মো. মাঈন উদ্দিন

  ২৯ মে, ২০১৮

মতামত

সর্বগ্রাসী মাদক ইয়াবা

সেদিন এক বড় ভাইয়ের সঙ্গে কথা হচ্ছিল আফ্রিকার কিছু দেশ নিয়ে। তার কাছ থেকে জানতে পারলাম আফ্রিকার অনেক দেশের যুবসমাজ মাদকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত। এমনও দেখা যায়, এসব দেশে রাস্তার পাশে যুবকরা মাদক সেবন করে টলছে, এসব যুবক মাদক আর ফ্রি সেক্সে দারুণভাবে ডুবে থাকে। ফলে তারা কোনো কাজকর্মে মন বসাতে পারে না। এই সুযোগে বিদেশিরা বিভিন্ন ফেক্টরি থেকে ফায়দা লুটে নিচ্ছে। এমনকি কোটি কোটি টাকার প্রাকৃতিক সম্পদ দেশ থেকে লুট হয়ে যাচ্ছে, তবু কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই এই যুবকদের। এ থেকে বোঝা যায়, একটি দেশকে কতটা ধ্বংসের দিকে নিয়ে যেতে পারে এই সর্বগ্রাসী মাদক। অথচ এই বিনাশী মাদকের ভয়াবহ ছোবলে বাংলাদেশ আজ দারুণভাবে মোহাবিষ্ট। নীরবে চলছে এ মরণ খেলা। এর শিকার দেশের তরুণ প্রজন্ম। তারাই এ মাদক আগ্রাসনের সবচেয়ে বড় শিকার। মাদকের ভয়াবহ ছোবল থেকে রক্ষা পাচ্ছে না কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থীরাও। কারণ ক্যাম্পাসে বসে তারা খুব সহজেই মাদক হাতে পাচ্ছে। একটু সচেতনভাবে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় চোখ রাখলেই আমরা বহু তথ্য দেখতে পাই। বিজ্ঞানের এই যুগে, অনলাইনে অর্ডার করলে ঘরে বসেই পাওয়া যাচ্ছে যেকোনো ধরনের মাদক। তবে দেশে এখন ইয়াবা ট্যাবলেটের সরবরাহ বেড়ে গেছে মাত্রাতিরিক্তভাবে। এতে ডুবছে সমাজ। ধ্বংস হচ্ছে দেশ।

দেশের তরুণ মেধাবীরা যেখানে দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেবে। শিক্ষাজীবন শেষ করে স্বপ্নের দেশ গঠনে ভূমিকা রাখবে, সেখানে তারা প্রবেশ করছে স্বপ্নহীন এক অন্ধকারে জগতে। যে জীবন ধুঁকে ধুঁকে শেষ করে দিচ্ছে জাতির মেরুদ-। মাদকাসক্ত স্বামীর হাতে স্ত্রী, ভাইয়ের হাতে ভাই, ছাত্রের হাতে শিক্ষক খুন হচ্ছেন। মাদকের কারণে তছনছ হচ্ছে পরিবার, প্রতিদিনই ভাঙছে কোনো না কোনো সংসার। বাড়ছে পারিবারিক দ্বন্দ্ব-বিভেদ, অস্থিরতা। এমনকি মাদকের টাকা সংগ্রহে ব্যর্থ হয়ে আদরের সন্তানকে বিক্রি করে দেওয়ার মতো মর্মস্পর্শী ঘটনাও ঘটেছে। সবকিছু ছাপিয়ে সর্বনাশা মাদক ধ্বংস করছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম। দেশের হাজার হাজার মানুষ আজ মাদকের চরম ঝুঁকিতে। মাদকসেবীদের প্রায় সবাই এখন মরণনেশা ইয়াবায় আসক্ত। মাদকের ছোবলে আক্রান্ত নারীরাও। পারিবারিক কলহ থেকে নারীরা মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন। প্রথমে সিগারেট দিয়ে শুরু। একপর্যায়ে ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়ছেন অনেকে। নারী মাদকাসক্তদের অনেকেই বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে কৌতূহলবশত ঝুঁকে পড়েন। একপর্যায়ে অ্যাডিক্টেড মাদকসেবী।

বাংলাদেশের মাদকবিরোধী সংস্থা মানস বলছে, দেশে প্রায় ৭০ লাখ মাদকাসক্ত ব্যক্তির ১৬ শতাংশই নারী। ঢাকায় আহ্ছানিয়া মিশনে মেয়েদের জন্য একটি আলাদা মাদক নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে। ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে ১৫ শতাংশ নারী নানা ধরনের মাদকে আসক্ত বলেও সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এসেছে। আর এদের ৪৩ শতাংশ নারী সেবন করছেন ইয়াবা। গবেষকরা বলছেন, দিন দিন এ নির্দিষ্ট মাদকটির সহজলভ্যের কারণেই এর দিকে ঝুঁকে পড়ছেন নারীরা। স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া মেয়েদের মাদকাসক্ত হয়ে পড়ার অন্যতম কারণ পরিবার বা বাবা-মায়ের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক না থাকা বা বাবা-মায়ের কাছ থেকে তাদের প্রত্যাশামতো সময় না পাওয়া। আবার দাম্পত্য কলহের কারণে অনেক গৃহিণী মাদকাসক্ত হচ্ছেন। মাদকাসক্ত পুরুষদের যতটা সহজে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব বা নিরাময় কেন্দ্রে আনা যায়, মেয়েদের ক্ষেত্রে বিষয়টা বেশ জটিল।

মাদক ব্যবসায়ীদের ভয়াবহ থাবায় একটি প্রজন্ম প্রায় ধ্বংসের মুখে। মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে আমাদের যুবসমাজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। এমনকি উঠতি বয়সী স্কুলমুখী কোমলমতি শিশুরাও সঙ্গদোষে জড়িয়ে পড়ছে নেশার বেড়াজালে। অনেকে আবার অল্প বয়সে ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে বিশ্বকে জানার নামে ঢুকে পড়ছে অন্য জগতে। রাত জেগে বিভিন্ন পর্নো সাইডে প্রবেশের পর এসব অল্প বয়সী তরুণ ও কিশোর ধীরে ধীরে আসক্ত হয়ে পড়ছে মাদকে। রাজধানীর নামিদামি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে রাস্তায় বেড়ে ওঠা শিশু-কিশোররাও ঝুঁকছে ভয়াবহ এ মরণনেশায়। তবে এমন কোনো পেশা নেই, যেখানে মাদকাসক্তির উপস্থিতি নেই। প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট যারা এটাকে নিয়ন্ত্রণ করবে, সেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের একাংশও এখন মাদকাসক্ত। তাই এটাকে নিয়ন্ত্রণ অনেকটা দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এ বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিচালক (অপারেশন ও গোয়েন্দা) সৈয়দ তৌফিক উদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশে মাদকের ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছে। ৬০ থেকে ৭০ লাখ লোক এ মাদকে আসক্ত। এর মধ্যে তরুণরাই সবচেয়ে বেশি। দেশে এখন প্রায় ৯ কোটি তরুণ রয়েছে। তারা প্রত্যেকেই এখন মাদকের ঝুঁকিতে। মিয়ানমার থেকে অবাধে ইয়াবা প্রবেশ করছে। এ দেশে মাদক আসা বন্ধ করার জন্য আমরা মিয়ানমারের সঙ্গে অনেকবার বসেছি। তারা আমাদের প্রতিবারই আশ্বস্ত করেছে, কিন্তু কোনো কার্যকর ব্যবস্থা এখনো নিতে পারেনি। ফলে সারা দেশে মাদক ছেয়ে যাচ্ছে। মিয়ানমার থেকে আসা মাদকের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ইয়াবা। বাংলাদেশের যত্রতত্রই এর অবাধ সরবরাহ। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সঙ্গে মিয়ানমারের মাদকদ্রব্যের নিয়ন্ত্রণ প্রশাসনের এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বহুবার বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে ইয়াবা উৎপাদন ধ্বংস করার এবং বাংলাদেশে ইয়াবাসহ মাদক প্রবেশ করতে না পারে সেই অঙ্গীকার করেছিল সে দেশের প্রশাসনের কর্মকর্তারা। কিন্তু বৈঠক পর্যন্তই অঙ্গীকার শেষ। বাস্তবায়ন হয়নি। বরং মিয়ানমার ইয়াবার উৎপাদন দ্বিগুণ হারে বাড়িয়ে দেয়। আমরা ইতোমধ্যে জেনে গেছি, মিয়ানমার জাতি হিসেবে কেমন। মিয়ানমারের প্রশাসন ও সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বাংলাদেশে ইয়াবাসহ মাদক পাচারে সরাসরি সহযোগিতা করছে। নাফ নদীর ওপারে মিয়ানমারের ইয়াবার বিশাল কারখানা রয়েছে। বাংলাদেশে ইয়াবার চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। মিয়ানমারও ইয়াবার উৎপাদন সেই হারে বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রতিদিন বাংলাদেশ থেকে কোটি কোটি ডলার পেমেন্ট যাচ্ছে মিয়ানমারে। জানা গেছে, কক্সবাজার ও টেকনাফের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে ইয়াবা আসছে। মাদক সরবরাহ করে কোটি কোটি ডলার নিয়ে যাচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার। দেশে প্রতিদিন হাজার হাজার ইয়াবা ট্যাবলেট প্রবেশ করছে। এক গবেষণা তথ্য উঠে আসে, টেকনাফে মোট ১৩৩টি গ্রাম রয়েছে, এর মধ্যে ১০০টি গ্রামই ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। সেখানকার স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা এ ব্যবসা পরিচালনা করছে। টেকনাফের যুবসমাজের অধিকাংশই ইয়াবা ব্যবসায় তাদের পুরো সময় ব্যয় করে থাকে। এটি শুধু একটি এলাকার চিত্র। এভাবে সারা দেশেই ইয়াবার বিস্তার রয়েছে। দেশের প্রতিটি অঞ্চলে আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে সর্বনাশা ইয়াবা। প্রতিদিনই কোনো না কোনো অভিযানে ইয়াবার চালান বা অপরাধীদের ধরা হচ্ছে কিন্তু বন্ধ হচ্ছে না কারবার।

এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা দিয়েছে। ফলে ইদানীং দেশে ব্যাপক হারে ধরা হচ্ছে মাদকসেবী ও ব্যবসায়ীদের। কিন্তু যাদের ধরা হচ্ছে, তারা প্রায় সবাই চুনোপুঁটি। অনেকের ধারণা, রাঘববোয়ালরা এখনো গভীর জলে। এই রাঘববোয়ালদের আইনের আওতায় না আনা হলে অভিযান ব্যর্থতায় পর্যবেশিত হতে পারে। তাই সবার আশাবাদ, চলতি অভিযানে রাঘববোয়ালদের আইনের আওতায় এনে অভিযানের সার্থকতা প্রমাণে সক্ষম হবে প্রশাসন।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist