আবুল বাশার শেখ

  ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

বিশ্লেষণ

আইনের বাস্তবায়ন জরুরি

দেশের সড়ক-মহাসড়কে কিছুতেই মৃত্যুর মিছিল যেন থামছে না। বর্তমানে সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের ঘটনা আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে। কোনোভাবেই সড়কে শৃঙ্খলা ফিরে আসছে না। গত ২৯ জুলাই বেপরোয়া বাসের চাপায় দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর জেরে নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছাত্র আন্দোলনের পর গত মাসে সড়ক পরিবহন আইন মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পায়। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে যানজটমুক্ত নিরাপদ ও সুশৃঙ্খল পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য কর্মপরিকল্পনা জমা দিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নির্দেশও দেওয়া হয়। এর আগে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে গত জুনে ছয় দফা নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু সেসব কতটা বাস্তবায়ন বা কার্যকর হয়েছে, তা বলা বাহুল্য। গত কয়েক দিনের সড়ক দুর্ঘটনার চিত্র থেকে বলা যায়, অবস্থা প্রায় আগের মতোই। বেশি যাত্রী তোলা ও একই রুটের বাসের আগে যাওয়ার জন্য রেষারেষি বন্ধ হয়নি। মালিক-শ্রমিক নেতাদের ঘোষণাও মানছে না অনেকে। এর মধ্যেই গত বুধবার (১৯ সেপ্টেম্বর) বেসরকারি সংগঠন নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির (এনসিপিএসআরআর) নিয়মিত মাসিক জরিপ ও পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনের মাধ্যমে প্রকাশ করে যে গত আট মাসে ৩ হাজার ১৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪১১ নারী ও ৪৫৩ শিশুসহ ৩ হাজার ২০২ জন নিহত ও ৭ হাজার ৮৮৩ জন আহত হয়েছে। জাতীয় মহাসড়ক, আন্তঃজেলা সড়ক ও আঞ্চলিক সড়কসমূহে এসব প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা ঘটে। তবে জুলাই মাসের তুলনায় আগস্টে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানিÑ দুটোই কমেছে। ২২টি বাংলা ও ইংরেজি জাতীয় দৈনিক, ১০টি আঞ্চলিক সংবাদপত্র, আটটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও সংবাদ সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২৯ জুলাই থেকে সপ্তাহব্যাপী রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ছাত্র আন্দোলন এবং প্রধানমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে সড়ক পরিবহন খাতে বিশৃঙ্খলা কমতে শুরু করেছে। জুলাইয়ের তুলনায় আগস্টে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি কমেছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, জুলাইয়ে ৩৪৬টি দুর্ঘটনায় ৪৪ নারী ও ৬৭ শিশুসহ ৩৭৪ জন নিহত হয়। চলতি বছরের আগস্টে ৩১৪টি দুর্ঘটনায় ৫০ নারী ও ৬০ শিশুসহ নিহত হয় ৩৫৭ জন। তবে জুলাইয়ে আহতের সংখ্যা ৯০২ হলেও আগস্টে তা বেড়ে ১ হাজার ৬ জন হয়েছে। এ ছাড়া দুর্ঘটনা রোধসহ সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ও পুলিশ প্রশাসনের তৎপরতা অনেক বাড়লেও তা পর্যাপ্ত নয় বলে প্রতিবেদনে দাবি করা হয়।

জাতীয় কমিটির পর্যবেক্ষণে বলা হয়, খোদ রাজধানীতে ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করে বেপরোয়া গাড়ি চলাচল, ভাঙা অবকাঠামোযুক্ত রংচটা বাসে যাত্রী পরিবহন, অপ্রাপ্তবয়স্কদের দিয়ে লেগুনা ও ইজিবাইক চালানো, ফুটপাত দিয়ে মোটরসাইকেল চলাচল এবং সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা লঙ্ঘন করে মহাসড়কে তিন চাকার যানবাহন চলাচলের ঘটনা অহরহ ঘটছে। তবে বিআরটিএ ও পুলিশের বর্তমান তৎপরতা বছরজুড়ে অব্যাহত থাকলেও নিকট ভবিষ্যতে দুর্ঘটনা ও সড়কের বিশৃঙ্খলা অনেক কমে আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, জানুয়ারিতে ৪০৩টি দুর্ঘটনায় ৫৪ নারী ও ৩০ শিশুসহ ৪২৫ জন নিহত ও ৯৩৩ জন আহত হয়েছেন। ফেব্রুয়ারিতে ৩৭৩ দুর্ঘটনায় ৫৩ নারী ও ৪৮ শিশুসহ ৪১৩ জন নিহত ও ৯৯৫ জন আহত হয়েছেন। মার্চে ৩৭৯টি দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত হয়েছেন যথাক্রমে ৩৮৫ ও ৯৭১ জন; নিহতের তালিকায় ৫৩ নারী ও ৭৯ শিশু রয়েছে। এপ্রিলে ৪০৮টি দুর্ঘটনায় ৫০ নারী ও ৫০ শিশুসহ ৩৮৯ জন নিহত ও ১ হাজার ৩২ জন নিহত হয়েছে। মে মাসে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩৬৩টি। এতে ৪০ নারী ও ৫১ শিশুসহ নিহত হয়েছেন ৩৮১ জন এবং আহত হয়েছেন ৮৪৬ জন। জুনে ৪২৭টি দুর্ঘটনায় ৬৭ নারী ও ৬৮ শিশুসহ ৪৭৮ জন নিহত ১ হাজার ১৯৮ জন আহত হয়েছেন। দুই ঈদে দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, ১২ জুন থেকে ২৪ জুন পর্যন্ত ১৩ দিনে ঈদ যাতায়াতে (ঈদুল ফিতর) ২১১টি দুর্ঘটনায় ৩৭ নারী ও ৩২ শিশুসহ মোট ২৪৮ জন নিহত ও ৭১৭ জন আহত হয়েছেন। ১৫ আগস্ট থেকে ২৫ আগস্ট পর্যন্ত ১১ দিনে ঈদ যাতায়াতে (ঈদুল আজহা) দুর্ঘটনা ঘটেছে ৯৬টি। এসব দুর্ঘটনায় ২২ নারী ও ২১ শিশুসহ মোট ১৪২ জন নিহত ও ৩১৮ জন আহত হয়েছেন।

গত ৩ আগস্ট কয়েকটি পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, সারা দেশে এখন ত্রুটিপূর্ণ ফিটনেসবিহীন যানবাহনের সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ। আর যানবাহনের তুলনায় লাইসেন্সধারী চালকের সংখ্যা ৯ লাখের কম। অর্থাৎ ৯ লাখ যানবাহন চালাচ্ছেন অদক্ষ লাইসেন্সহীন ভুয়া চালক। একদিকে ভুয়া অদক্ষ লাইসেন্সবিহীন চালক আর অন্যদিকে ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন। এই দুইয়ে মিলে সড়ক-মহাসড়ক অনিরাপদ করে তুলেছে। ওই প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা ইনস্টিটিউটের গবেষণা বলছে, দেশে ৫৩ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর কারণে। আর চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে ৩৭ শতাংশ। শতকরা ৯০ ভাগ দুর্ঘটনা ঘটে অতিরিক্ত গতি আর চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে। এ ছাড়া যানবাহনে ত্রুটি, পরিবেশ পরিস্থিতি ও অন্যান্য কারণে দুর্ঘটনা ঘটে ১০ শতাংশ।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকালে সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল সড়ক দুর্ঘটনা রোধে যা যা করা দরকার, তার সবকিছুই করা হবে। সে প্রতিশ্রুতি পূরণের অংশ হিসেবে রাজধানীসহ সারা দেশের সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে এবং দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে গত ২৭ আগস্ট সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা পরিষদের সভায় ১৮টি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এসব সিদ্ধান্ত দ্রুত বাস্তবায়নের ওপরও জোর দেওয়া হয়। মহাসড়কে ৮০ কিলোমিটার গতির ওপরে যানবাহন চালানোর ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। ঢাকায় বাসগুলোর প্রতিযোগিতা বন্ধে চুক্তিভিত্তিক চলাচল বন্ধ করার আগের সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে হবে। মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে বাস, ট্রাক চালকদের জন্য বিশ্রামাগার স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মহাসড়ক থেকে নসিমন, করিমন, ভটভটি, অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত যানবাহন চলাচল বন্ধে আরো কঠোর হওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। বাস্তব ক্ষেত্রে সড়ক মহাসড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে বিভিন্ন সময় নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বা নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু সেসব সিদ্ধান্ত যেন কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকছে। বাস্তবায়নে জোর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না হামেশা। বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া যানবাহন চালানো অপরাধ। এ জন্য জেল-জরিমানার বিধান রয়েছে। কিন্তু হাজার হাজার অদক্ষ চালক ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়াই যানবাহন চালাচ্ছেন। এ জন্য কারও শাস্তি কিংবা জেল-জরিমানা হয়েছে, এমন দৃষ্টান্ত নেই বললেই চলে। বিচার ও শাস্তি হয় না বলে বেপরোয়া চালকদের দৌরাত্ম্যও কমছে না। কয়েক দিন আগে যাত্রীকল্যাণ সমিতি সড়ক দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে কিছু বিষয় তুলে ধরেছে। ফিটনেসবিহীন যানবাহনের অবাধে চলাচল, অদক্ষ, লাইসেন্সবিহীন চালকের বেপরোয়া গতিতে যানবাহন চালানো, পণ্যবাহী যানবাহনেও বিপজ্জনকভাবে যাত্রী পরিবহনকে তারা সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে। বিভিন্ন সময় বিশেষজ্ঞরাও প্রায় একই ধরনের কারণের কথা বলেছেন। দুর্ঘটনা ঘটার এসব কারণগুলো দূর করা মোটেও কঠিন কিছু নয়। এ ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন, সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও কর্মকর্তাদের যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করা। তা না করলে জবাবদিহি ও শাস্তির ব্যবস্থা থাকা অবশ্যই জরুরি।

পরিশেষে বলা যায়, একটি দুর্ঘটনা ঘটার পর আমরা মর্মাহত হই, দুঃখ প্রকাশ করি এবং ক্ষমতা থাকলে আন্দোলন করি। এসব করেই কি দায়দায়িত্ব শেষ? কেন হচ্ছে এসব! সড়কে মৃত্যুর মিছিল কেন থামছে না? এ নিয়ে কি কারো মাথা ব্যাথা আছে? কেউ কি আছেন চালকদের নিয়ন্ত্রণ করার? দুঃখজনক হলেও সত্য যে, নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনে ছাত্ররা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, যারা এসব নিয়ন্ত্রণ করার কথা, তারা বেখবর। তাদের গাড়ির কাগজ নেই, চালকের লাইসেন্স নাই এবং লেন ছাড়া উল্টো পথে চলেন তোয়াক্কা করে না

আইনের। আইনের প্রতি সবার শ্রদ্ধাশীল হওয়া জরুরি। এ ক্ষেত্রে যারা আইন প্রয়োগ করবেন, তাদেরও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলসহ সব নাগরিক যদি নিজ নিজ অবস্থান থেকে সচেতন হন, আইনের প্রতি হন শ্রদ্ধাশীলÑ তাহলে দেশে কোনো অনিয়ম থাকবে না। কমবে দুর্ঘটনা, বাঁচবে অসংখ্য প্রাণ।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close