এস এম মুকুল

  ১৩ নভেম্বর, ২০১৮

পর্যালোচনা

চাওয়া-পাওয়ায় জনগণ ও জনপ্রতিনিধি

আমরা দেশের সাধারণ নাগরিক বা জনগণ। বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার বিভাজনে আমরা সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করি। সমাজের প্রতি আমাদের অনেক দায়-দায়িত্ব। সমাজের প্রতি আর দশটা দায়িত্বের মধ্যে অন্যতম একটি হলোÑভোট প্রদানের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করা। ভোট প্রদান করা আমাদের নাগরিক অধিকার এবং দায়িত্ব। ভোটের সময় আমরা দলবেঁধে ভোট দিই। কিন্তু নিরপেক্ষভাবে আমাদের রাজনীতির চরিত্র বিশ্লেষণ করলে ভোট প্রদানে আমাদের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব বেড়ে যায়। কাকে ভোট দেব? কাকে বানাব জনগণের প্রতিনিধি? আমাদের দুর্ভাগ্য, হতাশা, অসহায়ত্ব এই ভোট প্রদানকে কেন্দ্র করেই। মাঝে-মাঝে এমন প্রশ্নও জাগে, আমরা আসলে কেন ভোট দেই? আমাদের ভোটে যদি কোনো দুর্নীতিবাজ, অর্থলোভী, ক্ষমতালিপ্সু জনপ্রতিনিধি হয়ে আসেন, তাতে আমাদের কী লাভ? দেশের কী লাভ? এসব প্রশ্ন জনগণকে মানবতার কাঠগড়ায় দাঁড় করায় বারবার। তারপরও আমরা ভোট দিতে যাই! আমাদের ভোটেই নির্বাচিত হয়ে আসেন প্রিয় জনপ্রতিনিধিরা।

জনগণের বিপুল সমর্থনে যিনি নির্বাচিত হন তিনি জননেতা। আমাদের প্রত্যাশা আর স্বপ্নপূরণের প্রতিনিধি। কিন্তু আমরা কেমন বোকা সরল ভোটারÑসেটা বুঝতে পারি যখন আমাদের ভোটে পার পেয়ে নেতাজি লাপাত্তা হয়ে যান। ভোটের আগে কী জনদরদি চরিত্র তাদের। চেনা-অচেনাকে দেখা মাত্রই বুকে জড়িয়ে ধরেন। হাতে হাত মেলান। কুশল জানেন। আর ভোটের পরের বিজয়ী এই নেতার পার্থক্য পিলে চমকানোর মতো। ভোটের আগের নেতা কী অসাধারণ, সৎ, উদার, নিরহঙ্কারী, আবেগী ও সেবক মানুষ। হাটে, ঘাটে, মাঠে, অলিগলিতে চষে বেড়ান জনগণের দুয়ারে দুয়ারে। ভোটভিক্ষা চান। হাতে-পায়ে ধরেন। রাত-বিরাতে জনগণের কাছে ছুটে যান। আর হাজারো প্রতিশ্রুতির মনভোলানো কথার ঝুড়ি দিয়ে হৃদয় জয় করে নেন আমাদের। আর ভোটের পরের নেতা- জনপ্রতিনিধি হলেও পাল্টে যায় দৃশ্যপট।

এক জরিপে উঠে এসেছেÑদেশের রাজনীতির প্রতি আস্থা হারাচ্ছে তরুণ প্রজন্ম। খুবই ভয়াবহ খবর। ব্রিটিশ কাউন্সিল আয়োজিত ‘বাংলাদেশের আগামী প্রজন্ম’ শিরোনামের এই জরিপে উঠে এসেছে তরুণসমাজে রাজনৈতিক ভাবনার নানা বিশ্লেষণ। জরিপের ফলাফলে বলা হয়েছেÑ৩৮ শতাংশ তরুণ ছাত্ররাজনীতির প্রতি উদাসীন। ৩০ শতাংশ তরুণ মনে করে, রাজনীতিতে অংশ নেওয়া ঠিক হবে না। তরুণ ও মেধাবীরা রাজনীতিতে না এলে রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন আসবে কী করে! জরিপটিতে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, ৪১ শতাংশ তরুণ বিদেশে পারি জমাতে আগ্রহী। অথচ বর্তমানে ভোটের বাজারে বিরাট একটা অংশ তরুণসমাজ। রাজনীতির চালচিত্রের পটপরিবর্তনে এখন তরুণসমাজের ভূমিকা অগ্রগণ্য। এখন ভাবার বিষয় হলোÑ১৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী প্রায় ছয় কোটি তরুণের মনোভাব আমলে না নিয়ে দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণ কতটা সম্ভব? এই জরিপে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে এসেছে, যেমনÑ৯৮ শতাংশ তরুণ নিজেকে সামাজিক কর্মকা-ের সঙ্গে যুক্ত করতে আগ্রহী। তরুণদের জাতীয় পর্যায়ের রোল মডেল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। আমাদের সমস্যা হলো, বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্বে কেউ রোল মডেল হতে পারছেন না। তবে সুযোগ আছে। এই ৯৮ শতাংশ তরুণের সামাজিক মনোভাব, ৪১ শতাংশ তরুণের বিদেশগামী মনোভাবকে পাল্টে দিতে পারেন রাজনীতিবিদরাই।

আমাদের জনপ্রতিনিধিরা কী করেন : জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে জনপ্রতিনিধিরা তাদের প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে যান। নিজেদের আখের গোছানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাদের চারপাশে সুবিধাবাদী, চাটুকার ও তৈলবাজ শ্রেণির বলয় সৃষ্টি হয়। এই বলয়ে জনগণের আর সহজ প্রবেশাধিকার থাকে না। জনপ্রতিনিধি দলীয় প্রভাব বিস্তার করেন। সুবিধাবাদীরা তাদের প্রশ্রয়ে সমাজে নানা অপকর্ম চালায়। খুন করেও পার পেয়ে যান, ধর্ষণ করেও পার পেয়ে যান! জনপ্রতিনিধিরা দখলবাজি, নিয়োগ-বাণিজ্য, দুর্নীতিসহ বিতর্কিত ও নীতিগর্হিত নানা কাজে জড়িয়ে পড়েন। গরিবের প্রাপ্য রিলিফের টিন, দুস্থ মায়ের গম পর্যন্ত গিলে খান। জনগণের পেটে ক্ষুধা আর জনপ্রতিনিধিদের থাকে দামি ও বিলাসবহুল শুল্কমুক্ত গাড়ির ক্ষুধা।

জনগণ কী চায় : আমরা আমজনতা ‘পাবলিক’। যখন রাস্তায় গর্তে ঝাঁকুনি খাই, যখন খোলা ম্যানহোলে পরে আহত হই, যখন সড়কে প্রাণ যায়, যখন বাজারে গিয়ে মুখ কালো করে ঘরে ফিরি অথবা বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাসের অভাবে অতীষ্ট হয়ে হাফ ছাড়িÑতখন মনে মনে ভাবি ভোট দিয়ে কি ভুল করলাম? জননেতা জনগণের দুঃখ বুঝে না। জনগণ চায় জনপ্রতিনিধি এলাকায় আসুক। মানুষের দুঃখ-দুর্দশার কথা শুনুক। তাদের পাশে দাঁড়াক। জনগণের স্থানীয় সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা করুক। সংসদে গিয়ে তাদের কথা বলুক। দ্রব্যমূল্য, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা, সুশাসন, আইনের অধিকার, বিদ্যুৎ, গ্যাস, কর্মসংস্থান, রাস্তা ও যোগাযোগব্যবস্থা, পরিবেশ, ভূমি ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি নাগরিক অধিকার ও দাবি নিয়ে সংসদে কথা বলুন। এলাকার উন্নয়নে কাজগুলো দ্রুত সম্পাদনের তদারকি করুন। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দিন, কাজ করে খাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করুন। আমরা কি অযোগ্য লোকদের পাঠিয়েছি জনপ্রতিনিধি করে? জনগণ চায় জনপ্রতিনিধিরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে যোগ্যতা ও সততার নজির সৃষ্টি করুক।

জনপ্রতিনিধির আদর্শে যেসব পরিবর্তন আসতে পারে : ১. তরুণ প্রজন্মের সামনে নেতৃত্বের রোল মডেল তৈরি হবে। ২. তরুণরা আদর্শিক অনুপ্রেরণায় এবং দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে রাজনীেিত ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। ৩. স্থানীয়ভাবে এবং জাতীয়ভাবে উন্নয়নের জোয়ার আসবে। ৪. দুর্নীতি কমবে; রাস্তাঘাট, বাস-ট্রেন ও হাসপাতালের সেবাগুলো মানুষ যথাযথভাবে পাবে। ৫. জনগণ ন্যায্য বিচার পাবে; ক্ষমতার প্রভাব থেকে রক্ষা পাবে। ৬. অনিয়ম, ঘুষ, নিয়োগ-বাণিজ্য, দলবাজি কমবে। ৭. কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাবে, কৃষি উপকরণ মিলবে সহজ সুবিধায়। ৮. স্থানীয় সমস্যা স্থানীয়ভাবে সমাধান হবে। ৯. সামাজিক বিভক্তি কমবে, সমাজের অস্থিরতা কমবে। ১০. জনগণ আশা পাবে, ভরসা পাবে; তাদের প্রদেয় ভোটের সুফল উপভোগ করবে। দেশ এগিয়ে যাবে।

আমাদের স্বীকার করতে কোনো দ্বিধা নেই যে, অনেক ত্যাগী নেতাও আছেন আমাদের দেশে। কিন্তু তেলবাজ, দুর্নীতিপরায়ণ এক শ্রেণির নেতার দৌরাত্ম্যের শিকার হয়ে ত্যাগীরা পিছিয়ে পড়েন। কিন্তু তাদের এভাবে থেমে থাকলে চলবে না। একজন নেতার জনপ্রতিনিধি হয়ে ওঠার পেছনে বিরাট ঘটনাবহুল ইতিহাস থাকে। অসংখ্য ত্যাগী মহিমার নজির তাদের জীবনের নিরন্তর সঙ্গী। রাস্তাঘাটে আন্দোলন-সংগ্রামে রাত-দিন কাটিয়ে, রক্ত পানি করে, জেল খেটে, মামলার ঘানি টেনে, সামাজিক অপবাদ মেনে নিয়ে লাখো মানুষের মণিকোঠায় ঠাঁই করে নেন একজন নেতা। তারপর তিনি হয়ে ওঠেন একজন জনপ্রতিনিধি। সুতরাং বিদগ্ধ রাজনৈতিক চেতনা ছাড়া একজন প্রকৃত জনপ্রতিনিধি হওয়া যায় না। তাই জনপ্রতিনিধির সারা জীবনের আত্মত্যাগের অর্জনকে সামান্য লোভের মোহে পড়ে কলঙ্কের কালিমালেপন করা ঠিক নয়।

দেশকে এগিয়ে নিতে হলে রাজনীতিই লাগবে। এ ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদ বা জনপ্রতিনিধিদের মানুষের কল্যাণে নিবেদিত হওয়া কোনো বিকল্প নেই। তরুণ প্রজন্মের সামনে আদর্শের মডেল হতে হবে জনপ্রতিনিধিদেরই। মূল্যবোধের চর্চা নিজের ও সমাজের মাঝে বিকশিত করতে হবে। দেশ এগিয়ে যাবে আপনগতিতে। জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব জনগণকে সঙ্গে নিয়ে

উন্নয়ন কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করা। তরুণদের জন্য ইতিবাচক নেতৃত্বে পথকে উন্মুক্ত করে দেয়। শেষ কথায় বলব, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমরা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। আমরা সেই দায়বদ্ধতার নিদর্শন দেখতে চাই।

লেখক : গবেষক ও বিশ্লেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close