আবু তালহা তারীফ
ধর্ম
ইসলামে নারীর অধিকার
নারী জাতি মানবসমাজেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। বিশ্ব সংসারে নারী জাতির আবির্ভাব না হলে মানবজাতির অস্তিত্ব কল্পনাও করা যেত না। তাই মহান আল্লাহ তায়ালা আদি পুরুষ আদমকে (আ.) সৃষ্টি করার পর সৃষ্টির পূর্ণতা আনয়নের জন্য হজরত হাওয়াকে (আ.) সৃষ্টি করেন। অতঃপর দুনিয়ায় পাঠিয়ে দেন। উভয়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে সেখান থেকেই উদ্ভব হয় মানবসমাজের। মানবসমাজ গঠনে উভয়ের ভূমিকা সমান। কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয়, সমাজের গুরুত্বপূর্ণ নারীসমাজ আজ নির্যাতিত ও অবহেলিত।
প্রাচীনকালে নারীদের উচ্চ ও সম্মান স্থান দেওয়া হয়নি। নারীসভ্যতার সূতিকাগারে গ্রিসে নারী জাতিকে শয়তানের সমতুল্য মনে করা হতো। সামাজিক মর্যাদার ক্ষেত্রে ব্যাবলিন ও ইরানের ও গ্রিকে নারীদের স্থান ছিল সবার নিচে। তৎকালীন আরব সমাজের নারীদের করুণ অবস্থা সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করা হয়েছে, ‘তাদের কাউকে যখন মেয়ে জন্মের সংবাদ দেওয়া হয় তখন তার চেহারা কালো হয়ে যায় এবং সে দুঃখ চিন্তায় ব্যথিত হয়ে পড়ে। এ সংবাদটিকে তারা এত খারাপ সংবাদ মনে করত, নিজেকে লোকজনের থেকে গোপন রাখতে থাকে আর চিন্তা করতে থাকে, লজ্জা শরম ও অবমাননা সহ্য করে মেয়েটিকে রাখবে, না তাকে মাটির নিচে জীবন্ত কবর দেবে।’ (সুরা নাহল-৫৮-৫৯)
বিশ্ব নারী দিবসের পেছনে একটি ইতিহাস রয়েছে। ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে একটি সুতার কারখানার মহিলা শ্রমিকরা মানবেতর পরিবেশ, অসম মজুরি এবং ১২ ঘণ্টা কর্মদিবসের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করলে নারী শ্রমিকরা কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। পরে ১৮৬০ সালে ৮ মার্চ নিউইয়র্কের সুতার কারখানার শ্রমিকরা ‘মহিলা শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন করেন এবং নিজেদের আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকেন। এরপর ১৯০৮ সালের ৮ মার্চ পোশাক ও বস্ত্রশিল্পের নারী ও শ্রমিকরা তীব্র আন্দোলনে বের হয়ে পড়েন। তারা কারখানার পরিবেশ উন্নতকরণ, শিশুশ্রম বন্ধ, কাজের সময় হ্রাস প্রভৃতির দাবিতে ওইদিন বিক্ষোভ বের করেন। অতঃপর ১৯১০ সালের ৮ মার্চ কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে জার্মানির মহিলা নেত্রী ব্লাগয়া জেটকিন ওই দিনটিকে নারী দিবস ঘোষণা করেন। নারীদের শাসন, শোষণ, বঞ্চনা, অবহেলা ও নির্যাতনের হাত থেকে উদ্ধার করে সম্মান ও গৌরবময় জীবনযাপনের অধিকার নিশ্চিত করেন মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। অধিকার বঞ্চিত নারীজাতির অধিকার ফিরিয়ে দিয়ে তাদের মর্যাদার আসনে সমাসীন করেছেন তিনি। ইসলামে নারীদের যেভাবে সম্মান দিয়েছে তা নিম্নরূপÑ
কন্যারূপে নারী : প্রাচীন আরবে কন্যাসন্তানকে জন্মদান কলঙ্কজনক বিষয় মনে করা হতো। কন্যাসন্তান জন্ম হলেই তাদের মুখ অন্ধকার হয়ে যেত।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর যখন তাদের কন্যাসন্তাননের সু-সংবাদ দেওয়া হতো, তখন ক্ষোভে-অপমানে তাদের মুখম-ল অন্ধকার হয়ে যেত।’ (সুরা নাহল : ৫৮)
রাসুল (সা.) এ দৃশ্য দেখে তাদের নিষেধ করলেন। তিনি বলেন, তোমরা কন্যাসন্তানদের খবরে ভয় করো না। কেন না তোমাদের রিজিকদাতা আল্লাহ তায়ালা। আল্লাহ তাওয়ালা বলেন, ‘তোমাদের সন্তানদিগকে দারিদ্র্যের ভয়ে হত্যা করো না। উহাদিগকে আমিই রিজিক দিই এবং তোমাদিগকেও। নিশ্চয়ই উহাদিগকে (কন্যাসন্তানকে) হত্যা করা মহাপাপ।’ (সুরা বনী ইসরাইল : ৩১)
রাসুল (সা.) তখন কন্যাসন্তানের সম্মান বৃদ্ধি করেন। প্রিয়নবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কন্যাসন্তানের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে, তারা তার জন্য জাহান্নামের অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে।’ (বুখারি, মুসলিম)
স্ত্রীর অবস্থানে নারী : ইসলামপূর্ব সময়ে স্ত্রীদের শুধু ভোগের সামগ্রী মনে করা হতো। কিন্তু ইসলাম স্ত্রীর সঙ্গে উত্তম আচরণ করার জন্য বলছে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা স্ত্রীদের সঙ্গে সদ্ভাবে জীবনযাপন করো।’ (সুরা নিসা : ১৯)
ইসলাম স্ত্রীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ, দাসীর আচরণসহ যেকোনো ধরনের অত্যাচার করতে বারণ করেছে।
রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা তোমাদের জীবন সঙ্গিনীকে কখনো অত্যাচার ও দাসীর মতো মারপিট করো না।’ (বুখারি ও মুসলিম)
মায়ের অবস্থানে নারী : ইসলামে মা হিসেবে নারীকে সম্মান করেছে। মায়ের সম্মান ও খেদমত জান্নাত লাভের অন্যতম উপায়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত।’ (আবু নাঈম শরিফ)
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর শোকর আদায় করো এবং সঙ্গে সঙ্গে পিতা-মাতারও।’ (সুরা লোকমান : ১৪)
মা অন্য ধর্মের অনুসারী হলেও তার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করতে হবে। যেমনÑ
হজরত আসমা (রা.) বলেন, ‘আমি নবী (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করলাম, আমার মাতা মুশরিক বেদ্বীন, তিনি আমার কাছে দেখা করতে আসেন। তাকে আদর, আপ্যায়ন করা যাবে কি? রাসুল (সা.) বলেন, অবশ্যই তাকে আদর আপ্যায়ন ও সদ্ব্যবহার করবে।’ (বুখারি শরিফ)
শিক্ষার অধিকার : ইসলাম নারীকে পর্দা রক্ষা করে শিক্ষার অধিকার প্রদান করেছেন। ইসলাম নারী ও পুরুষ উভয়কে পড়ার জন্য বলেছে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘পড়ো তোমার প্রভুর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা আলাক : ১)
আজকের কন্যা আগামী দিনের মা। তাই রাসুল (সা.) নারীকে শিক্ষা, কাজকর্মে কন্যাসন্তানকে যোগ্য করে তুলতে বলেছেন। তাই নারী-পুরুষ সবাইকে শিক্ষার জন্য তাগিদ দিয়েছেন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘দ্বীনি ইলম শিক্ষা করা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর ফরজ।’
ধর্মীয় অধিকার : ইসলামে নারীর ধর্মীয় অধিকারও নিশ্চিত করা হয়েছে। তদুপরি দ্বীন পালনে নারীদের বিশেষ সুবিধা ও ছাড় দেওয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি নষ্ট করে দিই না তোমাদের মধ্য থেকে কোনো আমলকারীর আমলকে, সে পুরুষই হোক আর নারীই হোক। তোমরা তো একে অপরের অংশ (সুরা আল ইমরান : ৩ : ১৯৫)
তা ছাড়া নারীকে জুমার নামাজ, জানাজা, পাঁচওয়াক্ত নামাজে জামাতে শামিল হওয়া এবং জিহাদে অংশগ্রহণে নারীকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
অর্থনৈতিক অধিকার : ইসলাম নারীদের পর্দা রক্ষা করে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার অধিকার দিয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য করে অর্থবিত্ত উপার্জন করে এর মালিক একমাত্র নারী। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘পুরুষ যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য অংশ এবং নারী যা অর্জন করে তা নারীর প্রাপ্য অংশ।’ (সুরা নিসা : ৩২)
নারী যতই সম্পদশালী হোক না কেন, তার ভালোমন্দ দেখাশোনার দায়িত্ব স্বামীর। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘পিতার কর্তব্য হচ্ছে তাদের (সন্তান, স্ত্রী) দের খোরপোশ প্রদান করা।’ (সুরা বাকারা : ২৩৩)
রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের স্ত্রীদের পানাহার ও পোশাকের ব্যবস্থা করা তোমাদের ওপর ফরজ।’ (বুখারি শরিফ)
সামাজিক অধিকার : ইসলাম নারীকে মানুষ হিসেবে মর্যাদাসীন করে নারীকে সামাজিকভাবে স্ত্রীরূপে, কন্যারূপে, মা হিসেবে অতুলনীয় মর্যাদা দান করেছেন। ইসলামে সাক্ষীসাবুদ রেখে নির্দিষ্ট মোহর প্রদানপূর্বক নারীকে বিয়ে করতে হবে। তাকে একান্তে পাওয়ার অন্য কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : প্রাবন্ধিক
"