মোবারক হোসেন
মতামত
চিন্তার আঙিনায় শিল্প সমন্বয়
‘এখন ধান চাষের জন্য নতুন নতুন মেশিন তৈরি করছে বগুড়ার মানুষ। আবার একটা মেশিন বাজারে পাওয়া যাচ্ছে, সেটার অবিকল যন্ত্রাংশ তৈরি করছে ঢাকার দোলাইরপাড়ের কারিগররা। এই মেধাগুলোর পাশে যদি প্রফেসনাল প্রকৌশলীরা দাঁড়াতেন, তাহলে অবশ্যই বাংলাদেশ শিল্পে অনেক উন্নত হতো।’ কথাগুলো বলেছেন ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত।
কয়েক দিন আগে তরুণ প্রকৌশলীদের এক সেমিনারে বিশিষ্ট পানিবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নিশাতের গভীর অনুভূতিসম্পন্ন এ বক্তব্য অনেকের মনের সুপ্ত চেতনাকে নতুনভাবে জাগিয়ে দিতে পারে। সৃষ্টিকর্মের খ্যাতিবিহীন শিল্পকর্মীরা দেশের যেসব সেক্টরে নিজ নিজ পরিসরে কৃতিত্ব দেখিয়ে চলেছেন, যাদের দৃষ্টিতে সৃষ্টি, তাদের শ্রম-ঘাম মেশানো নিরলস কর্মের ধারা নিরন্তর বয়ে চলা নদীর মতো অন্তহীন। এ বক্তব্য অনেকের বুকের গহিনে প্রেরণা জাগাতে পারে শিল্প সৃষ্টির। কিন্তু এই কর্মসৃজনী মুক্তধারায় তাদের মূল্যায়ন কী?
অধ্যাপক আইনুন নিশাতের বক্তব্য ছিল, প্রকৌশলীদের উদ্যোক্তা হওয়ার বাসনাকে উদ্বুদ্ধ করতে, পড়াশোনা করে ডিগ্রি নিয়ে চাকরির আশায় হতাশার দিন না গুনতে আর নিজেই স্বাবলম্বী হতে। সেমিনারে যশস্বী ওই অধ্যাপক আরো বলেছেন, একজন তরুণ প্রকৌশলীর ফুল ব্যবসায়ী হওয়ার গল্প। যার হাতে শাহবাগের ফুলবাজারের গোড়াপত্তন হয়েছিল। বেকার ওই প্রকৌশলীর সেদিনের চেতনার পথচলা আজও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। হয়তো তাকে অনেকে ভুলে গেছেন। তবুও সেখানেই তার সূচনা করা পথে দিনে দিনে প্রসারিত হয়েছে ফুলের ব্যবসা; যা রাজধানীতে অনন্য উদাহরণ হয়ে আজও তার স্বাক্ষর বহন করছে। একজন প্রকৌশলী যে স্বপ্রণোদিত হয়ে সৃষ্টি করতে পারেন দীর্ঘ ইতিহাসের, তারই উদাহরণ হয়ে আছে শাহবাগের ফুলবাজার।
এখনো সেখানে নিত্যদিন সকালে প্রথামতো ফুলের বাজার বসে। গ্রামের ফুলচাষিদের কাছ থেকে ফুল এনে দেশের নানা প্রান্তের ফুল ব্যবসায়ীরা পাইকারি বিক্রি করেন এখানে। সেই ফুলই আবার চলে যায় নানা পথ ঘুরে, রাজধানীর শহুরে মহল্লার অলিগলিতে।
অধ্যাপক নিশাত তার বক্তব্যে দোলাইরপাড়ের কারিগরদের প্রতিভার কথা খুবই সমীহের সঙ্গে তুলে ধরেছেন। তারা প্রতিষ্ঠানিক প্রকৌশল-শিক্ষা গ্রহণ না করেও অনুভূতি থেকে প্রাপ্ত যে শিক্ষা, তা দিয়ে মাথা খাটিয়ে হুবহু একটা দেখা যন্ত্র তৈরি করেন। যার মান অবিকল চলে যায় পেশাদার প্রকৌশলীদের কাছাকাছি। অনেক ক্ষেত্রে তাদের পণ্য দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার হচ্ছে। অধ্যাপকের বক্তব্য, তাদের পাশে প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতার প্রকৌশলীরা দাঁড়ালে ওদের সৃষ্টকর্ম সুনিশ্চিত বিশ্বমানের হবে। কারণ, বিজ্ঞানসম্মত নিয়মনীতি মেনে আধুনিক প্রযুক্তির কারখানায় যদি এই কারিগররা পণ্য তৈরির সুবিধা পান, তাহলে সর্বগ্রহণীয় সাফল্য অনিবার্য। কিন্তু তাদের পাশে না দাঁড়িয়ে সমাজে উল্টো তাদের ভর্ৎসনা করা হয়, নকল বলে। এই হচ্ছে আমাদের উন্নয়ন চেতনায় অসংগতি।
সংবাদপত্রে প্রায় দেখা যায়, অমুক জেলার একটি ছেলে এই আবিষ্কার করেছে। ওই আবিষ্কারে এভাবে বিনিয়োগ করলে তার সাফল্য মানবসমাজে এই কাজে লাগাবে। কিন্তু কই? ওইসব আবিষ্কারের কোনো অগ্রগতির সংবাদ পরে আর চোখে পড়ে না। উদ্যোক্তার অভাবে প্রকৌশলগত সহায়তা না পেয়ে হয়তো স্ব-উদ্যোগী আবিষ্কারকরা আর অগ্রসর হতে পারেন না।
আমাদের দেশের কিছুসংখ্যক শিল্পমালিকের মধ্যে একটা প্রবণতা লক্ষ্য করার মতো। সফল শিল্পমালিকের মধ্যেও এ ধরনের মনোভাব লক্ষণীয়। প্রায় সুনিশ্চিত মুনাফা যে পণ্যে, তারা সেই পণ্য উৎপাদনে বিনিয়োগে আগ্রহী হন দ্রুত।
দেখা যায়, কোনো উদ্যোক্তা আবাসনে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছেন তখন অনেক ব্যবসায়ী হাজার কোটি টাকা নিয়ে নেমে পড়েন ওই ব্যবসায়। এতে তারা কর্মসাধনায় প্রাপ্ত বিগত সময়ের অর্জিত সাফল্য বা সম্মানগত অবস্থানের কথা বোধ হয় ভাবেন না।
আরেকটু সবিস্তারে বলতেই হয়, চানাচুর, মুড়ি বাজারজাত করা অতি সাধারণ কাজ। যে পেশা অতি সাধারণ মানুষের। শিল্পোদ্যোক্তাদের বলয়ে সেই মুড়ি নির্ভেজালের গ্যারান্টি দিয়ে প্রায় দিগুণ দামে বিক্রি করা হচ্ছে।
লবণের ক্ষেত্রেও তাই। লবণচাষিরা কেজিতে পান কয়েক টাকা, আর সেই লবণ প্রক্রিয়াজাত করে বিক্রি হয় ৩৫-৪০ টাকায়। অথচ এটা না করে শিল্পসৃষ্টির নতুন পথ তৈরি করে বিনিয়োগ করা যেত, শিল্পে রয়েছে ঘাটতি; যে ঘাটতিতে রয়েছে জাতীয় ভাবমূর্তির সংকট।
শহর-বাজারের পথে-প্রান্তরে অনেক জুতা-স্যান্ডেল দেখা যায়, যেগুলোর মান এত নিম্ন যে, সাধারণ শ্রেণির মানুষ দাম দিয়ে কিনলেও অল্প দিনেই বিনষ্ট হয়। এতে নি¤œবিত্তের ক্রেতাদের ঘাম ঝরানো টাকা অল্প সময়ে জলে যায়। এটাকে তারা ঠকে যাওয়া বললেও আসলে এটা এক ধরনের প্রতারণা। মানহীন ফাক্টরিতে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের তৈরি এসব ব্যান্ডের-জুতার মানোন্নয়নে যদি প্রকৌশলীরা মেধা খাটান, তাহলে ওইসব পণ্যের মান উন্নত হতে বাধ্য। তা না হয়ে সেই জায়গা দখল করছে চীন-থাইল্যান্ডের জুতা-স্যান্ডেল।
আবার আমাদের দেশের অনেক কারখানায় চামড়ার কিছু জুতা-স্যান্ডেল তৈরি হয়। যেগুলোর মান খুবই নিম্ন। অল্প দিনে সোল নষ্ট হয়, সেলাই খুলে যায়, গ্রাহকরা কিনে প্রতারিত হন। কিন্তু সুদৃশ্য ডিজাইনের ওইসব জুতা-স্যান্ডেল তৈরির ক্ষেত্রে কারিগরদের কোনো ত্রুটি থাকে না। শুধু যে উপাদানগুলো দিয়ে পণ্য তৈরি, সেগুলোর মান নিম্ন। প্রতিষ্ঠানিক প্রকৌশল-জ্ঞানসম্পন্ন কর্মীরা যদি এসব তদারকি করতেন, তাহলে ক্রেতারা পেতেন বিশ্বমানের জুতা-স্যান্ডেল। মান অর্জন করে এ রকম বহু জুতা-স্যান্ডেল এ দেশ থেকেই বিদেশে যাচ্ছে। তার উদাহরণ হয়ে আছে রাজশাহীর চারঘাটের বড়াল নদীর পারের পাদুকা পল্লীর কারিগরদের পণ্য।
পাড়া-মহল্লার পথের ধারে চামার সম্প্রদায়ের অনেকের জুতা নির্মাণের দোকান আছে; ক্ষুদ্র পরিসরে কিছুটা ভালো মানের সোল, আঠা ও চামড়া দিয়ে জুতা বানান তারা। সেই জুতা গ্যারান্টি দিয়ে বিক্রি করা হয়। হাতে তৈরি সেই পাদুকার মান ভালো হলেও, ভালো বলতে যে মান বোঝায়, সে রকম নয়।
দেশের ওইসব জুতা-স্যান্ডেলের সহায়কপণ্যগুলোর মান উন্নয়নে সহায়তা করলে ওই শ্রমেই ওরাই হতে পারে সেরা পাদুকা উৎপাদকদের অংশ। আমাদের বিশ্বমানের চামড়া আছে কিন্তু সেরা মানের সোল, আঠা সচরাচর চোখে পড়ে না? নানা সীমাবদ্ধতায় তারা শিল্পমানের মূলধারায় আসতে পারেননি। এরই মধ্য থেকে যে কিছু কোম্পানি সেরা মানের পাদুকা বানিয়ে রফতানি করছে না, তা কিন্তু নয়।
আরো একটা অসংগতি আমরা দেখি গ্রামীণ যানবাহনের ক্ষেত্রে। গ্রামবাংলার পথেঘাটে এখনো মানুষ রিকশাভানে শ্যালো ইঞ্জিন ব্যবহার করে ফোরহুইলারের কাজ চালায়Ñযাকে বলে ভটভটি, নসিমন, করিমন। এই অটোমোবাইলস সভ্যতার যুগে বগুড়ার কারিগররা বাহন তৈরি করে ওই শূন্যতা পূরণ করছেন; এসব বাহনের মেয়েলি নাম রেখে আমাদের প্রকৌশলী ও উদ্যোক্তাদের গ্রামীণ কারিগররা এক ধরনের নীরব বিদ্রƒপই করেছেন। ব্যর্থতার দায় মাথায় নিয়েই বলতে হবে, আমরা এখনো সেই অভাব পূরণ করতে পারিনি।
আমাদের তৈরি পোশাক বিশ্ব জয় করেছে, পক্ষান্তরে আবার দেশের বাজার মানহীন পোশাকে ভরা। বিশেষ করে নারী ও শিশু পোশাক। সেই শূন্য জায়গাগুলো পূরণ করছে ভারত ও থাইল্যান্ডের পোশাক। যারা পোশাকে বিশ্ব জয় করতে পারে, তাদের বাজারের শূন্যতা অন্য দেশ কেন পূরণ করবে? এটা কি হাস্যকর নয়? এ ক্ষেত্রে স্থানীয় বাজারের জন্য পোশাকনির্মাতাদের কারিগরি জ্ঞান ও উৎপাদিত পণ্যগুলোর মান বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করা কি দরকার ছিল না? যেসব সেক্টরে শিল্পপণ্যের মান প্রশ্নযুক্ত, সেগুলো নিষ্পন্ন করতে সরকারের তদারকি সেল করা অবশ্যই দরকার আছে।
ফিরে আসা যাক অধ্যাপক আইনুন নিশাতের কথার অংশে। ওইসব কারিগরের পাশে দাঁড়াতে হবে, তার আগে প্রতিটা ক্ষেত্রের সহায়কপণ্যের মান উন্নত করতে হবে। তারপর মূল পণ্যগুলো উৎপাদনে শিল্পমানের প্রশ্ন আসবে। এটার দায়িত্ব থাকা দরকার সরকারনিয়ন্ত্রিত কোনো মন্ত্রণালয়ের অধীনে কোনো সেলের। যেটার কেন্দ্রীয় দায়িত্ব তদারকি করবেন অধ্যাপক আইনুন নিশাতের মতো পর্যবেক্ষণ দৃষ্টির অধিকারী বিশেষজ্ঞরা। প্রয়োজনে সরকার ভিন্ন ভিন্ন প্রকল্প নিয়ে এ ধরনের পদক্ষেপের কথা ভাবতে পারে। তাহলেই কেবল জাতীয় ভাবমূর্তি সংকটে থাকা এসব শিল্পের মান-শূনতা পূরণ হতে পারে।
শুধু চানাচুর, মুড়ি, লবণ আর আবাসনের ব্যবসা নিয়ে থাকলে চলবে না; উন্নয়নশীল দেশের সারিতে স্থায়ী অবস্থান তৈরি করতে হলে এসব সেক্টরের দুর্বল অবস্থানগুলোয় তরুণ প্রকৌশলীদের কৌশলকর্মে লাগাতে হবে। বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টিয়ে নতুন নতুন খাতে বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করতে হবে; যাতে সার্বিক বিচারে দেশকে উন্নত বলা যায়। তাহলেই দেশ এগিয়ে যাবে সুষম উন্নয়নের মূলধারায়।
লেখক : অর্থনীতি ও মিডিয়া বিশ্লেষক
"