মো. মাঈন উদ্দিন

  ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

আন্তর্জাতিক

কাশ্মীর ঘিরে পাক ভারত উত্তেজনা

জম্মু-কাশ্মীর ঘিরে ভারত-পাকিস্তানের দ্বন্দ্ব আজকের নয়। ভারত পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই এ এলাকা ঘিরে চলছে দুটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশের দ্বন্দ্ব। এরই মধ্যে কাশ্মীরে কয়েকদিন আগে ঘটে গেল এক ভয়াবহ হামলা। যাতে ভারতের ৪৯ জন আধা সেনা নিহত হয়েছে এবং আহত হয়েছে আরো অনেকে। এ ঘটনায় ভারত পাকিস্তানকে দুষছে আর পাকিস্তান নিজেরা এ ঘটনায় কোনোভাবেই জড়িত নয় বলে জানিয়ে দিয়েছে। এদিকে ভারতের পত্রিকাগুলোতে প্রতিশোধের বিভিন্ন খবরের পাশাপাশি এ ঘটনা কীভাবে ঘটল, তার বর্ণনা আসছে। কলকাতার বাংলা পত্রিকা ১৭ ফেব্রুয়ারি একটি খবর প্রকাশ করে। ওই পত্রিকার মতে, যেভাবে ঘটনাটি ঘটেছে তা মোটামুটি এ রকমÑ ১৯ বছরের একটি ছেলে কাঠ চেরাইকলে কাজ করত। ওই ছেলেটি হঠাৎ উধাও হয়ে গেল। ছয় মাস পর ফিরে এল জয়েশ-ই-মহম্মদের নতুন সিøপার সেল হয়ে। পেল পাকিস্তানের প্রশিক্ষণ। তার কাছে পৌঁছে দেওয়া হলো বিপুল পরিমাণ আরডিএক্স ও অন্য বিস্ফোরক। যে আরডিএক্স এসেছে বর্ডার ট্রেড রোড ধরে। যে পথে প্রতিদিনিই লঙ্কা, মসলা, সবজি, ড্রাই ফ্রুটস আসছে। জানা গেল না ঠিক কত দিন ধরে সেই বিপুল পরিমাণ আরডিএক্স মজুদ হয়েছিল চূড়ান্ত আক্রমণের জন্য। একা এক ১৯ বছরের তরুণ গাড়িতে ওই বিপুল আরডিএক্স নিয়ে অপেক্ষা করছিল হাইওয়ের উল্টোদিকে। ঘন ঘন কথা চলছিল জয়েশের কর্তাদের সঙ্গে। অথচ টের পেল না কেউ। কার্যত বিনা বাধাতেই ৭৮টি কনভয়ের আধা সেনা বাহিনীর আড়াই হাজারের বেশি জওয়ানকে সে একাই টার্গেট করল। তার গাড়ির ডানদিকে যেহেতু ওই আরডিএক্স বোঝাই করা হয়েছিল, তাই সে পেছন থেকে বাসের বাঁদিকে গিয়ে ধাক্কা মারল। যাতে সম্পূর্ণ আরডিএক্সটাই বিস্ফোরণ হয়। ঠিক পুলওয়ামার এ অংশে এ মাইলস্টোন নম্বর ২৭২-এর আশপাশে এর আগেও হামলা হয়েছে। ঠিক এ অংশে কিছুটা চড়াই রয়েছে। তাই যে কোনো গাড়িকেই স্পিড কমাতে হয়। সেই সুযোগ নিয়েছে পাকিস্তানের মদদপুষ্ট ওই জঙ্গি।

প্রতিবেদন মতে, দিল্লির সংসদ ভবনে আয়োজিত সর্বদলীয় বৈঠকে প্রশ্ন উঠেছে কেন সেনা ও আধা সেনা কনভয়ের সঙ্গে ওই রাস্তায় সিভিলিয়ান গাড়িও যেতে দেওয়া হয়েছে? এর উত্তরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কর্তারা বলেছেন, সাধারণ মানুষ ও পর্যটকদের যাতে অসুবিধা না হয়, সে কারণেই এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। স্বরাষ্ট্র সচিব বলেন, আবার ওই কঠোর নিয়ম ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। এদিকে পুলওয়ামার হামলা কেন ঠেকানো গেল না, সেই প্রশ্ন উঠেছে নিরাপত্তা বাহিনীর অন্দরেও। কারণ দুদিন আগেই কাশ্মীরের পুলিশের কাছে এসেছিল একটি ভিডিও। থ্রি ওয়ান থ্রি গেটÑ এ নামের একটি টুইটার অ্যাকাউন্টে ৩৩ সেকেন্ডের ওই ভিডিও আপলোড করা হয়। সেখানে দেখানো হয়েছে সোমালিয়ায় অবিকল এ একইভাবে একটি সেনা কনভয়ে হামলা হয়েছে। এ একই ধরনের হামলা ভারতে হতে পারে বলে স্পষ্ট ইঙ্গিত মিলেছিল। পাশাপাশি আইবিও জয়েশ হামলার কথাও বলেছিল। বলা হয়েছিল, আফজল গুরু ও মকবুল ভাটের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ওই হামলা হতে পারে। পাশাপাশি এ হামলার পেছনে যার মাথা কাজ করছে, সেই মাসুদ আজহারের নতুন রিক্রুট বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ রশিদ গাজি ৯ ডিসেম্বর যে ভারতে ঢুকেছে, সেটা কিছুদিনের মধ্যেই গোয়েন্দারা জানতে পারে। পুলওয়ামার অবন্তীপুরার স্থানীয় ছেলেকে দিয়ে এত বড় একটা হামলা ঘটিয়ে একসঙ্গে এতজন আধা সেনাকে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি জঙ্গিরা বুঝিয়ে দিয়েছে তারা এবার নতুন প্রবণতা চালু করেছে। শহীদ হচ্ছেন ভারতের জওয়ানরা। আর তাদের হত্যাকারীও কাশ্মীর থেকেই নিযুক্ত। এটাই চরম উদ্বেগজনক প্ল্যান!

ভারতের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কেও ওই পত্রিকায় একটি বর্ণনা পাওয়া যায়, ওই পত্রিকায় প্রতিবেদনে বলা হয়, এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে নিরপরাধ জওয়ানদের ওপর পাকিস্তানের বর্বরোচিত হামলার দ্রুত বদলা দেখতে চাইছে ভারতবাসী। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী সর্বত্র এ দাবি জোরদার হচ্ছে। আসমুদ্র হিমাচল কার্যত ফুঁসছে। পত্রিকাটির প্রতিবেদন মতে, সীমান্ত পারের সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্রকে উচিত জবাব দেওয়ার আগে তাই কূটনৈতিক সমর্থন জোগাড়ে সক্রিয় ভারত সরকার। আমেরিকাসহ বিশ্বের তাবড় শক্তিধর রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা হয়েছে। পাশাপাশি ওই শক্তিশালী দেশগুলোর রাষ্ট্রপ্রধানদের ব্যক্তিগত বার্তাও প্রধানমন্ত্রীর দফতরে এসে পৌঁছেছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য পাঁচ রাষ্ট্রকেই বলা হয় পি ফাইভ। আমেরিকা, রাশিয়া, ফ্রান্স, ব্রিটেন ও চীন। কূটনৈতিক সমীকরণে এরাই সর্বশক্তিধর। এরপর দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতদের ডেকে তাদের সঙ্গেও আলোচনা করা হয়েছে। পাশাপাশি যোগাযোগ হয়েছে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গেও। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ নিজে কথা বলেছেন আরব দুনিয়ার সঙ্গে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আফ্রিকার দেশগুলোর ভারতে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গেও দেখা করে। তবে আমেরিকা ও ইসরায়েলের সঙ্গে ভারতের স্ট্র্যাটেজিক সম্পর্ক সাম্প্রতিককালে সব থেকে জোরালো। ইসরায়েলে ভারতের ন্যাশনাল সিকিউরিটি গার্ডের এলিট কমান্ডো গ্রুপ নিয়মিত প্রশিক্ষণ নিতেও গেছে। আবার ডোনাল্ড ট্রাম্পের থেকে সবুজ সংকেত পেয়েই আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন ভারতকে জানিয়ে দিয়েছেন আমেরিকা পাশে আছে। ভারতের যেকোনো সিদ্ধান্তকেই তারা সমর্থন করে। একইভাবে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সরকারি বিবৃতির পাশাপাশি নরেন্দ্র মোদিকে ব্যক্তিগত বার্তাও পাঠিয়েছেন। বলেছেন, ইসরায়েল ভারতের যেকোনো সিদ্ধান্তেই সমর্থন করছে। আমেরিকা যে কঠোর সুরে পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হুশিয়ারি দিয়েছে, তা শুরু থেকেই চলেছে। সরকারি সূত্রের খবর ইতোমধ্যেই ৪৯টি রাষ্ট্র জানিয়েছে, ভারত যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে তাতেই তাদের সমর্থন রয়েছে। অন্যদিকে লাগাতার গত ৪৮ ঘণ্টা ধরে ভারত পাকিস্তানকে বিশ্বমঞ্চে কোণঠাসা আর একঘরে করে দিতেই সবথেকে বেশি সক্রিয় হয়েছে। এটাই বস্তুত স্ট্র্যাটেজি ভারতের। পাকিস্তানকে কড়া জবাব দেওয়ার আগে বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোকে পাশে নেওয়া। ভারত আন্তর্জাতিক দুনিয়াকে বার্তা দিতে চাইছে যে, এবারের নির্ণায়ক অভিযান নেহাতই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয়, বিশ্ব সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে। আমেরিকা, ইসরায়েল, জার্মানি, কানাডা, ব্রিটেন ও ফ্রান্স প্রত্যক্ষভাবে ভারতের সঙ্গে কথা বলে জানিয়েছে তারা পাশেই আছে। অন্যদিকে দিল্লিতে সর্বদলীয় বৈঠক ডেকে দেশের তাবড় রাজনৈতিক দলকেও একজোট হয়ে একসুরে সরকার ও সেনাবাহিনীর পাশে থাকার অঙ্গীকার করিয়ে নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। সংসদ ভবনে আয়োজিত ওই সর্বদলীয় বৈঠকে প্রতিটি দলই পাকিস্তানকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার কথা বলেছে। তবে অবশ্যই সরাসরি যুদ্ধের কথা উচ্চারণ করেনি কেউ। একমাত্র ব্যতিক্রম শিবসেনা। শিবসেনার প্রতিনিধি সঞ্জয় রাউথ বলেছেন, যুদ্ধ কোনো শেষ বিকল্প হতে পারে না। বরং আমাদের মতে, যুদ্ধই হলো একমাত্র অ্যাকশন। পাশাপাশি ততটাই স্পষ্টভাবে সমাজবাদী পার্টির সুরেন্দ্র নাগর বলেছেন, যুদ্ধ কখনো একমাত্র বিকল্প হতে পারে না। ন্যাশনাল কনফারেন্সের ফারুক আবদুল্লা সর্বদলীয় বৈঠকের মধ্যেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংকে বলেন, আমি কাশ্মীরের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে বলছি, উপত্যকার সব মানুষই পাকিস্তানপন্থি এটা ভেবে নেবেন না। আগে কাশ্মীর জয় করার চেষ্টা করুন। অন্যদিকে তৃণমূল, সমাজবাদী পার্টি ও কংগ্রেস সরকারকে চেপে ধরে সর্বসম্মত প্রস্তাবের ভাষা নিয়ে। সেখানে যেকোনো ব্যবস্থা গ্রহণে সবাই একমত এ রকম একটি বাক্য থাকায় তারা আপত্তি তোলে। তাদের দাবি, প্রধানমন্ত্রী প্রতিটি দলের নেতানেত্রীকে নিয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠক ডাকুন। সকলের সঙ্গে কথা বলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিন। তৃণমূলের পক্ষ থেকে ডেরেক ও ব্রায়ান এবং সুদীপ বন্দোপাধ্যায় গিয়েছিলেন। যদিও সর্বদলীয় বৈঠকে প্রতিটি দলই বলেছে সরকারের পাশে তারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আছে। পাশাপাশি জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল, রাজনাথ সিং এবং ইনটেলিজেন্স ব্যুরো, মিলিটারি ইনটেলিজেন্স কর্তাদের মধ্যে একটি বৈঠক হয়েছে রাজনাথ সিংয়ের বাসভবনে। সরকারি সূত্রের ইঙ্গিত, প্রস্তুতি প্রায় সম্পূর্ণ। গোটা বিশ্বকে পাশে নিয়ে এবার পাকিস্তানকে উচিত শিক্ষা দেবে ভারত। তারই কাউন্টডাউন শুরু হয়েছে! এ ছিল ওই পত্রিকার প্রতিবেদন। গত বছরও ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সীমান্তবর্তী উত্তেজনা হয়েছিল, যার ফল হিসেবে ভারত পাকিস্তানের সীমানার ভেতরে প্রবেশ করে কিছু জঙ্গি আস্তানা গুঁড়িয়ে দিয়েছিল এবং এতে পাকিস্তানের কয়েকজন সেনাও নিহত হয়েছিল। এখন কাশ্মীরের ঘটনায় নিশ্চিতভাবেই ভারত চাইবে প্রতিশোধ নিতে। এর জন্য কি তারা আবারও পাকিস্তান সীমান্ত অতিক্রম করতে চাইবে আর পাকিস্তানও চাইবে তাদের সীমান্ত ব্যুহ তৈরি করতে। এমন এক পরিস্থিতিতে এখানে কী ঘটছে বা ঘটে তা দেখার জন্য সারা বিশে^র নজর যে এখন কাশ্মীরে এসে স্থির হয়ে আছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

লেখক : প্রশাসনিক কর্মকর্তা, রেজিস্ট্রার দফতর

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close