অলোক আচার্য

  ১৩ নভেম্বর, ২০১৮

মতামত

একান্নবর্তী এবং পরিবর্তিত সমাজ

একান্নবর্তী পরিবারব্যবস্থা বলতে মূলত আমাদের প্রাচীন সমাজব্যবস্থাকে বোঝায়। যেখানে মা-বাবা, সন্তান, দাদা-দাদিসহ পরিবারের সবাই একত্রে বসবাস করতেন। সমাজব্যবস্থা মূলত হাজার বছর ধরে চলে আসা সংস্কৃতি এবং পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। ভারতীয় উপমহাদেশে সেই আদিকাল থেকেই একান্নবর্তী সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। সে সময়গুলোয় সমাজের শৃঙ্খলা শুরু হতো পরিবার থেকেই। পরিবারব্যবস্থা সামাজিকব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে। পরিবারে যে মানুষটি সবচেয়ে বয়স্ক, তার কথা সবাই মেনে চলত। এভাবে ক্রমেই বাড়ির বড়দের কথা সবাই মেনে চলত। পরিবারের মধ্যেই একটি চেইন অব কমান্ড ছিল। সে কারণে সমাজেরও চেইন অব কমান্ড ছিল। বিভিন্ন হারিয়ে যাওয়া দৃশ্যের মতো একান্নবর্তী পরিবার আজ হারিয়ে গেছে। আজকের সমাজের সঙ্গে তখনকার সমাজের ব্যাপক পার্থক্য। সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। পরিবর্তন ঘটেই চলেছে। সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটার সঙ্গে সঙ্গে জীবনযাত্রার মান এবং ধরনে পরিবর্তন ঘটছে। সামাজিকব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটার জন্য আমাদের সার্বিক জীবনযাত্রারও পরিবর্তন ঘটেছে।

একান্নবর্তী পরিবারে কী সুবিধা ছিল বা আজ একান্নবর্তী পরিবার না থাকায় কী অসুবিধা হচ্ছে, তা অনুধাবন করতে হলে আজকের হিংসা, ক্রোধ আর লোভাচ্ছন্ন সমাজের দিকে তাকালেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিচ্ছিন্নতা প্রতিটি পরিবারকে গ্রাস করেছে। কমে যাচ্ছে পরিবারের এক সদস্যের প্রতি আরেক সদস্যের দায়িত্ববোধ। একই পরিবারের সদস্য হয়েও সদস্যদের মধ্যে রয়েছে এক ধরনের দূরত্ব। মা-বাবার সঙ্গে সন্তানের দূরত্ব এতটাই বাড়ছে যে, তা সন্তানের জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। আজ অধিকাংশ পরিবারেই মা-বাবা দুজনকেই কর্মব্যস্ত জীবন কাটাতে হচ্ছে। সারা দিন শেষে বাসায় ফিরে সন্তানকে কাছে টেনে নেওয়ার সময়টুকু পাওয়া যায় না। মা-বাবার সাহচর্য থেকে বঞ্চিত হয়ে সন্তান ঝুঁকছে আধুনিক প্রযুক্তির ওপর। সারাক্ষণ মোবাইল ট্যাবের স্ক্রিনে চোখ রাখা এ যুগের ছেলেমেয়েদের প্রবণতায় পরিণত হয়েছে। এরা পাচ্ছে আনন্দহীন একটি জীবন। এ বিষয়ে কবিগুরুর মত হলো, ‘ক্ষুধার কারণে কেউ মরে না কিন্তু আনন্দের অভাবে মানুষ মরতে পারে। সেই মৃত্যু মানসিক, যা শরীরের মৃত্যুর থেকেও ভয়ংকর। আজকের সন্তানদের বিচ্ছিন্নতার এ বিষয়টিই একাকিত্ব। বিভিন্ন গবেষণায় জানা যায়, দেশের তরুণদের অনেকেই হতাশায় ভুগছে। এর কারণ মানুষের সাহচর্য থেকে বঞ্চিত হয়ে তারা যন্ত্রনির্ভর হয়ে পড়ছে। যন্ত্রের সঙ্গে সময় কাটাতে কাটাতে একসময় নিঃসঙ্গতা গ্রাস করছে। সেই নিঃসঙ্গতা থেকেই হতাশা মনে প্রভাব ফেলছে। পত্রিকার পাতা খুললে মাঝে-মাঝেই তুচ্ছ কারণে আত্মহত্যার খবর পাওয়া যায়। এই আত্মহত্যার সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। আত্মহত্যার কারণ এতটা তুচ্ছ যে, ভাবলেই বেশ অবাক হতে হয়। মোবাইল বা বাইক না কিনে দেওয়া, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার মতো তুচ্ছ কারণেও অতি মূল্যবান একটি প্রাণ বিসর্জন দিতে এতটুকু কুণ্ঠিত হচ্ছে না।

পরিবারের এই বিচ্ছিন্নতার ফলে প্রবীণরা হয়ে গেছে প্রচ-ভাবে একা এবং অসহায়। তাদের জগৎ আজ ছোট। সমাজে প্রবীণ সদস্যদের প্রতি যেন কারো কর্তব্য নেই। একসময় পাড়ার দোকানে প্রবীণ কাউকে দেখলে কিশোররা দূরে সরে যেত। আজ সেই দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। এখন কিশোরের দল দেখলেই প্রবীণরা অন্য পথে হাঁটে। অনেক কিছু দেখলেও না দেখার ভান করে চলে যায়। এভাবেই সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। আর প্রতিনিয়ত বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রিত বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। পরিবার থেকে পরিবারের বিচ্ছিন্নতা, পরিবারের সদস্য থেকে অন্য সদস্যদের বিচ্ছিন্নতা সামাজিক ভারসাম্যে প্রভাব ফেলছে। একান্নবর্তী পরিবার আমাদের বাঙালি কৃষ্টির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সময়ের পরিক্রমায় পরিবারগুলো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। পরিবারব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক ব্যবস্থায়ও পরিবর্তন ঘটছে। মানুষ ক্রমেই বিচ্ছিন্ন এবং একা হয়ে পড়ছে। আমাদের পাঠ্যবইগুলোয় পরিবারের সম্পর্কে প্রাথমিক শ্রেণি থেকেই একটি ধারণা দেওয়া থাকে। সেখানে মা, বাবা, ভাই, বোনসহ সবাইকে নিয়ে পরিবারের ধারণা দেওয়া হয়েছে। পরিবার সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণা নিয়েই এরা বড় হয়। আমাদের অধিকাংশ পরিবারেই বইয়ের এ বাস্তবতা শেষ পর্যন্ত থাকছে না। একান্নবর্তী পরিবারগুলো ভেঙে একান্নটি পরিবারে পরিণত হয়েছে। পরিবার থেকে তৈরি হয় সমাজ, সমাজ থেকে জাতি। পরিবারের ধারাও সমাজে প্রবাহিত হয়। তাই পরিবারে যখন দূরত্ব, হিংসাÑএসব তৈরি হয় তখন, তা সরাসরি সমাজে প্রভাব বিস্তার করে। আজ সমাজের চারদিকে এত অসংগতি, এত হানাহানি, এত লোভের বিস্তার, এত দূরত্ব, মানুষের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধের অভাবÑএসব একসঙ্গে তৈরি হয়নি। প্রথমে ফাটল ধরেছে নিজের পরিবারে। ভাই ভাইয়ের থেকে আলাদা হওয়া খুব সাধারণ চিত্র। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক আলগা হয়ে যাচ্ছে খুব সহজে। গত কয়েক বছরে আমাদের দেশে বিবাহবিচ্ছেদের সংখ্যা বহু গুণে বেড়েছে। এ পরিবারের সন্তান বেড়ে উঠছে একাকিত্ব আর নিঃসঙ্গ অবস্থায়। সন্তানের সুস্থ বিকাশের জন্য একটি সুন্দর পরিবার থাকা আবশ্যক। পরিবারের শিক্ষা, আত্মমর্যাদা সন্তানের ভেতর বিকশিত হয়। ভবিষ্যতে তার ব্যক্তিত্ব বিকাশে যা সহায়তা করে। মা অথবা বাবার আবার ক্ষেত্রবিশেষে দুজনেরই আদর, ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়ে তার মনে এক ধরনের স্থায়ী প্রভাব ফেলে। তার ব্যক্তিত্বে সরলতার বদলে কাঠিন্যভাব এবং একগুঁয়েমি ভাব প্রকাশ পায়, যা খুব সহজেই তাকে বিপথে নিয়ে যেতে পারে। পরিবার হলো সামাজিক গঠনের ভিত্তিস্বরূপ। পরিবার থেকে পাওয়া শিক্ষা সমাজ গঠনে ভূমিকা পালন করে। তাই ভেঙে যাওয়া পরিবার নয় বাংলার চিরায়ত পরিবারব্যবস্থা গঠনে সবাইকে সচেতন হতে হবে। পরিবারের সেই শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। তাহলে সমাজেও শৃঙ্খলা ফিরবে। মোটকথা, একটি সুন্দর সমাজ গঠনে সুন্দর পরিবার গঠনের বিকল্প নেই।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close