ডা. এস এ মালেক

  ২৪ এপ্রিল, ২০১৮

নিবন্ধ

দুর্নীতি ও বাংলাদেশের বাস্তবতা

বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে মারাত্মক উপাদান হচ্ছে দুর্নীতি। মুষ্ঠিমেয় কিছু লোক ছাড়া দলমত নির্বিশেষে সবাই এই উপাদানে আশ্রিত। এ কথার মানে এই নয়, রাজনীতিতে দুর্নীতির ঊর্ধ্বে কেউ নেই। অনেক সৎ ও নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তি জাতীয় রাজনীতিতে বিচরণ করছেন। তবে তাদের অবস্থান অনেক নিচে। ক্ষমতার অংশীদারিত্বে তাদের যাওয়া খুবই কঠিন। কেন না, ক্ষমতায় যাওয়ার এখন মূল সহায়ক শক্তি হচ্ছে প্রাচুর্য ও সন্ত্রাস। আমাদের সমাজে সেই তত শক্তিশালী যে বিপুল অর্থের মালিক। আর বিত্তের মালিকানা অবস্থান আছে বলেই, অনেক সময় তারা সমাজের মাথা কিনে ফেলে। এসব বিত্তশালী, ক্ষমতাসীনদের বাসায়ই অধিকাংশ লোককে যাতায়াত করতে হয়। রাষ্ট্রীয় প্রশাসন যারা নিয়ন্ত্রক তাদের সহযোগিতা পেতে হলে, এসব দুর্নীতিবাজ ক্ষমতাসীনরাই হচ্ছে তাদের মাধ্যম। ধরুন, আপনি একজন সাধারণ মানুষ, অনেক কষ্টে আপনার একমাত্র ছেলেকে সেকেন্ডারি সার্টিফিকেট পাওয়ার যোগ্য করেছেন। ছেলের উচ্চশিক্ষার খরচ বহন করা আপনার পক্ষে সম্ভব নয়। আপনার ছেলের বয়স ১৮ বছর উত্তীর্ণ হয়েছে। শিক্ষিত ওই ছেলেটিকে মাঠে কাজ করার জন্য তো আপনি পাঠানোর মতো মানসিকতা নেই। তাই ওর জন্য আপনার একটা চাকরি দরকার। সবারই জানা পরীক্ষার মাধ্যমে গুণগতমান নির্ধারিত হওয়ার সুযোগ এখন খুবই সীমিত। তদবির নামক শব্দটি এখন প্রকট আকারে সবাইকে প্রভাবিত করছে কার কাছে তদবির করবেন? ঢাকায় যে তদবির করার সামর্থ্য আপনার নেই। তা ছাড়া যাকে ভোট দিয়ে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত করেছেন, তার তো একটা নৈতিক দায়িত্ব আছে। তাই অগত্যা তার কাছে যেতে হবে। তার এরূপ তদবির করতে গেলে, যেরূপ কথাবার্তা আপনাকে শুনতে হবে, তা আপনাকে একেবারেই হতাশাগ্রস্ত করে তুলবে। তিনি হয়তো এরূপ বলবেন, দিনকাল তো ভালো নয়। টাকা ছাড়া চাকরির ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। টাকা দেওয়ার হরেক রকম যুক্তি তিনি খাড়া করবেন। দেখা গেল একটা প্রাইমারি স্কুলের চাকরি নিতে ৩-৫ লাখ টাকা নজরানা দিতে হবে। পুলিশের চাকরি হলে তো একধাপে ১০ লাখ। আপনি হয়তো বলবেন নির্বাচনের সময় তো আপনাকে ভোট দিয়েছি, আমার ছেলের চাকরি দেওয়ার দায়িত্ব তো আপনার। মাননীয় ওই ব্যক্তি হয়তো বলবেন সব লোককে তো চাকরি দেওয়া সম্ভব নয়। তাই অর্থ তাকে দিতেই হবে। অনেক কষ্টে জমিজমা বন্ধক রেখে বা বিয়ের চুক্তিপত্রে সই দিয়ে টাকা সংগ্রহ করলেন এবং ওই টাকা দেওয়ায় চাকরি মিলে গেল। প্রশ্ন হচ্ছে, ওই চাকরিতে বেতন কত ৫-১০ হাজার। তাহলে ৫ লাখ বা ১০ লাখ টাকা পরের কাছে দায়বদ্ধ হয়ে যে চাকরি নিলেন সেই ঋণ আপনি কীভাবে শোধ করবেন। বেতনের টাকা দিয়ে হয়তো আপনার ক্ষুদ্র সংসার বা বাবা-মাকে একটু সাহায্য করবেন কিন্তু ওই ৫-১০ লাখ টাকার কী হবে? এ ধরনের সংকটে যারা সম্মুখীন, বাস্তবতা তাদের বলে দেয় কীভাবে তারা ওই ঋণ শোধ করবে। তাই দেখা যায়, অস্ত্রধারী কনস্টেবলরা ছিনতাই করে। পুলিশের পোশাক ছেড়ে কর্মরত অবস্থায় সিভিল পোশাকে কয়েকজন একত্র হয়ে ডাকাতি করতে দ্বিধাবোধ করে না। আর পুলিশ স্টেশন একবার সেখানে কর্মরত হলে উৎকোচের টাকার পরিমাণ যতই ক্ষুদ্র হোক না কেন, তা গ্রহণ করার সুযোগ তাকে নিতেই হবে। সততার ভান করে কোনো লাভ নেই। সবাই যে পথে চলছে, সেই পথ না ধরে বিকল্প পথে চললেই আপনার বিপদ হবে। কেউ কি কোনোদিন শুনেছেন সিভিল পোশাকে ডিবির লোক ডাকাতি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। মুক্তিপণ দাবি করে ব্যবসায়ীদের আটকে রেখে লাখ লাখ টাকা রোজগার করছে। আগে এসব ঘটনা তেমন চোখে পড়ত না। এখন মিডিয়াতে সত্যি কথা প্রকাশ করার কারণে জনগণ প্রকৃত ঘটনা জানতে পারছে। আমি এ কথা বলছি না দুর্নীতি শুধু পুলিশের আছে। এ দেশে এখন বিচার বিভাগও দুর্নীতিমুক্ত নয়। আদালতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলতে হয়, এ দেশে এমন বিচারক পাওয়া দুষ্কর হবে না, যারা উৎকোচের টাকা সংগ্রহ করতে বাড়িতে এজেন্ট পাঠায়। ঘুষ নিয়ে মামলার রায় পাল্টানো হয়। খুনির জামিন মিলে। ৬২ সালে রাজবাড়ীতে একজন মুনসেফ ছিলেন, সন্ধ্যার পর তার বাড়িতে তার আত্মীয়স্বজনের যাতায়াত নিষিদ্ধ ছিল। বাজার করতে গেলে প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া বেশি কথা তাকে বলতে দেখিনি বা এখানে-ওখানে বসে মিষ্টি আলাপও করতে দেখিনি। রোগী হিসেবে আমার কাছে আসতেন রোগ সম্পর্কীয় যেসব প্রশ্ন আমি করতাম, তার উত্তর দেওয়া ছাড়া আর একটা বেশি কথাও বলেননি। এখনো তার চেহারার কথা মনে পড়লে শ্রদ্ধায় মাথা অবনত হয়ে যায়। হয়তো তিনি বেঁচে নেই। তবে তার শেষ জীবনটা কীভাবে কেটেছে তা জানার আগ্রহটা এখনো আমার আছে।

যদি বিশ্বাস করতে হয়, উচ্চ আদালতে এমন ব্যক্তিবর্গ রয়েছেন, তাদের প্রায়ই খোলামেলা দুর্নীতির কথা অনেকেই জানেন। কিন্তু বলতে পারেন না। একজন বিচারক হচ্ছেন তিনি, যার কাছে অন্যায়ের প্রতিকার চাই। ন্যায়সংগত অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি করে। সমাজকে সঠিকভাবে পরিচালনার দায়িত্ব হচ্ছে বিচারকদের। কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ, কোনটা সত্য, কোনটা অসত্য, কে অপরাধী, কে নির্দোষ তা নির্ণয় করার দায়িত্ব বিচারকদের। মানুষের অধিকার আদায়ের দায়িত্ব যিনি পালন করেন, তার কি দুর্নীতি করা সাজে। এ দেশে এমন একসময় ছিল যখন বিশেষ কয়েকটি বিভাগে দুর্নীতি ছিল, অনেক বিভাগ ছিল যেখানে দুর্নীতির কথা শোনা যেত না। রাষ্ট্রীয় পদে দু-একজন দুর্নীতি করলে তারা সহজে চিহ্নিত হতেন। সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুব খান ৩০৩ সরকারি কর্মচারীকে বরখাস্ত করেছিলেন। বাস্তবতা হচ্ছে তারা অনেকেই দুর্নীতিবাজ ছিলেন। এমন একসময় ছিল উচ্চ আদালতে দুর্নীতির প্রশ্নই উঠত না। কেন একজন ডিস্ট্রিক্ট জাজকে উৎকোচ দেওয়ার সাহস কারো ছিল না। শিক্ষাঙ্গন ছিল একেবারেই দুর্নীতিমুক্ত। মানুষের ধারণা ছিল শিক্ষাঙ্গন হচ্ছে আদর্শ প্রতিষ্ঠার কেন্দ্রবিন্দু। সেখানে আবার দুর্নীতি কেন। আর আজকের বাস্তবতা হচ্ছে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা উৎকোচ গ্রহণ করে শিক্ষক নিয়োগ দেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে উচ্চপদে সুযোগ করে দেন। উৎকোচ না দিলে এমপিওভুক্তি হয়েছে, এরূপ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা খুবই কম। শোনা যায়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন মধ্যম শ্রেণির কর্মচারী দুই ছেলেকে নিজ খরচে বিদেশে পড়ান। কোনো এক এপিএস অগাধ সম্পদের মালিক। এখন একজন ডিস্ট্রিক্ট অফিসার কোটি টাকা সম্পদের মালিক। একজন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষককে বদলি হতে হলেও উৎকোচ দিতে হয়।

প্রশ্নপত্র নিয়ে যা ঘটে চলেছে, তা জাতির জন্য লজ্জার ও কলঙ্কজনক। দেখেশুনে মনে হয় এ দেশে প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ করার মতো যোগ্যতা জাতি হিসেবে আমাদের নেই। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে, মন্ত্রী থেকে শুরু করে অনেক কর্মকর্তা অনেক পরামর্শ দিয়েছেন কিন্তু কোনো উন্নতি হয়নি। প্রশ্ন তৈরি প্রক্রিয়ায় পদ্ধতিগত পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ হয়নি। যদি রাজনীতিবিদদের কথা বলি, তাহলে এমন সম্ভ্রান্ত অনেক বর্তমানে ক্ষমতাসীন বা এককালে ক্ষমতাসীন ছিলেন এমন অনেক লোক পাওয়া যাবে, যাদের সম্পদের মালিকানা ও আয়ের উৎস সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আমার মনে হয় দুর্নীতি দমনে একটা আইন আছে যে অর্জিত সম্পদের সঙ্গে অর্জিত অর্থের সামঞ্জস্যবিহীন হলে, তাকে শাস্তি দিতে কোনো বাধা নেই। হিসাব নিন, দেখবেন সীমাহীন সম্পদের মালিক, ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় বা ক্ষমতার বাইরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বক্তব্য দিচ্ছেন। ফুলের মালা গলায় দিয়ে উচ্চকণ্ঠে দুর্নীতিবাজদের শ্রাদ্ধ করছেন। কিন্তু নিজের কাছে নিজের জবাবটা নিচ্ছেন না। এখানেই সমস্যা। যেখান থেকে সরে আসতে না পারাটাই হবে জাতির জন্য একটি অশনিসংকেত।

লেখক : রাজনীতিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist