রায়হান আহমেদ তপাদার

  ২০ মে, ২০১৮

বিশ্লেষণ

প্রবাসে দেশের প্রতিচ্ছবি

মরুবাসী মানুষরা শীতের কদর বোঝে। শিশির সিক্ত ভোরে ধূমায়িত গরম চায়ের কাপে শৈশবকে চুবিয়ে চুবিয়ে খানিকটা মিষ্টি রোদের স্বাদ নিতে আবালবৃদ্ধবনিতার চিত্তবাগে অভিলাষের কলি ফোটে। আরব্য নগরীর এই মরু অঞ্চল বারো মাসের দশ মাসই থাকে উত্তপ্ত তন্দুর। এই তন্দুরে ঝলসে তামাটে হয়ে যায় হৃদয়ে পুঞ্জীভূত সোনালি স্বপ্নসকল। তীর্থের কাকের মতো প্রতীক্ষমাণ থাকে মানুষ শীত মৌসুমটার জন্য। সাজেদের মনে পড়ে মায়ের হাতের ভাপা পিঠা, আর সেদ্ধ করা মিষ্টি আলুর কথা। বাংলাদেশের অজপাড়াগাঁয়ে শীত মৌসুমে আজও রকমারি পিঠার আয়োজন চোখে পড়ে। প্রবাসী ছেলের মা পিঠা বানায়। সবাই খায়। কিন্তু নিজে খেতে পারে না। পিঠা হাতে নিলে ছেলের কথা মনে পড়ে। বুক থেকে দলা পাকিয়ে নিঃশ্বাস গলা পর্যন্ত এসে আটকে যায়। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। তপ্ত নিঃশ্বাসটা ফুঁসিয়ে ওঠে। মায়ের পিঠা খাওয়া আর হয় না।

প্রায় সময় পুরো মাসের মাহিনা পাঠিয়ে দেন দেশে। এতে ফুলে ফেঁপে ওঠে দেশের কোষাগার। পরিবারের কিংবা সমাজের ক্ষুধাকাতর পেট। এতে দেশ কিংবা দেশের মানুষের পিপাসা পুরো হলেও তারা পারেন না নিজেদের পিপাসা মেটাতে। কত গ্রীষ্ম যায়, তাদের নাকের আড়াল হয়ে যায়-আম, কাঁঠালের গন্ধ। শীত যায় ঘাসের ওপর শিশিরবিন্দু তুলতুল করে না পায়ে। এ বাড়ি, ও পাড়ার গাছে গাছে বা গাছের নিচে দেখা হয় না নয়নাভিরাম শিউলি ঝরা। গ্রামের বাতাসে ম-ম করা পিঠা-পায়েসের ঘ্রাণে আকুল করে ওঠে না তাদের আকুলিয়া মন। এ বাড়ি, ভাই ও বাড়ির আঙ্কেলের খাওয়া হয় না বিয়ে কিংবা গায়ে হলুদ। মেজবানি, মেহমানি। কত প্রিয় মানুষের জন্ম আসে, মৃত্যু হয়-প্রথম কিংবা শেষ দেখাটিও হয় না তাদের। কেউ কেউ প্রবাস থেকে এসে বিয়ে করেন কিন্তু ছুটি ফুরিয়ে যায়, ফেলে যেতে হয় নববধূকেও। কারো কারো আওলাদের আগমনির সময় গুনা হয় কিন্তু ফের এসে দেখা হয় না, কত বড় হয়েছে তারা। ঈদ আসে, ঈদ যায়, পুজো আসে, পুজো যায়, গানে গানে বৈশাখ আসে। প্রবাসীরাই ঈদ-পুজোয় পারিবারিক চাহিদা মেটায় কিন্তু নিজেদের চাহিদা মেটানোর সব পথই যেন অবরুদ্ধ।

প্রধানত এ প্রাপ্তিগুলো থেকে বঞ্চিত মানুষকেই দেশত্যাগে পলায়নপ্রবণতা প্ররোচনা দেয়, আর তখনই মানুষ পরবাসে পরবাসী তকমা লাগিয়ে সুখ-দুঃখের অনুকূলে জড়িয়ে ফেলে নিজেকে বা নিজের জীবনকে। অবশ্য সুখ ও দুঃখ নিয়ে মানুষের জীবন হলেও প্রবাসীর জীবন অন্য রকম দুঃখ বিলাস। তারা প্রবাস জীবনে নিজের শ্রম বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করেন। আর নিজের জীবনের মূল্যবান শ্রম দিয়ে পরদেশে নিয়েছেন শ্রমিকের তকমা। কাজেই তাদের কপালে সুখ কোনোভাবেই লেখা থাকে না। লেখা নেই সুখ নামক শব্দ। তারা দুঃখী, জনম দুঃখী। এক আকাশের নিচেও আমাদের সুখের বিপরীতে তাদের বসবাস। অনেকের আবার প্রবাসেও আছে বেকারত্ব। কাজ আছে তো বেতন নেই। বেতন আছে তো কাজের নির্ধারিত সময় বাঁধা নেই। আট ঘণ্টা ডিউটির বদলে কেউ কেউ কাজ করেন ১৫ থেকে ১৬ ঘণ্টা। কাজ শেষ তো বাসায় পৌঁছে রান্না করে খাওয়া। এর পরে ঘুম।

এমন দেশে তারা দলে দলে যাচ্ছেন যেখানে নারী নির্যাতনের জন্য আইনের কোনো প্রতিকার নেই। যে গৃহকর্মীদের নানা ভয় দেখিয়ে যৌন নির্যাতন করা হয়, সে গৃহকর্মী মুখ বুজে সহে, প্রতিবাদ করে না। কারণ তারা গৃহকর্মী। গৃহকর্ম তাদের রোজগারের পথ। তাদের ঠোঁট আছে, কণ্ঠ আছে তবু ভাষাহীন। তারা ভাষা জানে না। যাবতীয় মানসিক, শারীরিক নির্যাতন করা হয়, প্রতিবাদ করে না। কারণ তারা শক্তিহীন। পরবাসে পরবাসী। এর ফল আমরা কাগজে দেখি। সে রকম নানা পরিসংখ্যানের একটিতে দেখা যায় সাড়ে তিন হাজারের মতো শ্রমিক মারা যায় বিদেশে। যার মধ্যে শারীরিক অসুস্থতা, কর্মস্থলে দুর্ঘটনা, হার্টঅ্যাটাক ও স্ট্রোকে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, তাদের বেশির ভাগের বয়স ৪০-এর নিচে। কারণ হিসেবে তারা নির্ধারণ করেছেন কর্মক্ষেত্রে চাপ, মানসিক পীড়ন, প্রতিকূল পরিবেশ এবং অমানুষিক পরিশ্রম। অথচ কী নির্মম ঘটনার সাক্ষী প্রবাসীরা। কী কষ্টের জীবন তাদের। তারাই আবার রেমিট্যান্স পাঠায়Ñআমরা চলি। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের দিকে এগিয়ে যাই। আবার আমরাই প্রবাসীদের হেনস্তা করি। প্রবাসে দূতাবাস আছে কিন্তু পর্যাপ্ত সার্ভিস পায় না প্রবাসী। কত সাধে এয়ারপোর্টে নামে, আমরা লাঞ্ছিত করি। অধিক লালায়িত কর্মচারীর মাধ্যমে কেড়ে নেই তার সখের জিনিস। নিজের বয়ে আনা অমূল্য কোনো সম্পদ। হয়তো পরিবারের নানা চাহিদা। গত ২৯ আগস্ট ২০১৭ সালের হিসাব। যেখানে বলা হয়েছে, সারা বিশ্বে বাংলাদেশি শ্রমিকের সংখ্যা ১ কোটি ১১ লাখ ৩৪ হাজার ২১১ জন। যার মধ্যে সৌদিতেই আছে ৩২ লাখ ২১ হাজার ৯৭৫ জন। ১৯৭৬ সালে যখন মাত্র ছয় হাজার শ্রমিক দিয়ে শ্রমবাজারের যাত্রা হয়েছিল আমাদের। তখন রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল মাত্র ৩৫ দশমিক ৮৫ কোটি টাকা। আর স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বিদেশে গমনকারী আমাদের কর্মী সংখ্যা ৯৫ লাখের ওপরে এবং দেশে পাঠানো তাদের টাকার পরিমাণ ছাড়িয়ে গেছে আট লাখ কোটিতে। এখন প্রতি বছর প্রায় পাঁচ লাখ লোক দেশ ছেড়ে বিদেশে যাচ্ছে আর প্রবাস থেকে পাঠাচ্ছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ এবং দেশের প্রবৃদ্ধি বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। আজ বাংলাদেশ উঁচু গলায় বলতে পারে আষ্টম বৃহৎ রেমিট্যান্স অর্জনকারী দেশ বাংলাদেশ। তাই আসুন না, একটু অবসর সময় নিয়ে তাদের কথা ভাবি।

আমাদের স্বজন যারা প্রবাসে থাকে, তাদের পাঠানো অর্থ থেকে একটু হিসাব করে চলি। তাদের পাঠানো অর্থ থেকে ছোট ছোট খরচ করি। তাদের অর্থ ছোট ছোট ব্যবসার উদ্দেশ্যে খরচ করি। ছোট ছোট ব্যবসায় বিনিয়োগ করি। সেটা যদি মুদির দোকানও হয় মন্দ কী? আর যদি তাও না পারি তাদের নামে কোনো একটি ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলে খরচ বাঁচিয়ে একটু একটু সঞ্চয় করি। একটু মনে রাখার চেষ্টা করি প্রবাসীরা বড় দুঃখী মানুষ। খুব বড় পরিবারÑপূজারি মানুষ। তারা মুখ বুঝে সহ্য করে। মুখ ফুটে বলে না। শুধু এক চিলতে হাসি দিয়ে বলে ভালো আছি। বিদেশবিভূঁইয়ে এত কিছু মনে রাখতে নেই। কূটনৈতিক ব্যর্থতার কারণে শুধু জনশক্তি রফতানি বন্ধ হচ্ছে যে তা নয়, বরং সঙ্গে সঙ্গে প্রবাসে অবস্থানরতদের নানা অজুহাতে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। সরকার যদি তড়িৎ গতিতে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করে, তাহলে আমাদের জাতীয় আয়ের মাধ্যম রেমিট্যান্স একসময় পুরোপুরিভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। এটা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটা অশনিসংকেতও বটে। মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশিদের কষ্টের কারণ হিসেবে বাংলাদেশের দূতাবাস এবং সরকারকেই দায়ী করছে। আমাদের মতো প্রবাসীদের মাধ্যমে বাংলাদেশের এত উন্নয়ন হচ্ছে, বাংলাদেশের আয়ের পরিমাণ বাড়চ্ছে। কিন্তু আয়গুলো কে, কীভাবে করছে তা বাংলাদেশ সরকার একটুও ভেবে দেখেনি, কোনোদিন ভাবার চেষ্টাও করেনি।

যারা প্রবাসের সঙ্গে এখনো পরিচিত হওয়ার মতো সুযোগ হয়নি বা তেমন সম্ভাবনা নেই, তাদের বেলায় সুখস্বপ্ন দেখা খুবই সাভাবিক। স্বপ্ন দেখা অন্যায় নয়, প্রতিটি মানুষের জীবনে সুন্দর কিছু স্বপ্ন থাকে এবং এই স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দেওয়ার সহজ উপায় হলো প্রবাস গমন। জীবনকে নানা রঙ্গে সাজাতে হলে স্বপ্ন দেখা খুবই জরুরি, স্বপ্ন ছাড়া এই জীবন তো আর সাজানো যায় না, তাই স্বপ্নকে সম্বল করেই আমাদের এগোতে হয়। স্বপ্নকে যত সুন্দর করে সহজে সাজানো যায়, বাস্তবকে এত সহজে হাতেনাতে ধরে কাছে বসানো যায় না। স্বপ্নের সঙ্গে বাস্তবের এই বিবাদ আজীবন থেকেই চলে আসছে, যা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। আকাশের তারা দেখে আমরা কত ধরনের আশা পোষণ করে থাকি। এত কিছু জানার পরও তারার দেশে যাওয়ার আকাক্সক্ষা থেকেই যায়। মানুষ স্বপ্ন দেখেছে, স্বপ্ন দেখছে এবং আগামীতেও দেখবে। স্বপ্ন দেখেছে বলেই সভ্যতা গড়তে সক্ষম হয়েছে। আমরাও এর বাইরে থাকতে পারি না।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist