আহমদ আবদুল্লাহ

  ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৮

স্মরণ

গৌরবময় বিজয় এবং আমাদের জাতিসত্তা

বিশ্বের দেশে দেশে যত ইতিহাস আছে, তন্মধ্যে বাংলাদেশের গৌরবময় বিজয়ের ইতিহাস অনন্য। বিশ্বে আর দশটি দেশের বা স্বাধীনতার সঙ্গে বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া কঠিন। শতাব্দীর পর শতাব্দীব্যাপী গৌরবোজ্জ্বল বাঙালি জাতি অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হিসেবে পরিচিত হয়ে আছে। অন্যায়, অবিচার, শোষণ, কুশাসন, নির্যাতন কখনো মাথা পেতে বরণ করেনি। ঝড়-ঝঞ্ঝা, জলোচ্ছ্বাস, দুর্যোগ, দুর্বিপাকে হারায় না কখনো মনোবল। এক কথায় এ দেশের বাঙালিরা অসীম সাহসী। পরাধীন হিসেবে বাংলাদেশের মানুষ কখনো বিবেক বিক্রি করতে বাধ্য হয়নি। উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হলেও এ জাতির বিদ্রোহের শির চিরদিনই উন্নত। তাই রণে ক্লান্ত না হয়ে রক্তাপ্লুত ইতিহাসের মাধ্যমে রচিত করেছে অনন্য ইতিহাস।

বাংলাদেশের গৌরবময় বিজয়ের ইতিহাস স্মরণকালের নৃশংস বর্বরতা ও হত্যাকা-ে রঞ্জিত। সুদীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ছিল এক বিভীষিকাময় সময়। সে সময়ে ঘরে ঘরে ছিল প্রচ- আতঙ্ক, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। বিভীষিকাময় দিনগুলো ছিল বড়ই যন্ত্রণাক্লিষ্ট ও বেদনা-বিধুর। শান্তির বাতাবরণ ছিল সুদূরপরাহত। হানাদার বাহিনীর পদভারে এ জনপদ হয়ে পড়েছিল বিপৎসংকুল। এ দেশের মানুষ প্রতিবাদী ও সংগ্রামী হয়ে ওঠে তখনই যখন জাতীয় স্বার্থের মূলে আঘাত লাগে। নিজস্ব স্বকীয়তা ও জাতিসত্তা বিপন্ন হতে দেখে। জাতিগত বিভেদ, অর্থনীতিক বৈষম্য ও ভাষাগত বঞ্চনা থেকেই স্বাধীনতা সংগ্রামের সূত্রপাত ঘটে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা-ই হয়েছিল।

দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ গৌরবোজ্জ্বল বিজয় লাভ করে। যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে আত্মসমর্পণ করে পাক হানাদার বাহিনী। এ যুদ্ধ ছিল পরস্পর মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে। পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের উভয় দেশের জনগণ মুসলিম। ধর্ম ও দর্শন ছিল এক ও অভিন্ন। কিন্তু ভাষা, বর্ণ ও সংস্কৃতি ছিল ভিন্ন। জাতিগত পরিচয়ও এক ছিল না। অনেকটা ব্রিটিশদের মতোই। ফলে সর্বক্ষেত্রে বৈষম্য দেখা দেয়। এ বৈষম্যের ব্যবধান দিনে দিনে বেড়ে যায়। অর্থনৈতিক ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রেও এ দেশবাসী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। তার প্রমাণ, ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৪ আগস্ট দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতা লাভের এক মাসের মধ্যেই রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি ওঠে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সর্বপ্রথম পূর্ব পাকিস্তানে সফরে এসে এক সমাবেশে বললেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’ এরই ধারাবাহিতা রক্ষা করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ও খাজা নাজিমুদ্দীন একই ভাষণ দেন। সকল সমাবেশেই এ দেশবাসী না, না বলে প্রতিবাদ জানায়।

বস্তুত ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকেই স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা গতি পায়। মুখের ভাষা কেড়ে নেওয়ার প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠে এ দেশবাসী। ভিন্ন ভাষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতি চাপিয়ে দিতে উদ্ধৃত হয়ে এক ধর্মের ভিন দেশের শাসকগোষ্ঠী। অথচ ভাষা-সংস্কৃতি দিয়ে জাতি তার নিজস্ব পরিচয় বিহন করে। সংস্কৃতির স্বাধীনতা একটি জাতিকে তার স্বকীয় মহিমায় ভাস্বর করে তোলে। উজ্জ্বল হয় তার স্বরূপ। সেই পরিচয় পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী কেড়ে নিতে চেয়েছিল। প্রতিবাদে আন্দোলন বেগবান হয়। প্রতিবাদ গড়ে তোলে সমগ্র জাতি। পরিণতিতে রাজপথ হয় রঞ্জিত। সরকার বাধ্য হয় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে। এরই ধারাবাহিতায় ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে। মুসলিম লীগ নির্বাচনে পরাজয় বহন করে। এরপর বাংলাদেশে জনগণ সুসংগঠিত হয়। ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে। বিজয়ীদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে শুরু হয় গভীর ষড়যন্ত্র। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে ২৫ মার্চ কালরাতে এ দেশের মানুষের ওপর শুরু হয় ইতিহাসের নৃশংস কর্মকা-। শুরু হয় রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র যুদ্ধ। নয় মাস অবিরাম এ যুদ্ধ চলে। অবশেষে অনেক ত্যাগের বিনিময়ে বিজয় পতাকা আকাশে উড্ডীন হয়। বাঙালিরা ছিনিয়ে আনে স্বাধীনতার লাল সূর্য। তাই ১৬ ডিসেম্বর আমাদের জাতীয় জীবনে এক অনন্য স্মৃতিবিজড়িত গৌরবময় দিন।

মাত্র নয় মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে কোনো জাতির বিজয়ের ঘটনা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। ফিলিস্তিনিরা নিজ দেশে পরবাসী। তারা ১৯৬৭ থেকে আন্দোলন করছে। কাশ্মীরবাসী স্বাধীনতারর জন্য লড়াই করছে সেই ১৯৪৭ থেকে। ইরাক আফগানে রক্ত ঝরছে প্রায় দিন। এসব দেশ কবে নাগাদ স্বাধীনতা লাভ করবে তা বলা সহজ নয়। কিন্তু কেবল বাংলাদেশের জন্য ব্যতিক্রম ইতিহাস রচিত হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের দরবারে আমরা আলাদা জাতি হিসেবে স্বীকৃত। পাকিস্তান আমলে আমরা এই পরিচয়টুকু গড়ে তুলতে পারিনি। ভৌগোলিক ও জাতিগত পার্থক্যের কারণে তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ভৌগোলিক অস্তিত্ব আমাদের রাজনৈতিক ও দেশগত অস্তিত্ব এবং জাতিগত সত্তা। নৃতত্ত্বগত ও ধর্মগত পার্থক্য এখানে মুখ্য বিষয় নয়। বস্তুত জাতিসত্তা হচ্ছে একটি জাতির মৌল পরিচয় ও জাতির একাত্মবোধ। আমরা বাঙালি, এটাই বড় পরিচয়। এই পরিচয় আমাদের আলাদা করেছে ভৌগোলিক স্বাধীনতার কারণে।

জাতি সত্তার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, জাতীয়তা। এটাও একটা বোধ এবং একটা চেতনা। যার ভিত্তিমূলে থাকে স্বাধীনতা সচেতন ইচ্ছাশক্তি। আর এ বোধের জন্ম হয় তার জীবন দৃষ্টির ঐক্য থেকে। এ বোধকে জাগিয়ে তুলে তার দ্বন্দ্ব, সংগ্রাম, ভাষা, সাহিত্য ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার বিবেচনায়ন ধর্ম, বর্ণ, ভাষা ও জাতিগত বৈষম্য থেকেই জাতিসত্তা ও জাতীয়তাবাদের সূত্রপাত। এ প্রভাব অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও বিস্তার লাভ করে। এ কারণে সমগ্র আরব বিশ্ব এক হওয়ার পরেও আরব জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠতে পারেনি।

দেশ ও জাতিত প্রতি ভালোবাসা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি এবং জাতিত্তার মৌল বৈশিষ্ট্য। দেশপ্রেম মানুষের অন্তরের মূলে প্রথিত থাকে। এ প্রেম কেউ নস্যাৎ করতে পারে না। দেশ প্রেমের আরেকটি দুর্বল দিক হলো, মাতৃভাষার প্রতি গভীর মমত্ববোধ। দেশের প্রতি ভালোবাসা থাকার সুবাদেই আমরা বিজয় ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি। বিজয় এমনিতে আসে না। আন্দোলন ও সংগ্রাম করে তাকে ছিনিয়ে আনতে হয়। এতে রক্ত ঝরাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আজ আমরা গৌরবান্বিত। স্বাধীন দেশে স্বাধীন জাতিসত্তা ও স্বাতন্ত্র্যবোধ নিয়ে অস্তিত্ববান হিসেবে দাঁড়িয়ে আছি। স্বাধীন দেশের নিজস্ব জাতিসত্তার ভিত্তি যতদিন অক্ষুণœ থাকবে, তত দিন আমরা মেরুদ-বান জনগোষ্ঠী শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সকলের গণনার ও শ্রদ্ধার পাত্র। সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত আসলে জাতিসত্তা নির্লিপ্ত থাকতে পারে না। এই স্বতন্ত্র জাতিসত্তা ও স্বাধীনতা লালন-পালন, বিকাশ ও নিরাপত্তাই সার্বভৌমের মর্মকথা। একে রক্ষার জন্য আমরা অতীতে রক্ত দিয়ে লড়েছি, ভবিষ্যতেও লড়ব। বিজয় দিবসে আমাদের অঙ্গীকার-রক্ত দিয়ে যে গৌরবোজ্জ্বল বিজয় ছিনিয়ে এনেছি, তা কখনো নস্যাৎ হতে দেব না।

লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close