ইয়াসমীন রীমা

  ২২ জানুয়ারি, ২০১৯

পরিচর্যা

শাক-সবজিতে শিশুস্বাস্থ্য

চার্লস ডিকেন্স বলেছিলেন, ‘পৃথিবীতে প্রত্যেক নবজাতকের অবয়ব পূর্ববর্তী শিশুর জন্মের চেয়ে আলাদা এবং সুন্দর।’ শিশু যে কেবল আনন্দের বিষয় তা নয়, তার মধ্যেই বেঁচে থাকে পরবর্তী প্রজন্ম। আমাদের দেশে ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কিছু পরিচিত রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়। সর্দি-কাশি, ভাইরাশ জ্বর, টনসিলের প্রদাহ, শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহ, অ্যাজমা ছাড়া হাত-পা ফেটে যাওয়া, মুখে-জিহ্বায় ঘা, বিভিন্ন চর্মরোগের মধ্যে খাউজ, পাঁচড়া ইত্যাদি। বয়স্কদের চেয়ে শিশুদের সর্দি-কাশি, ভাইরাস জ্বর, নিউমোনিয়া, টনসিলের প্রদাহ ইত্যাদি বেশি হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে অভিভাবকদের অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যে, এ থেকে কোনো অবস্থায়ই রোগটি যাতে জটিল আকার ধারণ করতে না পারে। শিশুদের বাবা-মায়েরা যদি সঠিক সময়ে সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং শিশুস্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হন, তবে প্রতিরোধ সম্ভব হয়ে ওঠে।

মাতৃগর্ভ থেকেই সাধারণত একটি শিশুর অপুষ্টি শুরু হয়। গর্ভবতী মায়ের যতœ নেওয়া মানেই গর্ভে ধারণকৃত শিশুরও যতœ নেওয়া। গর্ভবতী মা যদি ঠিক সময়ে স্বাস্থ্য পরিচর্যা করে অথবা পুষ্টিসম্মত খাবার গ্রহণ করেন; তাহলে বেশির ভাগ সময় আশা করা যায় গর্ভস্থ শিশু স্বাভাবিক ওজন ও স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার মতো পুষ্টিমাত্রা নিয়ে জন্ম নেবে। বর্তমানে দেশের অনূর্ধ্ব পাঁচ বছর বয়সের ৫৬ ভাগ শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে।

পুষ্টিবিশেষজ্ঞদের মতে, মানুষের দেহের জন্য জরুরি পুষ্টি উপাদান মূলত ছয়টি। যেমনÑ প্রোটিন বা আমিষ, শর্করা, স্নেœহ বা চর্বি, ভিটামিন, খনিজ লবণ ও পানি। সুস্থ দেহের জন্য সব রকম পুষ্টি উপাদানেরই পরিমিত পরিমাণে প্রয়োজন। এ ছয়টি উপাদানের মধ্যে প্রোটিন একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। দেহের ক্ষয়পূরণ ও বৃদ্ধি সাধনের জন্য প্রোটিন জাতীয় খাবার গ্রহণ করা একান্ত জরুরি। বিশেষ করে বাড়ন্ত শিশুদের।

খনিজ পদার্থ ও ভিটামিনের অভাবে শরীরে প্রাণশক্তি থাকে না। শরীরকে সুস্থ রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে খাদ্যের ভিটামিন উপাদানটি। খনিজ পদার্থ ও ভিটামিন আমাদের প্রতিদিনের খাবারের ভেতর থেকে পাওয়া যায়। একটু সচেতন ও সাধ-ইচ্ছা থাকলে অতি অল্পতে খনিজ পদার্থ ও ভিটামিন-সমৃদ্ধ খাবার পাওয়া যায় নাগালেই। এসব খাবার মূল্যের দিক দিয়ে শহরে বেশি হলেও গ্রামাঞ্চলে তা সাধ্যের মধ্যেই থাকে। তাছাড়া উদ্যোগীরা নিজ বাড়ির আঙিনায় বা ঘরের চারপাশে কিয়ৎ পরিমাণ জায়গা থাকলে ভিটামিন-সমৃদ্ধ সবজি সহজেই ফলাতে পারেন। এ ধরনের সবজি গৃহিণীরা গৃহস্থালি কাজের অবসরে করতে পারেন।

এ সবজিগুলোর ভেতর যেসব শাকসবজি সহজে এবং তুলনামূলক কম যতেœ অল্প জায়গায় জন্মানো যায়, তার ভেতর কচু, কলা, লাউ, মিষ্টি ও চাল কুমড়া, উচ্ছে বা করলা, কাঁকরোল, ঝিঙা, চিচিঙ্গা, ধুন্দুল, শসা, শিম ও বরবটির পুষ্টিগুণ অধিক। শরীর গঠন ও প্রাণশক্তির জন্য এসব শাকসবজি নিয়মিত গ্রহণ করলে শরীরকে করে মজবুত ও সতেজ। টাটকা শাকসবজি ও ফলমূল ভিটামিন সির উৎকৃষ্ট উৎস। এ দেশের সস্তা ও সহজলভ্য ফলগুলোর মধ্যে আমলকী, পেয়ারা, বাতাবিলেবু, আমড়া, পাতিলেবু ও কাগজিলেবু, কামরাঙা, কুল, জলপাই ইত্যাদিতে যথেষ্ট পরিমাণে ভিটামিন সি অন্তর্নিহিত থাকে। অথচ অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের কারণে এসব দেশীয় সহজলভ্য ভিটামিন সি ও অন্যান্য পুষ্টি-সমৃদ্ধ ফল ও শাকসবজি অবহেলা করে স্বল্প পুষ্টিযুক্ত বিদেশি দামি ফল আঙ্গুর, নাশপাতি, আপেল, কমলার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে বেশি।

পুষ্টিহীন শিশুর দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। ফলে নানা রকম রোগ তার দেহে দেখা দেয়। অপুষ্টির কারণে শিশুদের রাতকানা, অন্ধত্ব, চর্মরোগ, ম্যারাসম্যাস, কোয়াশিয়কর, বেরিবেরি, মুখ ও ঠোঁটের কোণে ঘা, স্কার্ভি, রক্তস্বল্পতা প্রভৃতি। ভিটামিন ‘এ’-এর অভাবে আমাদের দেশে প্রতি বছর ৩০ হাজারেরও বেশি শিশু অন্ধ হয়ে যায় এবং ১০ লাখ শিশু রাতকানা রোগে আক্রান্ত হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশের শিশুদের বিভিন্ন প্রকার অপুষ্টির মধ্যে ভিটামিন ‘এ’-এর অভাবজনিত অন্ধত্ব একটি অন্যতম জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত। পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে, শিশুর দেহ সুস্থ রাখার জন্য দৈনিক ১৫০০ আইইউ, ভিটামিন এ ৯-১২ বছরের ছেলে ও মেয়ের জন্য প্রতিদিন ৪৫০০ আইইউ এবং ১২ বছরের ঊর্ধ্বে ছেলে ও মেয়েদের জন্য দৈনিক ৫০০০ আইইউ, ভিটামিন এ প্রয়োজন। উদ্ভিদ জগৎ থেকে সরাসরি ভিটামিন ‘এ’ পাওয়া যায় না। শাকসবজির পচনশীলতা অনেক কম, তাই সহজে সংরক্ষণ করা যায় এবং ভিটামিন ও অন্যান্য পুষ্টিগুণ ঠিক থাকে দীর্ঘ সময়।

বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ জনগোষ্ঠী অর্থাৎ ৮ কোটি ৪০ লাখ লোক আয়োডিনের অভাবে ভুগছে। ছয় লাখ লোক স্নায়ুর মারাত্মক ত্রুটিজনিত সমস্যায় আক্রান্ত। আক্রান্তের বেশির ভাগ শিশু। বিদেশি খাবারে নয়, শাকসবজি ও কম মূল্যমানের দেশি ফলমুুল গ্রহণের মাধ্যমে শিশুর সুষম খাদ্যের অভাব দূর করা যায়। প্রয়োজন শুধু এ সম্পর্কে সচেতনতা এবং শাকসবজি খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা। আর এ শাকসবজি ও ফলমূল একটু পরিশ্রমেই নিজেদের বাড়িতেই উৎপাদন করতে পারি। দেহের হাড়, দাঁত শক্ত হওয়ার জন্য ভিটামিন ডির প্রয়োজন আর এই ডি ভিটামিন প্রচুর পরিমাণ পাওয়া যায় পালংশাকে। তাছাড়া কচুশাক, লালশাক, ডাটাশাক, পুঁইশাক, কাঁচাকলা যাবতীয় লৌহ-সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণে অপুষ্টিজনিত রক্তশূন্যতা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

দেশব্যাপী অপুষ্টির এ ক্রমবর্ধমান আক্রমণকে প্রতিরোধ করতে এ বিষয়ে জনসচেতনতা গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। অপুষ্টি দূর করে জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন কর্মসূচি। ইউনিসেফ এবং সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় যৌথ উদ্যোগে চালু করেছে সামাজিক পুষ্টিকেন্দ্র। এসব পুষ্টিকেন্দ্র থেকে স্বাস্থ্য কর্মীদের মাধ্যমে শিশু, নারী গর্ভবতী ও স্তনদাত্রী মায়েরা উপকৃত হচ্ছেন বিভিন্নভাবে। এসব কর্মকান্ডের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে দেশ থেকে অপুষ্টি চিরতরে দূর করা। বাংলাদেশের শিশুদের শতকরা ৫০ ভাগ স্বল্প ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করে; যা অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। শতকরা ৯০ ভাগ শিশু কোনো না কোনোভাবে পুষ্টিহীনতার শিকার। তা সত্ত্বেও আগের তুলনায় বর্তমানে শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস পেয়েছে। শিশুরোগ সমন্বিত ব্যবস্থাপনা (আইএমসিআই) প্রত্যেকের পারিবারিক জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের প্রতি গুরুত্বারোপ করে আসছে। নিয়মিত সুষম খাদ্যাভ্যাস ও সুষ্ঠু পরিচর্যা শিশুর সুস্থ শরীর গঠনে সহায়তা করে এবং একই সঙ্গে শিশুকে রোগাক্রান্ত হওয়া থেকে রক্ষা করে। তাই প্রতিটি পরিবারের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন করা প্রয়োজন। আইএমসিআই এ কারণে স্বাস্থ্য কর্মীদের মাধ্যমে প্রত্যেক পিতামাতাকে সচেতন করে তোলে। যাতে সন্তানের রোগ প্রতিরোধে তারা কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেন।

শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ পুষ্টির সঙ্গে জড়িত। শিশুরাই দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধার। ভবিষ্যতের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য এখন থেকেই এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ করতে হবে। তাই একটি বলিষ্ঠ জাতি গঠনের লক্ষ্যে শিশুর যতেœ আমাদের সবাইকে হতে হবে সচেষ্ট।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গবেষক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close