রাহাত হুসাইন

  ০৫ জানুয়ারি, ২০১৯

বিশ্লেষণ

চিন্তার সংকীর্ণতা দূর করতে হবে

স্বাধীনতার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশ আজ উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় এগিয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রের উন্নয়নের পাশাপাশি এখন রাষ্ট্রের নাগরিকদের মানবিক মূল্যবোধের উন্নয়ন প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রে ডিজিটাল এবং স্মার্ট হলেও চিন্তার ক্ষেত্রে স্মার্ট হতে পারেনি দেশের জনগণ। সমাজে এখনো যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হচ্ছে গৃহবধূ। নারী ও কন্যা শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। ধর্মের নামে সন্ত্রাসবাদ (জঙ্গিবাদ), ধর্মের দোহাই দিয়ে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, মাদক ও দুর্নীতি, নদী দখল, খাদ্যে ভেজাল, নকল পণ্য দেওয়া, যত্রতত্র ময়লা ফেলা, ঝাড়ফুঁঁক দেওয়ার মতো কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনি আমরা।

এসব অসামাজিক কর্মকা- থেকে বেরিয়ে আসতে হলে প্রতিটি নাগরিকের মাঝে সচেতনতা ও চিন্তার বিপ্লব ঘটাতে হবে। চিন্তার বিপ্লব ছাড়া অসামাজিকতা ও হিং¯্রতা থেকে মুক্তি আসবে না। সম্প্রীতি ও মানবিক রাষ্ট্র গড়তে চাইলে প্রতিটি নাগরিকের চিন্তার জগতে পরিবর্তন আনতে হবে। চিন্তার সংকীর্ণতা দূর করতে হবে। দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। চিন্তা নায়করাই ঘুণে ধরা সমাজটাকে বদলাতে পারে। আপনার-আমার, আমাদের সবার নোংরা মানসিকতার জায়গা থেকে সরে আসতে হবে। সংস্কৃতিচর্চা বাড়াতে হবে। প্রতিটি অপরাধের ব্যাপারে সোচ্চার হতে হবে। দেশের কোথাও কোনো নারী নির্যাতন বা অন্যায়ের শিকার হলে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে না থেকে প্রতিবাদ করতে হবে। আজ হয়তো আপনার সামনে অন্যের মেয়ে, অন্যের বোন বা স্ত্রী অন্যায় বা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, প্রতিবাদ করছেন না। কাল হয়তো অন্যের সামনে আমারÑ আপনার, মা, মেয়ে বা স্ত্রী কিংবা বোন নির্যাতন হলে সেও ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকবে। বরং এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে সেলফোন বের করে নির্যাতনের দৃশ্য ভিডিও ধারণ করবে। কোথাও কোনো অন্যায়-অপ্রীতিকর ঘটনা দেখলে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা কিংবা ভিডিও ধারণ করার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। অন্যায়ের প্রতিবাদে শামিল হতে হবে।

আর আধুনিক যুগে এসেও যদি যৌতুকের জন্য গৃহবধূকে নির্যাতন করা হয়। তাহলে তো ধরে নিতে হবে আমরা পড়ালেখা

করে নিজ মননকে আলোকিত করতে পারিনি। শিক্ষা

গ্রহণ করেছি শুধু সার্টিফিকেট অর্জন করার জন্য। সুশিক্ষিত হওয়ার জন্য নয়। যৌতুক দেওয়া-নেওয়ার বিষয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। আমি যৌতুক নেব না, আমি যৌতুক

দেবও না। খেয়াল রাখবেন আপনার সংসারে অন্যের

মেয়ে-বোন যতটুকু ভালো থাকবে। আপনার মেয়ে বা বোনও অন্যের সংসারে ততটুকু ভালো থাকবে। কথায় আছে যেমন কর্ম তেমন ফল।

দিন দিন ধর্ষণের পাল্লা ভারী হচ্ছে। নারীকে ধর্ষণ কিংবা ধর্ষণ করার পর হত্যা কোনোটাই কাম্য নয়। ধর্ষিতাকে নিয়ে উপহাস না করে, নির্যাতিতা মেয়েটির পরিবারের পাশে সবাইকে সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করতে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। ধর্ষণকারীরা হচ্ছে এক প্রকার মানসিক বিকারগ্রস্ত। এদের থেকে আমাদের সমাজটাকে নিরাপদ রাখতে হলে ধর্ষণকারীদের বিরুদ্ধে সচেতন পুরুষদের জোরালো প্রতিবাদ করতে হবে। প্রত্যেকটা মানুষের মাঝে মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। নারীকে পণ্য নয় মা, বোন ও মেয়ে হিসেবে ভাবতে হবে। নারীর প্রতি মানসিক, শারীরিক যে কোনো ধরনের সহিংসতা, যৌন হয়রানি দেখলেই প্রতিবাদের আওয়াজ তুলতে হবে।

ধর্মের নামে সন্ত্রাসবাদ কিংবা জঙ্গিবাদ যে নামেই বলি না কেন কোনো ধর্মই অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যাকে উৎসাহিত করে না। ধর্মের নামে মানুষ হত্যা করলে ধর্মের ক্ষতিই সবচেয়ে বেশি হয়। যে ধর্মের নামে মানুষ হত্যা করা হয় সে ধর্মের প্রতি মানুষের বিরূপ ধারণা জন্মায়। সে ধর্মকে ধর্ম নয় সন্ত্রাসবাদের হাতিয়ার বলেও প্রচার করা হয়। মুষ্টিমেয় কিছু লোক নিজ স্বার্থে ধর্মকে সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গিবাদের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছে। মূলত এরা ধর্মকেও ভালোবাসে না। সৃষ্টির সেরা জীব মানুষকেও নয়। মানুষই যদি না থাকে তাহলে ধর্মের কথা শোনাবে কাকে। আসলে তাদের উদ্দেশ্য ধর্মের উপকার করা নয়। দেশের তরুণ সমাজকে বিপদগ্রস্ত করা। দেশকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা। তারা চায় না আমাদের দেশের তরুণরা সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ থাকুক। দেশকে ভালোবাসুক। দেশের মানুষকে ভালোবাসুক।

জঙ্গিবাদের মোকাবিলা কিংবা বিস্তার রোধে আমাদের তরুণদের সচেতন হতে হবে। জঙ্গি-সন্ত্রাসমুক্ত দেশ গড়ার লড়াইয়ে

নিজেকে শামিল করতে হবে। আশপাশের বন্ধু-বান্ধবের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে যাতে কারো বন্ধু-বান্ধব

জঙ্গিবাদের জালে জড়িয়ে না পড়ে। পাড়ার কিংবা মহল্লার ছোট ভাইদের প্রতিও খেয়াল রাখতে হবে। সবচেয়ে বড় কাজ হচ্ছে নিজ পরিবারের ভাই-বোনদের বিষয়ে সচেতন হওয়া। তাদের কোনো আচরণ সন্দেহজনক মনে হলে খোলামেলা কথা বলে বিষয়টি সমাধান করা। বিয়ে-শাদিসহ প্রতিটা

সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে পরিবারের সবাইকে নিয়ে অংশগ্রহণ করা। সংস্কৃতির চর্চা করা।

মাদক আর দুর্নীতি হচ্ছে একটি সামাজিক ব্যাধি। একজন মাদকাসক্তই একটি পরিবারকে ধ্বংসের জন্য যথেষ্ট। অপরদিকে একজন দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তি সমাজটাকে আঙুল বানিয়ে নিজে হয় কলা গাছ। অন্যায়ভাবে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে। ডিজিটাল যুগে এসেও এই ব্যাধি দূর হয়নি। এই ব্যাধিকে এখনই রোধ করতে রাষ্ট্রকে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পাশাপাশি রাষ্ট্রের সব নাগরিকের সচেতন হতে হবে। দুর্নীতি ও মাদের ভয়াবহতার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে। দায়িত্ব নিয়ে নিজ নিজ পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্রকে মাদক ও দুর্নীতিমুক্ত রাখতে হবে। দুর্নীতিবাজ ও মাদক ব্যবসায়ীদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। অমুক দুর্নীতিবাজ তমুক দুর্নীতিবাজ বললেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। দুর্নীতি আর মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের আওয়াজটা জোরালো করতে হবে।

আমাদের আরো সচেতন ও চিন্তা করতে হবে। যাতে আমার দ্বারা খাদ্যে ভেজাল বা নকল পণ্য দেওয়া না হয়। যত্রতত্র ময়লা আবর্জনা ফেলে পরিবেশ নোংড়া ও ক্ষতিগ্রস্ত করা না হয়।

আপনি আজ খাদ্যে যে ভেজাল মিশ্রণ করছেন। ভেবে

দেখেছেন কি সেই ভেজাল মিশ্রিত খাদ্য খেয়ে

আপনার বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তান, ভাই-বোন কিংবা অন্যান্য আত্মীয় স্বজন রোগবালাইয়ের শিকার হচ্ছে কি না। ধরুন আপনি ফরমালিন দিচ্ছেন মাছে। আপনি মাছ খান না। অপর একজন ফরমালিন দিচ্ছে শাক-সবজিতে। উনি শাক-সবজি খায় না। আপনি শাক-সবজি খেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আর উনি আপনার মাছ খেয়ে এভাবে উভয়ে উভয়ের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি আমরা। পুরো জাতিই এভাবে ফরমালিন খেয়ে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ছি। আসুন একটু চিন্তা করি পুরো জাতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করার মধ্য দিয়ে আপনি-আমিও ক্ষতিগ্রস্তের তালিকায় রয়ে যাচ্ছি কি না?

যত্রতত্র ময়লা ফেলে এবং নদী দূষণ করে আমরা আমাদের পরিবেশ নষ্ট করছি। পরিবেশ দুর্গন্ধময় করে তুলছি। বেঁচে থাকার জন্য আবার নষ্ট পরিবেশের অক্সিজেন গ্রহণ করছি। কি অদ্ভুত অভ্যাস আমাদের। এগুলো থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। পরিশেষে এ কথা বলতে চাই, চিন্তায় স্মার্ট বা চিন্তার জায়গায় আলোকিত করতে না পারলে সব অগ্রযাত্রাই পিছিয়ে পড়বে।

লেখক : কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close