মো. মাঈন উদ্দিন
বিশ্লেষণ
থেমে যাক দুর্নীতি
‘চ্যাম্পিয়ন’ কথাটি শুনলে সবার মন চঞ্চল হয়ে ওঠে। চোখগুলো টলমল করে ওঠে খুশিতে। শিরদাঁড়া বেয়ে উঠে আসে আনন্দধারা। কিন্তু বাপু, সব চ্যাম্পিয়নই কিন্তু সব সময় আনন্দের ধারক ও বাহক নয়। সব চ্যাম্পিয়নে গৌরব মিশে থাকে না। কিছু কিছু চ্যাম্পিয়নের সঙ্গে গৌরব নয়, মিশে থাকে একরাশ গ্লানি, হতাশা ও অধপতন। এ রকম একটি চ্যাম্পিয়নের নাম দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন। কথাটি ভালো শোনা যাক আর না যাক, আমরা কিন্তু দুর্নীতিতে কয়েকবার চ্যাম্পিয়ন। অর্থাৎ অপ্রিয় হলেও সত্য যে, আমরা দুর্নীতিতে সাবেক চ্যাম্পিয়ন, যা নিঃসন্দেহে একটি জাতি, একটি দেশের জন্য হতাশা ও নিরানন্দের বিষয়। আমরা উন্নয়নের পথে তিন পা এগোলে এই সর্বনাশা ও আত্মঘাতী দুর্নীতি আমাদের দুই পা পেছনে টানে। আমরা ইতোমধ্যে উন্নয়নশীল দেশের সীমারেখা স্পর্শ করতে শুরু করেছি কিন্তু দুর্নীতির করাল গ্রাস থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে এই উন্নয়নশীল দেশের সীমারেখা স্পর্শ করা যাবে কি না কিংবা উন্নয়নশীল তকমা কতটা ধরে রাখা যাবে, সময়ই তা বলে দেবে। আমি যে কথাটা বলতে চাচ্ছি তা হলো, যে করেই হোক দুর্নীতির ভয়াল থাবা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতেই হবে। ধুমড়ে-মুচড়ে দিতে হবে দুর্নীতির আখড়া। বিষদাঁত উপড়ে ফেলতে হবে দুর্নীতিবাজদের। তাহলেই উন্নয়নশীল দেশের স্বাদ, গন্ধ, রূপ-রস ভোগের অধিকারী হতে পারব আমরা। কারণ জানেন তো, মুকুট অর্জনের চেয়ে মুকুট রক্ষা করা কঠিন।
এখন প্রশ্ন হলো, দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে দুর্নীতির তরল প্রবাহ প্রবাহিত হচ্ছে, এটা কী করে দূর করা সম্ভব? দুর্নীতিবাজদের রক্ত কীভাবে শোধন করা যাবে? আমরা একটি প্রবাদ জানিÑ ‘হোয়্যার দেয়্যার ইজ উইল, দেয়্যার ইজ ওয়ে।’ যার বাংলা অর্থ, ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। আর এই ইচ্ছাটা হতে হবে শতভাগ সৎ এবং এই ইচ্ছাটা থাকতে হবে সরকারের নীতিনির্ধারকদের। তাহলে দুর্নীতির মূলোৎপাটন হবে বলে আমার বিশ^াস। হ্যাঁ দুর্নীতি দূর করার জন্য বহু পন্থা গ্রহণ করা যায়। আমি এখানে দুটি দিকের কথা উল্লেখ করতে চাই। একটি হলো দুর্নীতিগ্রস্ত রক্ত পরিশোধনে ওষুধ প্রয়োগ করা। অর্থাৎ দুর্নীতিবাজদের শনাক্ত করে তাদের মন মননের পরিশোধন করা। তাদের কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে বোঝানো, যে দুর্নীতির কতটা ভয়াবহ। আমরা সাধারণত সরকারি অফিস-আদালতে ব্যাপক দুর্নীতি হতে দেখি। এসব ব্যক্তি মোটামুটি চিহ্নিত। যদি আমরা এই কিছু ব্যক্তির মন-মানসিকতার পরিবর্তনে সক্ষম হই, তাহলেই দুর্নীতির পরিমাণ ক্রমে ক্রমে কমে যাবে। যদি এই উপায় কাজ না করে, তাহলে ওই দুর্নীতিগ্রস্তদের আইনের আওতায় আনতে হবে। ধরে নিতে হবে তাদের রক্ত কলুষিত হয়ে গেছে। এই কলুষিত রক্ত যার শরীরেই যাবে তাকেই দুর্নীতির নেশা মোহগ্রস্ত করে ফেলবে। সুতরাং, আইনের যথাযথ প্রয়োগই এখানে কার্যকর।
আমরা দেখছি সারা দেশে বর্তমানে মাদকবিরোধী অভিযান চলছে। আমরা আশা করছি, এই অভিযানে মাদকের ব্যবহার শেষ হয়ে যাবে যদি প্রশাসন এই অভিযানকে দীর্ঘমেয়াদি করতে পারে। তেমনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে এমন একটি অভিযান পরিচালনা করা সময়ের দাবি। কারণ, দুর্নীতি একদিকে যেমন আমাদের উন্নয়নশীলতাকে ব্যাহত করছে, তেমনি এই দুর্নীতির করাল গ্রাসে মধ্যবিত্ত এমনকি মধ্যবিত্ত থেকে তৃণমূল পর্যায়ের সহজ-সরল মানুষগুলোর আজ দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। তবে একটি কথা দিবালোকের মতো সত্যÑ মাদকের সঙ্গে জড়িত চুনোপুঁটির পেছনে কলকাঠি নাড়ানো জন্য যে পরিমাণ রাঘববোয়াল রয়েছে, দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত চুনোপুঁটির পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ানো রাঘববোয়ালের পরিমাণ তারচেয়ে অনেক বেশি। সুতরাং, কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে যে পরিমাণ সাপ বেরিয়ে আসে এদের বিষদাঁত ভাঙা কিন্তু মোটেই সহজ নয়। উল্লেখ্য, আপনাদেরও হয়তো মনে আছে, কিছুদিন আগে ঢাকা শহরের সিটিং বাসগুলো উঠিয়ে দিতে এক বিশাল কর্মযজ্ঞ হাতে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এর পরিণাম কী দাঁড়াল? পরিবহনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাঘববোয়ালদের জালে আটকানো সম্ভব হয়নি। আর সিটিং বাসের চিটিংবাজি বন্ধ করাও সম্ভব হয়নি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা না হলে, দুর্নীতি তার ভাবগাম্ভীর্য অনুযায়ী চলতে থাকলে, উন্নয়নশীলতার রাস্তা দেখার যে অসীম বাসনা আমরা মনের মণিকোঠোয় লালন করছি, তা সুদূর দিগন্তে বিলীন হতে পারে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট
"