সাধন সরকার

  ১৬ অক্টোবর, ২০১৮

আলোচনা

সুরক্ষায় ‘সোনালি ব্যাগ’

সম্প্রতি বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) উদ্ভাবিত পলিথিনের বিকল্প পাটের তৈরি ‘সোনালি ব্যাগ’ পরিবেশ সুরক্ষার নতুন পথের সন্ধান দিয়েছে। বাংলাদেশের বিজ্ঞানী আণবিক শক্তি কমিশনের সাবেক মহাপরিচালক মোবারক আহম্মেদ খানের যুগান্তকারী এই উদ্ভাবনের মাধ্যমে পরিবেশের শত্রু পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করে ‘সোনালি আঁশ’ পাটের সম্ভাবনার দুয়ার যেমন খুলে দেবে তেমনি পরিবেশ দূষণ রোধেও ভূমিকা রাখবে। পলিথিন ব্যাগ পরিবেশের শত্রু। এর ব্যবহারও নিষিদ্ধ। কিন্তু এর উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার থেমে নেই। দেদার পলিথিনের ব্যবহার হচ্ছে। কাঁচাবাজার, ফাস্টফুডের দোকান, মুদি দোকান, শপিং মল সবখানে পলিথিনের জয়জয়কার! এর কারণ হলো পলিথিন সহজলভ্য ও সহজে ব্যবহারযোগ্য। অন্য কারণ হলো পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পরিবেশবান্ধব ও সহজলভ্য কোনো জিনিস জনসাধারণের হাতের নাগালে না থাকা!

একসময় সারা বাংলাজুড়ে ছিল পাটের কল-কারখানা। একসময় পাটের বহুমুখী ব্যবহারও ছিল। বাঙালির গৌরব ও অহংকারের বস্তু ছিল পাট। কিন্তু পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে একটু একটু করে পাটশিল্পের জৌলুস কমতে থাকে। দেশের ‘সোনালি আঁশ’ হয়ে যায় কৃষকের গলার ফাঁস! পাটের স্থান দখল করে নেয় পলিথিন। পরিবেশের এই শত্রু ধীরে ধীরে দেশের সবখানে ছড়িয়ে পড়ে। ২০০২ সালে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ হওয়ার পর পাটের ব্যাগ আলোর মুখ দেখতে শুরু করে। কিন্তু দাম বেশি ও সহজে না পাওয়ার কারণে এর ব্যবহার হ্রাস পেতে থাকে। বর্তমান সময়ে ক্রেতাসাধারণ কোনো জিনিস কিনতে অধিকাংশ সময় পলিথিন ব্যাগ ফ্রি পেয়ে থাকে। পলিথিনের নিত্য ব্যবহার ছাড়া বর্তমান সময়ে সাধারণ মানুষ যেন চলতেই পারে না! পলিথিন ব্যাগ যে নিষিদ্ধ তা বোঝারই কোনো উপায় নেই। এককথায় পরিবেশ আইন যেন থেকেও নেই! সরকার দেখেও না দেখার ভান করে! বাস্তবতা এটাই যে, চোখের সামনে পলিথিনের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে কিন্তু কারোরই কিছু করার নেই! তথ্যমতে, ঢাকা শহরে প্রতিদিন দুই কোটিরও বেশি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করা হচ্ছে। পৃথিবীর প্রতিটি দেশে কমবেশি পলিথিনের ব্যবহার হয়ে থাকে। প্রতি বছর বিশে^ প্রায় ৫০০ বিলিয়ন পিস পলিথিন ব্যাগ ব্যবহৃত হয়। ঢাকা শহরের খাল-নালা-নর্দমা ও নদীতে পলিথিনের স্তর জমেছে। ঢাকার জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ এই পলিথিন ব্যাগ। মাটির নিচে পলিথিন থাকলে তা গাছ জন্মাতে বাধা সৃষ্টি করে। পলিথিন পচনশীল না হওয়ায় তা মাটিতে মিশে না। মাটিতে পলিথিন বা প্লাস্টিক পুঁতে রাখার অর্থই হলো পরিবেশের জন্য জেনেশুনে মারাত্মক ক্ষতি ডেকে আনা। আবার পুড়িয়ে ফেললেও পলিথিনের মধ্যে থাকা বিষাক্ত রাসায়নিক পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

এমন বাস্তবতায় পাটের ‘সোনালি ব্যাগ’ আশার আলো হয়ে দেখা দিয়েছে। ‘সোনালি ব্যাগ’ নামের এই ব্যাগ পচনশীল ও পরিবেশবান্ধব। সুসংবাদ হলো, এই ব্যাগ তৈরিতে যুক্তরাজ্যের ফুটামুরা কেমিক্যাল কোম্পানির সঙ্গে ‘বিজেএমসি’র চুক্তি হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী পলিথিনের বিকল্প ‘সোনালি ব্যাগ’ উৎপাদনে সব ধরনের মেশিনারিজ ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা দেবে প্রতিষ্ঠানটি। অবশ্য বাংলাদেশের লতিফ বাওয়ানী জুট মিল নামের একটি কারখানায় খুব স্বল্প পরিসরে দুই বছর ধরে এ বিকল্প পলিথিন তৈরি হচ্ছে। এখন যুক্তরাজ্যের সহায়তায় বাণিজ্যিকভাবে এই ব্যাগ উৎপাদন করা হবে। মূলত ‘সোনালি ব্যাগ’ দেখতে সাধারণ পলিথিনের মতোই। পাটের সুক্ষ্ম সেলুলোজকে প্রক্রিয়াজাত করে অন্যান্য পরিবেশবান্ধব দ্রব্যাদির মাধ্যমে কম্পোজিট করে এই ‘সোনালি ব্যাগ’ তৈরি করা হয়। ব্যাগটি দেখতে প্রচলিত পলিথিনের মতোই হালকা ও পাতলা হবে। গোটা বিশে^ই পলিথিনের বিকল্প ব্যাগের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। আবার দেশ-বিদেশে পাটের বহুমুখী ব্যবহার ক্রমশ বাড়ছে। সে হিসেবে যথাযথ ও পরিকল্পনামাফিক এগিয়ে যেতে পারলে বাংলাদেশের এই ব্যাগ বিশ^বাজার দখল করতে পারবে। এমনকি অন্য দেশগুলো চাইলেও এই ব্যাগ সহজে উৎপাদন করতে পারবে না। কেননা কাঁচামাল হিসেবে পাটের বড় উৎস হলো বাংলাদেশ। পরিবেশবান্ধব একটা দেশ গড়ার স্বপ্ন আমাদের বহু দিনের। পাটের ‘সোনালি ব্যাগের’ ব্যবহার সর্বত্র চালু হলে তা পরিবেশের শত্রু পলিথিন নামক সমস্যার সমাধনের পথ খুলে দেবে। তাই এখন দরকার সবার সচেতন হওয়া। এ ছাড়া পাটের বহুমুখী ব্যবহারের পরিবেশমুখী গবেষণা চালিয়ে যেতে হবে। পাটপণ্যের এ সম্ভাবনার পরিপূর্ণ ব্যবহার করতে হবে। এই পণ্যটির বাণিজ্যিক উৎপাদন একদিকে যেমন পাটের বহুমুখী বাজার সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখবে; তেমনি পরিবেশ রক্ষায়ও বিশেষ সুরক্ষা দেবে। এতে করে প্রায় মরে যাওয়া পাটশিল্পের সম্ভাবনাময় বাজার আবার চাঙা হবে। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। পাট চাষিরা পাটের ন্যায্যমূল্য পাবেন। এখন এই খাতে দরকার সরকারের সঠিক তদারকি, সহযোগিতা ও অগ্রাধিকার।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close