গ্যাসে রূপান্তরের পর তা সরবরাহ করা হচ্ছে। সব ধরনের প্রক্রিয়া শেষে এতে এলএনজির প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম দাঁড়ায় ৩২ টাকা। যদিও গ্রাহকপর্যায়ে বর্তমানে সব শ্রেণির গ্যাসের গড় দাম ৭ টাকা ৩৫ পয়সা। এলএনজি আমদানির ফলে ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছিল বিতরণ কোম্পানিগুলো। গণশুনানি করে বিইআরসি গ্যাসের দাম কিছুটা বাড়িয়েছিল। কিন্তু ভোটের আগে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কায় গ্যাসের দাম বাড়ানোর মতো কাজ থেকে বিরত থাকে সরকার।

গ্যাসের মূল্য সহনশীল রাখতে চলতি অর্থবছরে এ খাতে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ছাড় দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। আমদানি ও সম্পূরক শুল্ক এবং মূল্য সংযোজন কর বাবদ এ ছাড় দিয়েছে সংস্থাটি। এত বিপুল পরিমাণ কর ছাড়ের পরও গ্যাসের দাম গড়ে ১০২ শতাংশ বৃদ্ধি করার প্রস্তাব দিয়েছে পেট্রোবাংলার অধীন বিতরণ কোম্পানিগুলো। গ্যাস খাতে এ অব্যাহতির ফলে চলতি অর্থবছর এনবিআর ১৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হবে। শিল্প-বাণিজ্য ও বিদ্যুৎ উৎপাদন নির্বিঘœ করতেই গ্যাসের ক্ষেত্রে এ ছাড় দেওয়া হয়েছে। মূলত এলএনজি আমদানির পর যেন গ্যাসের দাম না বাড়ে, মানুষকে যাতে দুর্ভোগ পোহাতে না হয়, এ লক্ষ্যেই বিপুল পরিমাণ কর ছাড় দেওয়া হয়েছিল।

বিতরণ কোম্পানিগুলোর গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর বাংলাদেশ এনার্জি লেগুলেটরি কমিশনের গণশুনানি সম্প্রতি শেষ হয়েছে। গণশুনানিতে ছয়টি বিতরণ কোম্পানি নতুন প্রস্তাবে সব শ্রেণির গ্যাসের দাম গড়ে ১০২ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে সার ও বিদ্যুৎ খাতে। বিদ্যুৎ খাতে গ্যাসের দাম আগের চেয়ে ২০৮ শতাংশ বাড়িয়ে প্রতি ঘনমিটার ৩ টাকা ১৬ পয়সা থেকে ৯ টাকা ৭৪ পয়সা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। সারের ক্ষেত্রে ২১১ শতাংশ বাড়িয়ে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ২ টাকা ৭১ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৮ টাকা ৪৪ পয়সা ও ক্যাপটিভ পাওয়ারের ক্ষেত্রে ৯৬ শতাংশ বাড়িয়ে ৯ টাকা ৬২ পয়সার পরিবর্তে ১৮ টাকা ৬৮ পয়সা করার প্রস্তাব দিয়েছে বিতরণ কোম্পানিগুলো। এছাড়া শিল্প খাতে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের বর্তমান দাম ৭ টাকা ৭৬ পয়সা থেকে ১৩২ শতাংশ বাড়িয়ে ১৮ টাকা ৪ পয়সা ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে ৪১ শতাংশ বাড়িয়ে ১৭ টাকা ৪ পয়সা থেকে ২৪ টাকা ৫ পয়সা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে গৃহস্থালির ক্ষেত্রে ৮০ শতাংশ বাড়িয়ে ৭৫০ টাকার স্থলে এক চুলায় ১ হাজার ৩৫০ টাকা এবং দুই চুলায় ৮০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার ৪৪০ টাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির ব্যাপারে পেট্রোবাংলা বলছে, এলএনজি আমদানি ব্যয়ের তুলনায় এনবিআরের করছাড় অপ্রতুল। তাই গ্যাসের দাম বাড়িয়ে সমন্বয় করা ছাড়া বিকল্প নেই। গ্যাসের এ অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হবে বলে মনে করেন দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীরা। তাদের মতে, নতুন করে গ্যাসের দাম বাড়লে ব্যবসায়ীরা গভীর সংকটে পড়বেন। শুনানির তৃতীয় দিনে অংশগ্রহণকারী বক্তারা বলেছেন, গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো প্রায় সবাই লাভ করছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বছরে কয়েক দফা বোনাস নিচ্ছেন। গ্যাস চুরি হচ্ছে; দুর্নীতি কমছে না। প্রকৃত গ্রাহকরা ঠিকমতো গ্যাস পাচ্ছেন না। মাস শেষে ঠিকই বিল দিতে হচ্ছে। এখন আবার গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে। মানসম্মত গ্যাসের সরবরাহ না পেলে ভোক্তারা কেন বাড়তি দাম দেবেন? নিজেদের দুর্নীতি পোষাতেই কর্মকর্তারা গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, গ্যাসের দাম বাড়লে পরিবহন, বিদ্যুৎ ও পণ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে সব খাতের ব্যয় বাড়বে। এ বাড়তি ব্যয়ের প্রতিটি পয়সা ব্যবসায়ীরা জনগণের কাছ থেকে পণ্য ও সেবার দাম বাড়িয়ে কড়ায়-গন্ডায় আদায় করে নেবেন। ফলে শেষ পর্যন্ত গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কা এসে লাগবে জনসাধারণের বুকে।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা বলেছেন, প্রস্তাবিত হারে গ্যাসের দাম বাড়লে একটি বস্ত্রকলও টিকে থাকতে পারবে না। এমনিতেই আমদানিকৃত বিদেশি সুতার সঙ্গে মিলগুলো প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না। তার ওপর গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি এ খাতকে কঠিন বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেবে। বর্তমানে প্রতি কেজি সুতা উৎপাদনে গ্যাসের মূল্য বাবদ খরচ করতে হয় ১১ টাকা ৭৬ পয়সা। প্রস্তাব অনুযায়ী গ্যাসের দাম বাড়লে এ ব্যয় বেড়ে ২৩ টাকা ৮০ পয়সার কাছাকাছি দাঁড়াবে। অন্যদিকে ইস্পাত উৎপাদনে গ্যাস ও বিদ্যুতের খরচ হয় সবচেয়ে বেশি। ব্যবসায়ীদের হিসাবে প্রতি টন রড উৎপাদনে ৭ হাজার টাকার মতো ব্যয় হয় জ্বালানি খাতে। প্রস্তাবিত হারে গ্যাসের দাম বাড়লে রড উৎপাদনে ব্যয় টনপ্রতি আরো ৭ হাজার টাকা বাড়তে পারে। বর্তমানে ভালো মানের প্রতি টন রড বিক্রি হচ্ছে ৬৫ থেকে ৬৭ হাজার টাকায়। প্রস্তাব অনুযায়ী গ্যাসের দাম বাড়লে প্রতি টন রডের দাম বেড়ে দাঁড়াবে ৭২ থেকে ৭৪ হাজার টাকা, যা আবাসন ও নির্মাণশিল্পকে গভীর সংকটে ফেলবে। পরিবহন ব্যবসায়ীরা বলেছেন, এলএনজি আমদানি করে দেশীয় গ্যাসের সঙ্গে মেশানোর আগে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম পড়ে ৩২ টাকা অথচ সিএনজির দাম প্রতি ঘনমিটার ৪০ টাকা, যা ৪৮ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে গোটা পরিবহন খাত অস্থির হয়ে পড়বে।

এখন দেশে মোট গ্যাস সরবরাহ হয় ৩২০ কোটি ঘনফুট, যার ৪০ শতাংশই বিদ্যুৎ খাতে ব্যবহৃত হয়। গ্যাসের দাম বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর দাবি তুলবে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। শেষ পর্যন্ত বিদ্যুতে দামের চাপ সাধারণ মানুষের ঘাড়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিদ্যুতের দাম বাড়লে তার প্রভাব শিল্প খাতেও পড়বে। প্রতি কেজি চিনি উৎপাদনে গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য বাবদ ব্যয় হয় ৫০ পয়সা। তেলের ক্ষেত্রে ৬০ পয়সা। গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে তার প্রভাব পড়বে ভোজ্যতেল ও চিনি উৎপাদনের ওপর।

বিতরণ কোম্পানিগুলো যা চায় বিআইআরসি সেভাবে দাম বৃদ্ধি করে না। বিতরণ কোম্পানিগুলোর চাওয়ার তুলনায় অনেক কম দাম বৃদ্ধি করে বিইআরসি। এতে বিতরণ কোম্পানিগুলো অসন্তুষ্ট হয়। আবার দাম বৃদ্ধিকে গ্রাহক ভালো চোখে দেখে না। ২০০৯ সালে বিতরণ কোম্পানিগুলো ৬৫ দশমিক ৯২ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দাম বেড়েছিল ১১ শতাংশ, ২০১৫ সালে ৪০ দশমিক দশমিক ৭৯ শতাংশ দাম বৃদ্ধির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২৬ শতাংশ, ২০১৭ সালে ৯৫ শতাংশের বিপরীতে ১১ শতাংশ বেড়েছিল এবং ২০১৮ সালে ৭৫ ভাগ দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব থাকলেও গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের দাম বাড়েনি।

তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানির ফলে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি মানুষের ভাবনার মধ্যে ছিল। কিন্তু বিতরণ কোম্পানিগুলোর গড়ে ১০২ ভাগ মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব অত্যন্ত অযৌক্তিক ও মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। এতে দেশের বিপুলসংখ্যক গ্রহীতা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের বিকাশমান শিল্প ও পরিবহন খাত। সেই সঙ্গে বাড়বে জনদুর্ভোগ। তাই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে রাজনীতিবিদ, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভোক্তাসাধারণের মতামতকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা উচিত।

লেখক : সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি)

নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস লিমিটেড, নাটোর

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close