কবির মোল্লা

  ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

পর্যালোচনা

সড়ক নিরাপত্তা ব্যাহত করছে গণপরিবহন

কোনো সমস্যা সমাধানের পথে যদি বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা বা ভাগ-বিভাগ থাকে, তবে সে সমস্যা সমস্যাই থেকে যায়, সহজে মীমাংসা হয় না। যেখানে স্বার্থবাদী লোকজন জনগণের ওপর সুযোগ নিতে চায়, সেখানে সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে দায়িত্বশীল হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। বর্তমান যুগে আমরা সবাই বহির্মুখী। শহরে বা গ্রামে আমরা ঘরে কতক্ষণই বা থাকি। বিভিন্ন কাজ উপলক্ষে ২৪ ঘণ্টার মধে প্রায় ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা বাইরে থাকি। বাইরে মানে রাস্তায় বা গাড়িতে বা বাসে অথবা রাস্তার পাশে কোন দোকানে। যেভাবে দুর্ঘটনা বাড়ছে, তাতে বাড়ির বাইরে কোথাও আমরা নিরাপদ নই। কারণ- ফিটনেসবিহীন গাড়ি, লাইসেন্স বিহীন অবৈধ চালক। চলছে নানা অসংগতি-অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, যাত্রী হয়রানি। এর অব্যাহত পরিণতি সাধারণ মানুষের মৃত্যু। প্রতিদিনই বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। একই সঙ্গে রয়েছে জনভোগান্তি। গণপরিবহনের নানা অসংগতি এখন দেশের প্রতিটি সাধারণ মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করছে।

ঢাকায় গণপরিবহন মালিক কর্তৃপক্ষ যাত্রীদের কথা খুব বেশি বিবেচনায় আনে বলে মনে হয় না। যাত্রীদের কাছ থেকে বেশি ভাড়া আদায়ের লক্ষ্যে তারা নানা ছল-চাতুরির আশ্রয় নিয়ে থাকে। এর মধ্যে একটি হলো সিটিং সার্ভিস। কোনো বাসের গায়ে লেখা স্পেশাল সার্ভিস, কম স্টপেজ সার্ভিস আবার কোনোটির গায়ে লেখা গেটলক, সিটিং সার্ভিস। অথচ যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বিআরটিএ বলছে, সিটিং সার্ভিসের কোনো নিয়ম নেই। এদিকে পরিবহন-সংক্রান্ত কমিটি সিটিং সার্ভিসের জন্য নীতিমালা প্রণয়নের সুপারিশ করলেও সিটিং সার্ভিসকে নিয়মের আওতায় আনা যায়নি।

বিভিন্ন সরকারের আমলে দেখা গেছে, একটি প্রভাবশালী মহল নানা ছল চাতুরির আশ্রয় নিয়ে যাত্রীসেবার নামে যাত্রী হয়রানি করে আসছে নানাভাবে। পত্র-পত্রিকা বা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের অসততার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করলে তারা সেই প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় চলে যায় ধর্মঘটে, ফলে যাত্রী হয়রানি বাড়ে আরও বহুগুণে।

গেল বছর সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ছাত্ররা মাঠে নেমেছিল। তার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চলন্ত বাস থামিয়ে যাত্রীদের কাছে হয়রানি বিষয়ে খোঁজখবর নিয়েছে। সে সময় যাত্রী হয়রানি সত্যিই অনেক কমে গিয়েছিল। তবে ১২ মাসতো আর পুলিশ দিয়ে শৃঙ্খলা রক্ষা করা যায় না। এজন্য এমন আইন করতে হবে, যেন গণপরিবহন মালিকরা তা মানতে বাধ্য থাকেন এবং যাত্রী হয়রানি লোপ পায়। এজন্য জাতীয়ভাবে মানসিকতা পরিবর্তন জরুরি। গণপরিবহন যে শুধু ব্যবসার জায়গা না, বরং এটি সেবা খাত, তা সেবাদাতাদের অনুধাবন করতে হবে। যাত্রীদের ভালো সেবা দিলে এমনিতেই মালিকরা মুনাফার মুখ দেখবেন। আর না হলে যাত্রীরা হয়রানির শিকার হয়েই থাকবেন।

নিয়ম না থাকলেও রাজধানীর বাসে হরহামেশাই চলে দাঁড়িয়ে যাত্রী পরিবহন। ফলে ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ যাত্রীরা। মহিলাদের জন্য সিট নেই এই অজুহাতে প্রায়ই মহিলা যাত্রীদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়। প্রকৃত ঘটনা হলো, একজন পুরুষ যাত্রীকে সহজে দাঁড় করে নেওয়া সম্ভব হলেও মহিলাদের ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয় না। আর এ কারণে মহিলা যাত্রীদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে ওই বাস যাত্রী পরিবহনের শর্ত ভঙ্গ করে সিটিং সার্ভিসে অনায়াসে দাঁড় করানো পুরুষ যাত্রী পরিবহন করে। যাত্রীরা অসহায়, নিজেদের গন্তব্যে পৌঁছতে তাই তাদের গণপরিবহন মালিক ও তাদের কর্মচারীদের আচরণ মেনে নিতে হয়।

সিটিং সার্ভিসের নামে বাড়তি ভাড়া নেওয়া হলেও যাত্রীসেবার মান বাড়ায়নি কোনো পরিবহনই। এ ক্ষেত্রে সাধারণত মালিকরা বাসকে একটু রং করেই এর সেবা বৃদ্ধির নামে ভাড়া বাড়িয়ে নেন। প্রকৃত অর্থে অভ্যন্তরীণ সুযোগ সুবিধা কিছুই বাড়ানো হয়না। বেশির ভাগ সিটিং সার্ভিস বাসে ফ্যানের কোনো ব্যবস্থা নেই। এক সিটের চেয়ে অন্য সিটের দূরত্ব কম। থামানো হয় যত্রতত্র। জানালা ও আসন থাকে ভাঙাচোরা। তেমনি যাত্রী তোলা ও নামানো হয় যেখানে-সেখানে। বাসের সিটে থাকে ছারপোকার দৌরাত্ম্যও। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাস থাকে লক্কড়-ঝক্কড়। তাছাড়া পুরুষদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাসে উঠতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েন নারী যাত্রীরাও।

বিআরটিএ পরিচালক শেখ মাহবুব ই রব্বানী বছর দুই আগে বলেছিলেন, আমরা সিটিং সার্ভিস চালু রাখার সুপারিশ করেছি। তবে সিটিং ও নন-সিটিং গাড়ির রং আলাদা করতে হবে। মানুষ যেন দূর থেকে দেখলেই বুঝতে পারে গাড়ি সিটিং কিনা। পাশাপাশি সিটিং সার্ভিসের ভাড়া ও রুট নির্ধারণ করতে হবে। কিন্তু গত প্রায় দুই বছরে চূড়ান্ত হয়নি সিটিং সার্ভিস নীতিমালা। কবে চূড়ান্ত হবে তা-ও নিশ্চিত করে বলা যায় না। এরই মধ্যে নীতিমালা ঘোষণার জন্য অন্তত তিনবার সময় নেওয়া হয়। এই সুযোগে পরিবহন কোম্পানিগুলো যেমন খুুশি ভাড়া আদায় করছে। গণপরিবহন সেক্টরে নৈরাজ্য এড়াতে দ্রুত সময়ের মধ্যে এ ব্যাপারে সরকারি সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন।

বিআরটিএর পরিচালক (রোড সেফটি) মাহবুব-ই-রব্বানীকে আহ্বায়ক করে গঠিত কমিটি সিটিং সার্ভিসের অনিয়ম বন্ধে ২৬টি সুপারিশ করে। এগুলোর মধ্যে রুট পুনর্বিন্যাস করে ঢাকা শহরের সব বাসকে নির্দিষ্ট কয়েকটি কম্পানির নিয়ন্ত্রণে চলাচলের ব্যবস্থা, রুট ফ্র্যাঞ্চাইজিং পদ্ধতিতে গণপরিবহন ব্যবস্থা প্রবর্তন করার কথা রয়েছে। এছাড়া ভাড়া নৈরাজ্য, যাত্রী হয়রানি ও একচেটিয়া ব্যবসা ঠেকাতে প্রাইভেট অপারেটরদের অনুকূলে নতুন করে রুট পারমিট দেওয়া বন্ধ রেখে বিআরটিসির মাধ্যমে অধিক সংখ্যক নতুন দ্বিতল বাস চালু, প্রয়োজনে আন্ত জেলা থেকে প্রত্যাহার করে ঢাকা সিটিতে স্থানান্তরের সুপারিশ করা হয়। কিন্তু সুপারিশগুলোর বাস্তবায়ন হয়নি একটিও।

গণপরিবহনে সিটিং সার্ভিস নামে আলাদা কোনো সেবার কথা বলা নেই। তবু যাত্রীদের কাছ থেকে বেশি টাকা নেওয়ার জন্য সিটিং সার্ভিসের নামে ব্যবসা চলছে। রাজধানীর প্রায় ৮৭ শতাংশ গণপরিবহন যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ নিয়ে থাকে। সিটিং সার্ভিসের নামে নানা অনিয়ম চললেও এটির সুরাহা নেই। যত দূর জানি, বাস মালিকরা সরকারের নীতিনির্ধারকদের চাপে রাখেন। এর ফলে শক্ত ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। যারা সিটিং সার্ভিস পরিচালনা করছেন, তারা সরকার নির্ধারিত ভাড়া বা সর্বনিম্ন ভাড়া কিছুই মানেন না। নামমাত্র কিছু বাসে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা থাকলেও তা অনুসরণ করা হয় না। বিভিন্ন বাস কম্পানি তাদের পরিবহনের জন্য কোম্পানি প্রণীত ভিন্ন ভিন্ন ভাড়ার চার্ট অনুসরণ করে ভাড়া আদায় করছে। এসব সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন সময়ে সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু ওই

আশ্বাস শুনেছি, পদক্ষেপ নেই। কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান গণপরিবহনের নির্ধারিত ভাড়া কার্যকর করতে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। এছাড়া রুট, স্টপেজ নির্ধারণ করে যাত্রী দুর্ভোগ কমাতে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।

বিরাজমান পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা দিচ্ছেন বিভিন্ন ব্যবস্থাপত্র। এরমধ্যে চালকদের ন্যূনতম শিক্ষা, তাদের প্রশিক্ষণ, ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি রাস্তায় নিষিদ্ধকরণ, ট্রাফিক পুলিশের দুর্নীতি বন্ধকরণ, অতিরিক্ত মাল এবং অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই। দোষী মালিক এবং শ্রমিকদের আইনের আওতায় আনতে হবে। চলন্ত অবস্থায় মোবাইল ফোন নিষিদ্ধ। করতে হবে, জেব্রাক্রসিং এবং স্পিড বেকার যথাযথ স্থানে দিয়ে, তা মানাতে হবে। সব জায়গায়। গুরুত্বপূর্ণ স্থানের ফুটপাথ দখলমুক্ত করতে হবে।

সমস্যা তো চিহ্নিত করা গেছে কিন্তু তার সমাধান কি এতো সহজে পাওয়া যাবে? কারণ সমস্যা যেমন বহুমুখী তেমনি সমাধানও সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সদিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। এর অনেকগুলি সমস্যা সৃষ্টির ক্ষেত্রে আবার সরকারের বিভিন্ন সংস্থার লোকজনও জড়িত। মালিক, পরিবহন শ্রমিক, ফুটপাথ

দখলকারী, আইন প্রয়ােগকারী সংস্থা এবং সাধারণ মানুষ দিনের শেষে সবাই কিন্তু যাত্রী অথবা পথচারী। বিপদ সকলের জন্যই সমান।

লেখক : কানাডার মন্ট্রিয়েল প্রবাসী

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close