ইয়াসমিন রীমা

  ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

পর্যবেক্ষণ

নতুন দিগন্তে কৃষিবিপ্লব

প্রযুক্তি বিস্তারে উন্নয়নের সমৃদ্ধিতে ভরে উঠুক বাংলাদেশের দিগন্ত। বর্তমান সরকারের এ রকম অঙ্গীকার বাস্তবায়নে দেশের প্রতিটি জেলার ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শুরু করা হয়েছে প্রযুক্তি ব্যবহার। জনসাধারণ এখন প্রতিটি ইউনিয়ন কেন্দ্র থেকে পেতে শুরু করেছে তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় সুবিধাসমূহ। এখন আর তাদের জমির খতিয়ানের জন্য ডিসির অফিসে দিনের পর দিন ধরনা দিতে হয় না। ঘরদোরে ইউনিয়ন তথ্যকেন্দ্রে সামান্য খরচে অতি অল্প সময়ে পেয়ে যাচ্ছেন ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে।

জেলা বগুড়া উপজেলার শাজাহানপুর কামারপাড়া। একটি সংগঠন। সংগঠনের সদস্য-সদস্যা কৃষক আর কৃষাণী ও কিছু শিক্ষার্থী। সংগঠনের কর্মের প্রচেষ্টা কৃষিকাজে কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের ব্যবহার না করে ভেষজ কীটনাশক ও কম্পোস্ট সার প্রয়োগের মাধ্যমে কেমন করে জমিতে ফসল উৎপাদন সম্ভব করা হচ্ছে। পাশাপাশি সেসব প্রচেষ্টার ভিডিওচিত্র ধারণ করে অন্যান্য কৃষিপ্রধান এলাকার মধ্যে প্রচার করে উদ্যোগী করা। স্থানীয় মানুষের কাছে যা কিনা ডিজিটাল পদ্ধতিতে কৃষিকাজ কিংবা ডিজিটাল কৃষিবিপ্লব নামে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করছে।

বগুড়া জেলাকে সবজি চাষের ক্ষেত্রে দেশের একটি প্রধান অঞ্চল হিসেবে গণ্য করা হয়। করতোয়া নদীবিধৌত এলাকা শাজাহানপুর উপজেলার কামারপাড়ায় অধিক সবজির চাষ হয়। আর এই কামারপাড়াতেই গড়ে উঠেছে ‘অংশগ্রহণমূলক গ্রামীণ ভিডিও কেন্দ্র’। যেখানে কৃষকরা এসে কৃষিকাজের বিভিন্ন পরামর্শ করা ছাড়া স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ভেষজ কীটনাশক ও কম্পোস্ট সার সংগ্রহ করে নিয়ে যায়। পুরো গ্রামেই বাড়ি বাড়ি কেঁচো কম্পোস্ট সার তৈরির ব্যবস্থা রয়েছে এবং ভেষজ কীটনাশক তৈরির ব্যবস্থাও আছে।

অথচ দেড় যুগের অধিক আগেও উত্তরাঞ্চলজুড়ে যখন সারের সংকট ছিল ব্যাপক, সেই সংকটসময়ে কামারপাড়ার ২৫ জন কৃষক ‘প্রান্তিক কৃষক সমবায় সমিতি’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। এই প্রান্তিক কৃষক সমবায় সমিতির সদস্যরা কৃষি বিভাগ ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের কাছ থেকে যৌথভাবে সার সংগ্রহ করে এনে নিজেরা স্বল্প পরিমাণের সেই সার জমিতে প্রয়োগ করে উৎকৃষ্ট ফসল উৎপাদনের চেষ্টা চালাতো। চেষ্টায় যার জমিতে ভালো ফসল উৎপাদন হতো, তার কাছ থেকে জমি পরিচর্যার কলাকৌশল জানার অভিপ্রায়ে নিজেরা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করত। প্রান্তিক কৃষক সমবায় সমিতির সদস্যদের আলাপ-আলোচনার আসরটি বসার জন্য গ্রামে একটি ঘর নির্মাণ করা হয়। তাদের আলোচনা মূল বিষয়ই ছিল, কী করে নিজেদের জমিতে ভালো ফসল উৎপাদন করা সম্ভব। রুস্তুম আলী নামে এক ব্যক্তি এলাকায় সে সময় কীটনাশক ও সার পরিবেশকের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল। এলাকার কৃষকরা অধিক মূল্যে সার-কীটনাশক ক্রয় করে জমিতে না প্রয়োগ করে অন্য কোনো উপায়ে চাষ করা যায় কি নাÑসার-কীটনাশক পরিবেশক রুস্তম আলীর কাছে শরণাপন্ন হয়। রুস্তম আলী এ বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমিতে (আরডিএ) যায়। আরডিএতে পৌঁছে একাডেমির বিধি মোতাবেক নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে চাষাবাদের ওপর একটি বাস্তব প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। প্রশিক্ষিত হয়ে রুস্তম আলী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এলাকার কৃষকদের জানান দেন বাজার থেকে অধিক মূল্যে সার-কীটনাশক ক্রয় করা ছাড়াও ফসল উৎপাদন করা সম্ভব।

রুস্তম আলীর পরামর্শ দেওয়ার পর এলাকায় তিনি ফসলের ডাক্তার হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তার পরামর্শ হলোÑজমির আইলসহ গ্রামের বিভিন্ন ঝোপঝাড়ে বিষকাটালি, নিম, নিশিন্দা, থানকুনি, পীতরাজ ও মেহগনিসহ যেসব উদ্ভিদ জন্মে, সেসব থেকে বাড়িতেই ভেষজ কীটনাশক তৈরি করা সম্ভব। আর রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জমিতে প্রয়োগ করা যেতে পারে আবর্জনার কম্পোস্ট ও কেঁচো (ভার্মি) কম্পোস্ট সার।

সেসময়ের কৃষক সমিতির উদ্যোক্তা মাহফুজার রহমান বলেন, রুস্তম আলী ভেষজ কীটনাশক ও কম্পোস্ট সার তৈরির পরামর্শ দিলেও কৃষকরা কীভাবে তা প্রস্তুত করবে, তা বুঝে উঠতে পারছিল না। তখন নারীকর্মীদের সংম্পৃক্ত করার বুদ্ধি উপস্থাপিত হয়। এর অংশ হিসেবে চারজন মহিলা ও তিনজন পুরুষ সমন্বয়ে গঠন করা হয় একটি দল। এই দলে যুক্ত হয় বগুড়া সরকারি মুজিবুর রহমান মহিলা কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রী রেহেনা খাতুন, রাধানগর মহিলা মাদরাসার আলিম দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী সাদিয়া আক্তার, নবোদয় কারিগরি বিদ্যালয়ের ছাত্রী রোজী আক্তার ও শেরপুর ডিগ্রি কলেজের ছাত্রী মৌসুমী খাতুন। পুরুষদের মধ্যে সংযুক্ত হয় কৃষক সমিতির ভূতপূর্ব উদ্যোক্তা মাহফুজার রহমান, আনছার আলী ও আবদুল মোমিন এবং সমন্বয়কারী হিসেবে থাকেন রুস্তম আলী। এই সাতজনের সঙ্গে কমিউনিটি সদস্য হিসেবে যুক্ত হন গ্রামের আরো ১৮ মহিলা এবং ২৪ পুরুষ।

গ্রামীণ নারী-পুরুষের সমন্বয়ে এই প্রক্রিয়ায় ফসল উৎপাদনের সহজ এবং কার্যকর প্রক্রিয়াটি প্রচার হওয়ার পর বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রতিনিধিদল পরিদর্শনে আসে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের পরামর্শে সেখানে ‘ফোস্টারিং উইমেন ভয়েসেস থ্রু ভিডিওস ইন বাংলাদেশ’ প্রকল্পের আওতায় স্থাপন করা হয় ‘অংশগ্রহণমূলক গ্রামীণ ভিডিও কেন্দ্র’। এই কেন্দ্রের মাধ্যমে কৃষকদের অংশগ্রহণমূলক ভিডিও তৈরি, কম্পিউটার ব্যবহার এবং জৈব (অর্গানিক) কৃষির নানা দিক ও বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে কামরপাড়ার কৃষকরা নানা পদ্ধতি অবলম্বন করে যেসব বিষমুক্ত ফসল উৎপাদন করেন এবং স্থানীয়ভাবে যেসব খাবার তৈরি করেন, সেসব ভিডিওচিত্রে ধারণ করে অন্য জেলার কৃষকদের প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়।

অংশগ্রহণমূলক ভিডিও কেন্দ্র স্থাপনের পর এ-যাবৎ ওই দলের সদস্যরা ভেষজ কীটনাশক তৈরির উপায়, কেঁচো কম্পোস্ট বা ভার্মি কম্পোস্ট সার তৈরির কলাকৌশল পলিথিন দিয়ে নির্মিত শেডে গ্রীষ্মকালীন পালংশাকের চাষ, মরিচের ফুলের আচার তৈরি এবং ভার্মি কম্পোস্ট ও ভেষজ বালাইনাশক ব্যবহার করে বিষমুক্ত বেগুন চাষের ওপর ভিডিওচিত্র ধারণ করে তা অন্যান্য এলাকার কৃষকদেরর মধ্যে প্রদর্শন করার উদ্যোগ নিয়েছেন। এই কেন্দ্রের পথ অনুসরণ করে ইতোমধ্যে কিশোরগঞ্জ সদর, টাঙ্গাইলের মধুপুর, ময়মনসিংহের গৌরীপুর, বগুড়ার শেরপুর, রংপুরের মিঠাপুকুর এবং গাইবান্ধা পলাশবাড়ীতে সাতটি কৃষক দল সংগঠিত হয়েছে। কামারপাড়া কেন্দ্রের কৃষক ও সংগঠকরা সেসব কেন্দ্রে গিয়ে স্থানীয় কৃষকদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি তাদের তৈরি ভিডিওচিত্রগুলো প্রদর্শন করছে। তা ছাড়া কামারপাড়ার কৃষকদের তৈরি এই ভিডিওচিত্রগুলো শিক্ষা উপকরণ করে সংযোজন-বিয়োজনের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন এলাকার কৃষকদের মধ্যে প্রদর্শনের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রটি।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি সম্প্রাসরণ শিক্ষা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. আসাদুজ্জামান সরকার বলেন, ‘কৃষিপ্রযুক্তি বিস্তারে ভিডিও একটি শক্তিশালী ও সময় উপযুগী কার্যক্রম। তাই বিষমুক্ত নিরাপদ সবজি বা ফসল উৎপাদনের অন্য এলাকার কৃষকরা তাতে উপকৃত হবেন।’

লেখক : গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close