শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ

  ২৮ আগস্ট, ২০১৮

শ্রদ্ধাঞ্জলি

মানবতার প্রতীক মাদার তেরেসা

মাদার তেরেসা সেই মহীয়সী নারী, যিনি আর্তমানবতার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করে সারা বিশ্বের মানুষের হৃদয়ে আজও অমর হয়ে আছেন এবং থাকবেন। বিভিন্ন বয়সী ছেলেমেয়ে, যারা বিভিন্ন দিক থেকে সমাজে অবহেলিতÑ মাদার তেরেসা তাদেরই বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। এই মহাত্মা নারীর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

মাদার তেরেসা রোমান ক্যাথলিক সম্প্রদায়ভুক্ত বিশ্বখ্যাত সমাজ সেবিকা। তার জন্ম আলবেনিয়ায় ১৯১০ সালের ২৬ আগস্ট। প্রাথমিক লেখাপড়া জন্ম শহর স্কেপিয়েতে। তার পুরো নাম আগ্নেস বোইয়াক্সিউ। ডাক নাম গোস্কসা। গোস্কসা মূলত একটি তুর্কি শব্দ; যার অর্থ ‘কুসুমকলি’। তিন ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। তার বাবা ছিলেন একজন রাজনীতিবিদ। তাদের পরিবারটি ছিল অত্যন্ত সুখী। কিন্তু ভাগ্যের এমনই নির্মম পরিহাস, মাত্র ৯ বছর বয়সে মাদার তেরেসাকে পিতৃহারা হতে হয়। শুধুমাত্র বাসস্থানটুকু ছাড়া সর্বস্ব হারিয়ে মহাবিপদের সম্মুখীন হতে হয় পরিবারটিকে। আকস্মিক এই বিপর্যয়ের ফলে তেরেসার মা ভীষণভাবে মুষড়ে পড়েন। সংসারের সব দায়দায়িত্ব এসে পড়ল তেরেসার বড় বোন অ্যাগের ওপর। কাপড় বিক্রি ও অ্যামব্রয়ডারির ব্যবসা দিয়ে তাদের বেঁচে থাকার সংগ্রাম শুরু হলো। জীবনের এই সংগ্রাম থেকে দারিদ্র ও প্রতিকূলতাকে সাহস ও উদ্দীপনার সঙ্গে গ্রহণ করার তৎপরতা আবিষ্কার করেন মাদার তেরেসা। তেরেসার লেখালেখির হাত খুব ভালো ছিল। তাই অনেকেই ধারণা করেছিলেন, লেখালেখি করেই তিনি জীবিকা নির্বাহ করবেন। কিন্তু তার আগ্রহ ছিল মানবসেবায়। মাত্র ১৮ বছর বয়সে তিনি ঠিক করলেন সন্যাসব্রত গ্রহণ করার। তৎকালীন সময়ে ভারতে বাংলায় ধর্মীয় কাজ করতেন যুগোশ্লাভীয় ধর্মযাজকরা। তাদের সিদ্ধান্ত ছিল, লরেটা সিস্টারদের মধ্যে যারা আইরিশ সম্প্রদায়ভুক্ত তারা যাবেন ভারতবর্ষের মতো এলাকায় কাজ করতে। অ্যাগনেস (মাদার তেরেসা) তাই তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ শুরু করতে চাইলেন। কিন্তু এই কাজ পেতে হলে, তাকে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। পরীক্ষাটি অনুষ্ঠিত হবে প্যারিসে। মাত্র ১৮ বছর বয়সে যার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য বিনয়ী, নম্র এবং পরোপকারে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করা, তাকে কি কোনো পরীক্ষায় পেছনে ফেলা যায়? আর যায় না বলেই হয়তো প্যারিসের সাক্ষাৎকারে সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হওয়ার পর তেরেসা ও তার সঙ্গীকে পাঠানো হলো আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে তাদের সন্ন্যাস জীবনের প্রশিক্ষণ এবং ইংরেজি শিক্ষার জন্য।

প্রশিক্ষণ পর্বের প্রায় ৬ সপ্তাহ শেষে ১৯২৮ সালের পহেলা ডিসেম্বর দুই সন্ন্যাসিনী সুদূর ভারতবর্ষের উদ্দেশ্যে সমুদ্র পথে পাড়ি দিলেন। জাহাজেই পরিচয় হলো তিনজন অল্প বয়সী ফ্রানসিস্কান সিস্টারের সঙ্গে। একত্রে উদ্যাপিত হলো পবিত্র বড়দিন। ১৯২৯ সালের ৬ জানুয়ারি তারা কলকাতা পৌঁছালেন। এরও প্রায় চার মাস পর ১৯২৯ সালের ২৩ মে অ্যাগনেসের নাম হলো ‘তেরেসা’। এই ‘তেরেসা’ নামটির অন্তরালে একটি ছোট্ট ইতিহাস আছে; তেরেসা ছিল মূলত লিসিউ কনভেন্টের জনৈক ফরাসি কারমেলাইট সন্ন্যাসিনীর নাম। ইনি খুব অল্প বয়সে মারা গিয়েছিলেন এবং এই শিক্ষা দিয়েছিলেন, নিজেকে হাসি-খুশি ও প্রসন্ন রাখলে নিতান্ত সাধারণ বা একঘেয়ে কাজের মাধ্যমেও সৃষ্টিকর্তার সেবা করা যায়। তিনি এর সংক্ষিপ্ত নাম দিয়েছিলেন ‘দি লিটিল ওয়ে’। ১৯৩১ সালের ২৪ মে সর্বপ্রথম দারিদ্র, বাধ্যতা ও সংযমের সাময়িক সংকল্প গ্রহণ করেন তেরেসা। সিস্টার তেরেসার নতুন প্রশিক্ষণ শুরু হলে তাকে হিমালয়ের কোলের ছোট্ট শহর দার্জিলিংয়ে পাঠানো হলো। লরেটো কনভেন্ট স্কুলে শুরু হলো তার শিক্ষিকা জীবন। পাশাপাশি তিনি স্থানীয় একটি হাসপাতালেও কাজ করতেন। এখানেই সর্বপ্রথম দুঃখ ও দারিদ্রতার সঙ্গে তাকে সংগ্রাম করতে হয়, যা ছিল তার কল্পনারও বাইরে! দার্জিলিংয়ের কাজের মেয়াদ শেষ হলে তেরেসাকে আবার ফিরে আসতে হলো কলকাতায়। পাহাড়ি দেশের বিশুদ্ধ বাতাস, আর ফুলে ছাওয়া প্রান্তর ছেড়ে কলকাতা মহানগরীর পূর্বপ্রান্তের বস্তি এলাকায় এন্টালিতে লরেটো সিস্টারদের ডেরায় বসবাস করার জন্য চলে এলেন তিনি। সিস্টাররা যে কেবলমাত্র এন্টালি লরেটোর মতো বিরাট আবাসিক ধনী সন্তানদের পড়াতেন তাই নয়, ওই একই গন্ডির মধ্যে ছিল সেন্ট মেরিজ স্কুল। সেখানে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র পরিবারের ছেলে-মেয়েরা পড়তে আসত। সেন্ট মেরিজ স্কুলে ইতিহাস ও ভূগোল বাংলাভাষায় পড়ানোর দায়িত্বে নিয়োজিত হলেন সিস্টার তেরেসা। শিক্ষক হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত ভালো এবং সফল। কারণ, পাঠ্য বিষয়গুলোকে তিনি ছাত্রছাত্রীদের কাছে জীবন্ত করে তুলতে পারতেন। তার এই শিক্ষক জীবন ছিল ব্যস্ত তায় ভরা অথচ সুখী। তিনি ভেবেছিলেন, তার জীবন বুঝি এভাবেই কেটে যাবে। কিন্তু ১৯৩৭ সালের ১৪ মে সিষ্টার তেরেসা তার জীবনের অন্তিম সংকল্প গ্রহণ করলেন। সন্ন্যাসিনীর জীবন বেছে নিয়ে সেন্ট মেরিজ স্কুলের অধ্যক্ষ হলেন। তখনকার দিনে সন্ন্যাসিনীরা মঠের চৌহদ্দির মধ্যেই কঠোরভাবে আবদ্ধ থাকতেন। হাসপাতাল যাওয়া বা অন্য কোনো জরুরি প্রয়োজন ছাড়া তারা মঠের বাইরে বের হতেন না। মঠের চৌহদ্দির বাইরে ‘সেন্ট তেরেসা’ স্কুলে তিনিই প্রথম ছাত্রছাত্রীদের পড়াতে আরম্ভ করেন। ১৯৪৬ সাল মানব ইতিহাসের কলঙ্কময় কাল। এই সময়ই পৃথিবীর বুকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংগঠিত হয়। সেই সময়ের একটি রাতে, যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে একদিন সিস্টার তেরেসা তার ছাত্রছাত্রীদের জন্য খাবার খুঁজতে রাস্তায় বের হলেন। রাস্তায় তখন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে মানুষের লাশ আর লাশ। এসব লাশ দেখে খুব স্বাভাবিক ভাবেই আতঙ্কিত হয়ে উঠলেন তিনি। ভয়ে তার শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল। দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের আর্তনাদে তিনি অবিচল হয়ে উঠলেন। এরই মাঝে হঠাৎ লরি বোঝাই সেনাদল, সিস্টার তেরেসাকে দাঁড় করালেন এবং তাড়াতাড়ি মঠে ফিরে যেতে নির্দেশ দিলেন। সিস্টার তেরেসা তখন কঠোর কিন্তু শান্তভাবে তাদের জবাব দিলেন, আমার মঠের ৩০০ মেয়ের এতটুকু খাবার নেই, তাদের জন্য খাবার চাই-ই। ফৌজির দল সিস্টারের সাহস আর অন্যের প্রতি ভালোবাসা দেখে অবাক হয়ে গেলেন। তারা তখন সিস্টার তেরেসার জন্য চাল সংগ্রহ করে মঠে পৌঁছে দিলেন। তখনো তেরেসার আশ্রমের সিস্টাররা ক্যাথলিক চার্চের স্বীকৃতি পাননি। কিন্তু তারা একান্তভাবেই সন্ন্যাসিনীর জীবনযাপন করতেন। তাদের মনে বিশ্বাস ছিল, একদিন তারা যথাযথ স্বীকৃতি পাবেন। সমাজসেবা করতে গিয়ে সিস্টারদের পড়াশোনার যাতে ক্ষতি না হয়, সেদিকে তেরেসার বিশেষ নজর ছিল। এভাবে ক্রমেই সন্ন্যাসিনীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। খুব সংক্ষিপ্ত আর সীমিত কার্যকালের মধ্যে সিস্টার তেরেসা ও তার সঙ্গী-সাথিরা যে বিপুল কাজ করেছেন এবং তাদের ভবিষ্যৎ কর্মসূচির নমুনা দেখে বিস্ময় আর আনন্দের সীমা রইল না আর্চবিশপের। মিশনের সংবিধানও গৃহীত হলো ১৯৫০ সালের ৭ অক্টোবর। মিশনারিজ অব চ্যারিটিকে স্বীকৃতি দিল ক্যাথলিক চার্চ এবং স্বয়ং পোপ। সিস্টার তেরেসা, যিনি একসময় ছিলেন লরেটোর শিক্ষিকা, তারপর প্রধান শিক্ষিকা। পরবর্তীতে তিনিই হলেন মিশনারিজ অব চ্যারিটির প্রতিষ্ঠাতা মাদার তেরেসা। সম্ভবত তিনি নিজেও অনুমান করতে পারেননি, তার আশ্রমের সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি কতদূর বাস্তবায়িত হতে পারে! প্রথমে যখন তিনি সেন্ট জোসেফের প্রাঙ্গণ থেকে পথে নেমেছিলেন, তখন এই বিশ্বাস তার মনে ছিল, কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্যই তিনি নিজেকে নিযুক্ত করছেন। কিন্তু একা, মাত্র পাঁচ রুপি হাতে নিয়ে তিনি যখন রাস্তায় নেমেছিলেন, তিনি কি জানতেন, যে সমাচার তিনি বহন করে আনছেন তা কতদূর বিস্তৃত ও সমৃদ্ধ...?

জীবনে ত্যাগ স্বীকার করলে সেই কাজের স্বীকৃতি নিশ্চয়ই পেতে হবে। তারই প্রমাণ মাদার তেরেসা। তিনি জীবনে বিভিন্ন সরকার ও প্রতিষ্ঠান থেকে বহু পুরস্কার পেলেও এই নিয়ে তার কোনো গর্ব ছিল না। বরং তিনি পুরস্কার হাতে নিয়ে বিব্রত কণ্ঠে বলতেন, ‘আমি অতি ক্ষুদ্র। আমার শক্তি হচ্ছে আমার কর্মীবাহিনী আর জনগণের ভালোবাসা। এই পুরস্কার তো তাদের প্রাপ্য!’ মাদার তেরেসা প্রথম পুরস্কার পান ১৯৬২ সালে। ভারত সরকার ‘পদ্মশ্রী’ উপাধিতে তাকে ভূষিত করেন। পরবর্তীতে দুঃস্থ মানবতার সেবায় আত্মোৎসর্গের স্বীকৃতিস্বরূপ মাদার তেরেসা ১৯৭৯ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। এ ছাড়া ১৯৭১ সালে পোপ জন শান্তি পুরস্কার, ১৯৭২ সালে জওহরলাল নেহরু এবং ভারতরতœ পুরস্কার পান। তিনি ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মোট ৮৪টি পুরস্কার ও সাম্মানিক উপাধিতে ভূষিত হন। মাদার তেরেসাকে অমর করে রাখার সবচেয়ে বড় প্রয়াসটি জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার। বিশ্বের ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে যারা দুই মুঠো অন্ন পৌঁছে দেন তাদের পক্ষে এই স্বীকৃতি হলো সেরেস মেডেল। এই মেডেলের এক পিঠে রয়েছে ভিক্ষাপাত্র হাতে অপুষ্টিতে ভোগা একটি শিশুর মূর্তি আর অপর পিঠে রয়েছে মাদার তেরেসার ছবি। ১৯৮৫ সালে জাতিসংঘের সে সময়কার সেক্রেটারি জেনারেল পেরেজ দ্য কুয়েলার মাদার তেরেসা সম্পর্কে এক সভায় বলেছিলেন, পৃথীবির সবচেয়ে শক্তিশালী মানবী হচ্ছেন মাদার তেরেসা।

আর্তমানবতার প্রতীক মাদার তেরেসা সারাটা জীবন কাজের মাঝে ডুবে ছিলেন। অবশেষে ১৯৯৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর কলকাতার মাদার হাউসে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই মহাত্মা নারী। তার শেষ কথাটি ছিল, ‘আমি আর শ্বাস নিতে পারছি না!’ মাদার তেরেসা আজ আমাদের মাঝে নেই কিন্তু মানবতার প্রতীক হিসেবে তিনি অমর হয়ে থাকবেন সারা বিশ্ববাসীর কাছে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close