মো. আজহারুল ইসলাম

  ০২ নভেম্বর, ২০১৮

মতামত

ব্যালেন্স অব পাওয়ারে পরাশক্তি

বিশ্বরাজনীতির পরিমন্ডলে ব্যালেন্স অব পাওয়ারের বা শক্তিসাম্যের যে প্রেক্ষাপট ছিল তা সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সঙ্গেই শেষ হয়ে গিয়েছিল বলে ধরে নেওয়া হতো। এই পতনের ফলে পৃথিবীর রাষ্ট্রগুলো মার্কিন প্রভাবিত এককেন্দ্রিক বিশ্বে প্রবেশ করে। তবে একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্বরাজনীতি অন্যদিকে মোড় নিয়েছে। এই শতাব্দীতে চীনে-রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন অপেক্ষাকৃত দুর্বল শক্তির রাষ্ট্রসমূহ যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী একটি ব্লক তৈরি করে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে প্রায় উঠে দাঁড়িয়েছে। তাই আশা করা যায়, এই শতাব্দীতে পুনরায় এই ব্যালেন্স অব পাওয়ার পুনরায় আঠার বা উনবিংশ শতাব্দীর মত তৎপর্য বহন করবে। ব্যালেন্স অব পাওয়ার বা শক্তিসাম্য হচ্ছে রাষ্ট্রীয় পরিবারের সদস্যদের মাঝেÑ এমন একটি সাম্য ব্যবস্থা, যা কোনো রাষ্ট্রকে অধিক শক্তিশালী হতে বাধা দেবে যেন উক্ত রাষ্ট্র নিজের ইচ্ছেকে অন্য রাষ্ট্রের ওপর চাপিয়ে দিতে না পারে। অর্থাৎ শক্তি সাম্যের মূল কথা হচ্ছে ক্ষমতা ও শক্তি পরিমাপের সমতা বজায় রাখা। যদি বিশ্লেষণ করে বলি তাহলে বলতে হবে ব্যালেন্স অব পাওয়ার এমনই অবস্থা যেখানে একক কোনো শক্তি বা শক্তির সমবায়কে এমন আকাশচুম্বী ক্ষমতাসম্পন্ন হতে দেওয়া যাবে না, যাতে অন্য রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য কোনো শক্তি হুমকির এজেন্ডা হয়ে দাঁড়ায়। তবে বিশ্লেষকরা বারবার দাবি করছেন, শক্তিসাম্যের কৌশল সর্বদাই চাতুর্যতাপূর্ণ।

এই কথা অবশ্যই মেনে নিতে হবে স্নায়ুযুদ্ধ বা ঠান্ডাযুদ্ধের অবসানের পর যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্য বিস্তার পৃথিবী নিখুঁতভাবে অবলোপন করেছে। তবে একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্বরাজনীতির ময়দানে যুক্তরাষ্ট্রকে একক অ্যাক্টর না বলাই বুদ্ধিদীপ্তের পরিচায়ক। চীনের উত্থান হয়েছে বিশ্বায়নের রাজনীতিতে অন্যতম শক্তি হিসেবে এবং ১৯৯১ সালের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের পর সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া পেয়েছে সুদীর্ঘ ২৭টি বছর; যার ফলে যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্যকে মেনে নিতে প্রস্তুত নয় পুতিনের রাশিয়া। যুক্তরাষ্ট্র ইহা অবশ্যই প্রত্যক্ষ করছে সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়া-চীনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বেড়েই চলেছে। আশা করা হচ্ছে, ২০২০ সালের মধ্যে এই দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্যের পরিমাণ ২০০ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। চীনের অর্থনৈতিক অগ্রসরতা কেমন দ্রুতগতিতে চলছে, তা বোঝা যায় যখন প্রত্যক্ষ করা হয় চীন থেকে ঋণ সরবরাহ করছে যুক্তরাষ্ট্র।

সোভিয়েত ইউনিয়নের গর্ভাচেভের ভুলের পুনারাবৃত্তি যদি বর্তমান রাশিয়াতে ঘটে তাহলে রাশিয়াকে চরম মূল্য দিতে হবে। গর্ভাচেভ যে বিভক্তিহীন ইউরোপের স্বপ্ন দেখেছিলেন সত্যিকার অর্থে তা ছিল কল্পনাবিলাস মাত্র। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষমতায় এসে দুই পরাশক্তির পারমাণবিক শক্তি হ্রাসের যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন তাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাড়া দেয়নি। কিন্তু গর্ভাচেভ সোভিয়েতের অস্ত্র প্রতিযোগিতা হ্রাস করেছিলেন এবং ন্যাটোর বিপরীতে গড়ে উঠা ওয়ারস সামরিক জোটকে ভেঙে দিয়েছিলেন। তবে তৎকালীন সময়ে পুঁজিবাদী ব্লকের ন্যাটো নামক সামরিক জোটটি ভেঙে না দিয়ে ন্যাটোর সম্প্রসারণ ঘটিয়েছে পূর্ব-ইউরোপ পর্যন্ত। এর ফলস্বরূপ সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন পরিণত হয় রাশিয়ায়। ১৯১৭ সালের বলশেভিক বিপ্লবের মাধ্যমে আবির্ভূত সমাজতান্ত্রিক ইউনিয়নটির পতন রচিত হয় ১৯৯১ সালের ডিসেম্বর মাসে। পরবর্তীতে ন্যাটোতে দেওয়া হয়েছিল রাশিয়াকে পরমার্শকের ক্ষমতা অর্থাৎ ন্যাটোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় রাশিয়া শুধু খেলার পুতুলের ভূমিকা পালন করবে।

স্পষ্টতই একুশ শতকের রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র অন্যতম পরাশক্তি হলেও বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্যতা বিশ্বদরবারে তুলনামূলকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। গ্রহণযোগ্যতা হ্রাসের কারণ হিসেবে ফ্রান্সিস ফুকিয়ামের সঙ্গে একই সুরে বলতে চাই ,যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম ভুল ছিল যুক্তরাষ্ট্র তার আধিপত্য চর্চার ফলে সৃষ্ট প্রতিক্রিয়া অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছিল। পরবর্তী ভুলটি ছিল ক্ষমতা চর্চার সঙ্গে কৌশল ও দক্ষতার ব্যাপক ব্যবধান, যা যুক্তষ্ট্রের গ্রহণযোগ্যতাকে স্তিমিত করে দেয়। ইরাকের কাছে অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র ডব্লিউ এমডি রয়েছে অভিযোগ তুলে প্রেসিডেন্ট বুশ ইরাক আক্রমণ করলেন কিন্তু উক্ত মারণাস্ত্রের হদিসও পাওয়া গেল না। কিয়োটো প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়েছিল গ্রিন হাউস গ্যাসের নির্গমন হ্রাস এবং তাপমাত্রা হ্রাসের জন্য। কিন্তু কিয়োটো প্রটোকলকে প্রেসিডেন্ট বুশ মৃত ঘোষণা দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে ডোনাল ট্রাম্প ও উক্ত প্রোটকলের তীব্র সমালোচনা করলেন। ১৯৮৪ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ইউনেস্কো থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়। এসব ঘটনায় বিশ্বরাজনীতির মঞ্চে যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে তীব্র সমালোচনার বিস্তার ঘটে।

সমকালীন প্রসঙ্গে আবারও তীব্র সমালোচিত হচ্ছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কারণ ট্রাম্পের দ্বিমুখী নীতি। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সমালোচক ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গণমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টের কলাম লেখক খাশোগি হত্যাকান্ডের প্রসঙ্গে সুরের ভিন্নতা লক্ষ করা যায়। ট্রাম্পের ভাষায়, খাশোগি হত্যার ইস্যুতে বেশ কয়েকবার নিজেদের ভাষা পরিবর্তন করতে দেখা যায় ট্রাম্পকে। অবশেষে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় সৌদি সরকার স্বীকার করল সৌদি কনস্যুলেটের ভিতরেই খাশোগিকে হত্যা করা হয়। পরবর্তীতে সৌদি আরব যদিও দাবি করছে কিছু এজেন্ট তাদের সীমানার বাইরে গিয়ে এই হত্যাকান্ড সংঘটিত করেছে। তবে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, এই হত্যাকান্ডটি পূর্বপরিকল্পিত।

সমসাময়িক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে চীন একটি বড় ফ্যাক্টর। চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের মাঝে ভাঁজ পড়েছে। স্বার্থের প্রসঙ্গে চীন-যুক্তরাষ্ট্র একে অপরের জন্য হুমকিস্বরূপ। তাইওয়ান প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান যাই থাকুক না কেন, চীন এক ইঞ্চি ভূমিও ছাড়বে না। এ প্রসঙ্গে চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওয়েং ফেংগে বলেন, তাইওয়ান বিষয়টি চীনের অখন্ডতা এবং সার্বভৌমত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাইওয়ানকে যুক্তরাষ্ট্রের পৃষ্টপোষকতা করা এবং দক্ষিণ চীন সাগরে মার্কিনদের শক্তি প্রদর্শনের কারণে চীন প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ক্ষিপ্ত। বলে রাখা শ্রেয় রাশিয়া থেকে চীনের যুদ্ধবিমান কেনার পরপরই চীনা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।

সাম্প্রতিক সময়ে যখন চীন ও যুক্তরাষ্ট্র একে অপরের বিরুদ্ধে শুল্ক আরোপ করে বাণিজ্যযুদ্ধের সূত্রপাত করছে, ঠিক তখনই চীন সফরে গেলেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে এবং এই সফর ২০১৪ সালের পর জাপানের রাষ্ট্রপ্রধান কর্তৃক চীনে প্রথম সফর। যদিও একটি দ্বীপের মালিকানা নিয়ে ছয় বছর যাবৎ সম্পর্কের মারাত্মক টানাপড়েন চলছিল এই দুই দেশের বৈদেশিক সম্পর্কে। কিন্তু মৈত্রিতার সম্পর্কের নতুন ভিত্তি রচনা হবে এবারের শিনজো আবের সফরের মধ্য দিয়ে। এই কথা অস্বীকার করার কোনো অবকাশ নেই। চীনের উদ্দেশ্যে টোকিও ছাড়ার আগে শিনজো আবে বলেন, আমার এই সফরের মধ্য দিয়ে আমি দুটি জাতির (চীন-জাপান) সম্পর্ককে নতুন মাত্রায় উন্নতি করার চেষ্টা করব এবং উক্ত সফরে তিন হাজার কোটি ডলারের বাণিজ্য চুক্তিসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষরÑ এটাই ইঙ্গিত দেয় এশিয়ার এই দুই অর্থনৈতিক পরাশক্তি বৈরিতার সম্পর্ক ঘুচিয়ে মিত্রতার মাইলফলক রচনা করতে যাচ্ছে। চীন ও জাপানের নতুন করে মিত্রতার সম্পর্ক রচিত হওয়া অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হলুদ সংকেত প্রদান করছে। উত্তর কোরিয়াকে নিয়েও যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যথার শেষ নেই। এর মূল কারণ অবশ্য উত্তর কোরিয়ার যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী নীতি ও পারমাণবিক শক্তি।

দক্ষীণ চীন সাগর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক অঞ্চল। কারণ এই সাগর দিয়ে বিশ্ব বাণিজ্যের মোট ৩২ শতাংশ প্রবাহিত হয় এবং বিশ্ব বাণিজ্যের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জাহাজ এই সাগরের ওপর দিয়ে চলাচল করে। দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে চলমান রাজনীতি কিন্তু আজকের নয়, বহুকাল ধরেই চলে আসছে দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে আঞ্চলিক দেশগুলোর সঙ্গে চীনের দ্বন্দ্ব।আর এই ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বে যুক্তরাষ্ট্রের পরোক্ষ সম্পৃক্ততার অর্থ হলো চীনকে মোকাবিলা করা। বিশ্লেষকদের মতে, চীনকে চার পাশ থেকে সামরিক শক্তির মাধ্যমে ঘিরে ফেলার উদ্দেশ্যেই চীনের প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এত ঘনিষ্ঠতা। চীনের মনে রাখা প্রয়োজন দক্ষিণ এশিয়ায় চীন একক কোনো শক্তি নয়, ভারত তার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আছে বিশ্বরাজনীতির মাঠে। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের আঁতাত ইস্যুটি চীনকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের ভারত সফর এবং রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের অস্ত্রচুক্তি ও ইরানের কাছ থেকে ভারতের জ্বালানি তেল ক্রয় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও ভারতের সম্পর্ক পূর্বের চেয়ে অবনতি হয়েছে। মোদি সরকারও কিন্তু একতরফাভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে গ্রহণ করেছে, তা নয়। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মোদি সরকার পারমাণবিক চুক্তি ও অস্ত্রচুক্তি করলেও ভারত কিন্তু রাশিয়া ও চীনকে কাছে রাখতে চায়। ভারতকেও ভেবে দেখতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেডিশনাল মিত্রতার রাজনীতির প্রসঙ্গটি। কারণ এক যুগ আগেও পাকিস্তানের গুরুত্ব ছিল যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ভারত থেকে বেশি। কিন্তু বিশ্বরাজনীতির ময়দানে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে পাকিস্তান এখন পরিত্যক্ত ফুলের তোড়া। উদ্দেশ্যে অর্জন শেষ হলে ছুড়ে ফেলে দেওয়ার রাজনৈতিক কৌশল। তবে একথা সত্য যে, একুশ শতকের শক্তিসাম্যের রাজনীতিতে চাবি থাকবে এশিয়ার হাতে। চীন, জাপান ও ভারতের প্রেক্ষাপট নতুন দিগন্তের পথ উন্মোচন করবে। একথা মনে রেখেই পরাশক্তিগুলোকে সামনের দিকে এগোতে হবেÑ এটিই মূল কথা।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close