গাজী সানাউল্লাহ রাহমানী

  ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৮

ধর্ম

ইসলামে মেহেদি ব্যবহার

মেহেদি বা এর রং ব্যবহার বিষয়ে আমাদের সমাজে নানা ধারণা চালু আছে। কেউ কেউ মনে করেন, পায়ে মেহেদি দেওয়া যায় না। এটা ভুল ধারণা। ইসলাম নারীদের মেহেদি ব্যবহারে সম্পূর্ণরূপে অনুমতি প্রদান করেছে। শুধু তাই নয়, স্বামীর মনোরঞ্জনের জন্য স্ত্রীকে সজ্জিত হতে ইসলাম উৎসাহ প্রদান করেছে।

বর্তমান সমাজে মেহেদির ব্যবহার ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। অনুষ্ঠান আয়োজন উপলক্ষেও আমাদের মাঝে মেহেদি ব্যবহারের বেশ প্রচলন আছে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই নানা সময় নানা কাজে মেহেদি বা তার রং ব্যবহার করছেন। নারীরা হাতে, পায়ে অথবা চুলের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য মেহেদির রং বেছে নিচ্ছেন। পুরুষরাও চুল ও দাড়ির অকালপক্বতা রোধে কিংবা সৌন্দর্য হিসেবে মেহেদি ব্যবহার করছেন। প্রশ্ন হলো, মেহেদি বা এর রং ব্যবহারে ইসলামী শরিয়াহর নির্দেশনা কী?

বহুল আলোচিত এ বিষয়টিতে শরিয়াহ বিশেষজ্ঞদের বেশ কয়েকটি

অভিমত পাওয়া যায়। তবে এ বিষয়ে সবাই একমত যে, নারীদের জন্য মেহেদি ব্যবহারে কোনো রূপ বিধিনিষেধ নেই। তবে মনে রাখতে হবে, সর্বাবস্থায় মাহরাম

নয়, এমন পুরুষের সামনে যাওয়া নারীদের জন্য নিষিদ্ধ। নারীরা হাতে, পায়ে কিংবা চুলের সৌন্দর্য বাড়াতে মেহেদি ব্যবহার করতে পারবেন। হাদিসে এসেছে, এক মহিলা হযরত আয়শা (রা.)-এর কাছে মেহেদি লাগানো বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি জবাবে বলেন, এতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু রাসুল (সা.) মেহেদির ঘ্রাণ অপছন্দ করতেন। সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ৪১৬৪

এবার আসা যাক পুরুষের মেহেদি ব্যবহারের বিষয়ে। ইসলামী শরিয়াহ বিশেষজ্ঞদের মতে, পুরুষের জন্য মেহেদি ব্যবহার সম্পূর্ণ হারাম। ছেলে বাচ্চাদের জন্যও এটি নিষিদ্ধ। আবু হুরাইরাহ (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, পুরুষের সুগন্ধি এমন হবে যার সুগন্ধ প্রকাশ পায় কিন্তু রং গোপন থাকে এবং নারীর সুগন্ধি এমন হবে যার রং প্রকাশ পায় কিন্তু সুগন্ধ গোপন থাকে।

তিরমিজি, হাদিস ২৭৮৭

হাতে বা পায়ে সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য পুরুষদের মেহেদি ব্যবহার করার অনুমতি নেই। তবে কোনো কোনো শরিয়াহ বিশেষজ্ঞের মতে, চিকিৎসার পথ্য হিসেবে পুরুষের জন্য মেহেদি ব্যবহারের অনুমতি আছে। পুরুষরা চাইলে মাথায় খেজাব ব্যবহার করতে পারবে। শরিয়াহ এটি সমর্থন করে। রাসুলে আকরাম (সা.) বলেন, ইহুদি খ্রিস্টানরা যেহেতু খেজাব ব্যবহার করে না তাই তোমরা খেজাব ব্যবহার করে। বুখারি, ২:৮৭৫, বাবুল খেজাব। আবু দাউদ, ২: ৫৭৮, বাবুন ফিল খেজাব

মক্কা বিজয়ের পর হযরত আবুবকর সিদ্দিক (রা.)-এর পিতা হযরত আবু কোহাফা (রা.) যখন রাসুল (সা.)-এর সামনে এলেন তখন তার চুল-দাড়ি সব একেবারে ধবধবে সাদা অবস্থায় ছিল। তখন নবীজী তাকে বললেন, কালো ছাড়া অন্য কোনো রঙের খেজাব ব্যবহার করো। এ ছাড়াও হযরত আবুবকর ও হযরত ওমর (রা.) খেজাব ব্যবহার করেছেন মর্মে হাদিসে আলোচনা পাওয়া যায়। রাসুল (সা.) নিজে খেজাব ব্যবহার করেছেন কি না, এটি নিয়ে হাদিস ব্যাখ্যাতাদের মতভেদ আছে। যেহেতু দুজন বিখ্যাত সাহাবি ও ইসলামের অন্যতম খলিফা থেকে খেজাব ব্যবহার করার বিষয়টি প্রমাণিত তাই এই বিষয়ের ওপর আমল করতে আর কোনো সমস্যা নেই।

খেজাব ব্যবহার করার ক্ষেত্রে মূলনীতি হলো, জাফরান রঙের খেজাব ব্যবহার করা। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) জাফরান রঙের খেজাব ব্যবহার করেছেন বলে প্রমাণিত আছে। তবে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে একটি বর্ণনা পাওয়া যায়, যেখানে এসেছে, রাসুলে আকরাম (সা.) মেহেদি রং এবং গাঢ় লাল এবং হলুদ রঙের খেজাব ব্যবহার করা পছন্দ করতেন।

হাদিসের বিখ্যাত গ্রন্থ ফতহুল বারিতে তাবরানি শরিফের উদ্ধৃতি দিয়ে একটি হাদিস এসেছে। সেখানে দেখা যায়, রাসুল (সা.) আনসারি সাহাবিদেরকে

লাল রঙের খেজাব ব্যবহার করতে পরামর্শ দিয়েছেন। তবে এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কালো রঙের খেজাব ব্যবহার করা শরিয়াহর দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। রাসুলে

আকরাম (সা.) কালো রঙের খেজাব ব্যবহার করতে নিষেধ করেছেন। হাদিসে এসেছে, যারা কালো রঙের খেজাব ব্যবহার করবে তারা জান্নাতের খুশবো থেকেও বঞ্চিত হবে। আবু দাউদ ২: ৫৭৮

নারীরা কালো রঙের খেজাব ব্যবহার করতে পারবে কি নাÑ এ নিয়েও শরিয়াহ বিশেষজ্ঞদের একাধিক মতো পাওয়া যায়। ইসলামী ফেকাহ জগতের প্রখ্যাত মনীষী ইমাম ইসহাক (রহ.) বলেছেন, নারীরা স্বামীদের খুশি করার উদ্দেশে সাজসজ্জার উপকরণ হিসেবে কালো রঙের খেজাব ব্যবহার করতে পারবে। হানাফি মাজহাবের প্রখ্যাত ব্যাখ্যাতা ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.)-এর মতে, স্ত্রী যদি যুবতী হয়, তাহলে স্বামীর জন্য কালো খেজাব ব্যবহার করার অনুমতি আছে। ফতোয়ায়ে আলমগীরী, ৫:৩৭

কোনো কোনো ফকিহ যুদ্ধের ময়দানের মুসলিম সৈনিকদের জন্য কালো রঙের খেজাব ব্যবহার করা বৈধ বলেছেন। ইমাম যুহরি (রহ)-এর দৃষ্টিতে যেসব যুবকের চুল স্বাভাবিক সময়ের আগে কোনো কারণে সাদা হয়ে যায় তাদের জন্য কালো রঙের খেজাব ব্যবহার করার অনুমতি আছে। ফতহুল বারি। ১০:৪৩৪

অবশ্য কালো রঙের খেজাব ব্যবহার করার অনুমতিবিষয়ক এ সবগুলোই

কারণই এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয় যে, এর জন্য নবীজীর আদেশকে পাশ কাটাতে হবে। বরং সর্বাবস্থায় নবীজীর আদেশ পরিপূর্ণভাবে মেনে চলার মাঝেই আমাদের

উভয় জাহানের সফলতা নিহিত রয়েছে। তাই আসুন, জীবনের পথকে আলোকিত করতে সৌন্দর্য ও সাফল্যমন্ডিত করতে প্রদীপ্ত হই সুন্নাহের পথে। শরিয়াহ নির্দেশিত শান্তি ও প্রশান্তির পথে।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক,

শরিয়াহ রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close