এস এম মুকুল

  ০৬ মার্চ, ২০১৮

পাট দিবস

জেগে উঠছে সোনালি আঁশ

পাকিস্তান আমলে দেশের প্রধান রফতানিজাত পণ্য পাট ছিল এ দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি। তখন পাট এবং পাটজাত দ্রব্যের কারখানা স্থাপনে তীব্র প্রতিযোগিতা চলছিল। গ্রাম-গঞ্জের হাটগুলোয় তখন দেখা যেত পাটের স্তূপের টাল। সেই পাটশিল্প মুখ থুবড়ে পড়েছিল অনাদর ও অবহেলায়। তবে আশার খবর হচ্ছে, স্বাধীনতা অর্জনের প্রায় ৫ দশকের দ্বারপ্রান্তে এসে ক্রান্তিকাল পেরিয়ে আবারও ঘুরে দাঁড়িয়েছে পাটশিল্প। বাংলার পাট আবারও নতুন সম্ভাবনার মুখ দেখছে। ১৮৯০-এর দশকে পাট সোনালি আঁশের মর্যাদা অর্জন করেছিল। এরপর অবহেলায় অনাদরে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ২০১০ ও ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশি বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের নেতৃত্বে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের একদল বিজ্ঞানী তোষা ও দেশি পাটের জীবনরহস্য উন্মোচন করেন। পাটের জীবনরহস্য উন্মোচনের পাঁচ বছরের মাথায় জিন প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে রবি-১ নামে পাটের একটি নতুন জাত উদ্ভাবন করেছেন মাকসুদুল আলমের অনুসারীরা। নতুন উদ্ভাবিত রবি-১ জাতের তোষা পাটের জাত থেকে কমপক্ষে ২০ শতাংশ বেশি ফলন পাওয়া গেছে। বিশ্বে সবচেয়ে সস্তা, পরিবেশবান্ধব ও বায়ো-ডিগ্রেডেবল প্রাকৃতিক তন্তুর নাম পাট। পাট একটি পরিবেশবান্ধব ফসল। প্রতি হেক্টর পাট ফসল ১০০ দিন সময়ে ১০.৬৬ টন অক্সিজেন নিঃসরণ করে বায়ুম-লকে বিশুদ্ধ ও অক্সিজেন সমৃদ্ধ রাখে। পাট ফসল পৃথিবীর গ্রিন হাউস গ্যাস ও তার পরিপ্রেক্ষিতে তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে ব্যাহত করে।

পাট বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও অর্থনৈতিক আভিজাত্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি অনন্য সম্ভাবনাময় শিল্পের নাম। একসময় পাট ছিল আমাদের জাতীয় অর্থনীতির প্রধানতম আয়ের উৎস। নদীমাতৃক বাংলাদেশে বর্ষায় নৌপথে চলাচলে দেখা যেত পাটখেতে পানি আর বাতাসের ঢেউ দোলানোর খেলা। বাংলাদেশের পাটের বাজার হিসেবে পরিচিত ছিল ভারত, চীন ও পাকিস্তান। আমরা জানি, অবিভক্ত বাংলায় পাটের বর্ণময়, উজ্জ্বল ও সোনালি অধ্যায় শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে। সময়ের পরিবর্তনে বাজার বিস্তৃত হয়েছে থাইল্যান্ড, সুদান, সিরিয়া, ভিয়েতনাম, ইরাক, ইরান, তুরস্ক, নিউজিল্যান্ডসহ আরো ২২টি দেশে। পাট উৎপাদনের বিবেচনায় ভারতের পরে দ্বিতীয় স্থানে আছে বাংলাদেশ। এখনো পাট উৎপাদনকারী পৃথিবীর অন্য দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের পাটের মান সবচেয়ে ভালো। গ্রিন ইকোনমি, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি, ন্যাচারাল ফাইবারের ব্যাপক চাহিদা ও সরকারের নানামুখী পদক্ষেপের কারণে বাংলাদেশের সোনালি আঁশের নতুন জাগরণ দেখা দিয়েছে। পাটশিল্পের বহুমাত্রিক ও নান্দনিক ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। আধুনিক রুচিশীলতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে পাট এবং পাট থেকে তৈরি সুতা দিয়ে শতরঞ্জি, ব্লেজার, জুতা, বাহারি রং-বেরঙের ব্যাগ, ঝুড়ি, ওড়না, ঘর সাজানোর নানা সামগ্রীসহ ১৩৫ ধরনের বহুমুখী পণ্য তৈরি হচ্ছে। পরিবেশবান্ধব ও নান্দনিকতার কারণে রুচিশীল ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে পাটপণ্য। জ্বালানির বিকল্প হিসেবে পাটকাঠি ব্যবহৃত হওয়ায় বন উজাড়ের হাত থেকে পরিবেশ রক্ষা পায়। গবেষণায় দেখা গেছে, একজন কৃষক এক হেক্টর জমিতে পাট চাষ করলে তা মোট ১০০ দিনে ১৫ টন কার্বন-ডাই অক্সাইড প্রকৃতি থেকে শোষণ করে। আর ১১ টন অক্সিজেন প্রকৃতির মধ্যে বিলিয়ে দেয়। পাট ফসলের কার্বন-ডাই অক্সাইড শোষণ ক্ষমতা প্রতি বর্গমিটার জায়গায় ০.২৩ থেকে ০.৪৪ মিলিগ্রাম। পাট ফসল ১০০ দিনে হেক্টর প্রতি বাতাস থেকে প্রায় ১৪.৬৬ টন কার্বন-ডাই অক্সাইড শোষণ করে। আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে, পাট ফসল উৎপাদনকালে হেক্টরপ্রতি ৫ থেকে ৬ টন পাট পাতা মাটিতে যোগ হয়। পাট চাষ থেকে পশুখাদ্য ও সবজি পাওয়া যায়। অর্থকরী ফসল হিসেবে পাটের আর্থিক লাভ অন্যান্য অর্থকরী ফসলের তুলনায় অনেক সম্ভাবনাময়। পাট একটি পরিবেশবান্ধব ফসল। কার্বন ইস্যুতেও পাট গুরুত্বপূর্ণ ফসল। প্রতি হেক্টর পাট ফসল ১০০ দিন সময়ে ১০.৬৬ টন অক্সিজেন নিঃসরণ করে বায়ুম-লকে বিশুদ্ধ ও অক্সিজেন সমৃদ্ধ রাখে। এক হেক্টর জমির পাট ১৫ টন কার্বন-ডাই অক্সাইড শোষণ করতে পারে, যেখানে ধান শোষণ করে মাত্র পাঁচ টন। পাট ফসল বায়ুম-লে ১১ টন অক্সিজেন মুক্ত করে। এক হেক্টর জমির পাট ১০ টন বায়োমাস মাটিতে যুক্ত করতে পারে, যা মাটির জৈব পদার্থ বৃদ্ধি করে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, পাট ফসল উৎপাদনকালে হেক্টরপ্রতি ৫ থেকে ৬ টন পাট পাতা মাটিতে যোগ হয়। পাটের পাতায় প্রচুর নাইট্রোজেন, সোডিয়াম, পটাশিয়াম ও ক্যালসিয়াম থাকে। এ ছাড়া পাট ফসল কর্তনের পর পাটগাছের গোড়াসহ শিকড় জমিতে থেকে যায়, যা পরে পচে মাটির সঙ্গে মিশে জৈব সারে পরিণত হয়। এতে পরবর্তী ফসল উৎপাদনের সময় সারের খরচ কম লাগে। সহজ হিসেবে যে জমিতে পাট চাষ হয়, সে জমিতে অন্য ফসলও ভালো হয়। পাট জাগ দেওয়ার পর ছালের আঁশ ভিন্ন অন্যান্য নরম পচে যাওয়া অংশ, জাগের ও ধোয়ার তলানি এবং পাট পচা পানি উৎকৃষ্ট জৈব সার হিসেবে ব্যবহারযোগ্য।

পাটের ব্যাগ, জুতা, স্যান্ডেল, তৈজসপত্রসহ বৈচিত্র্যময় পাটজাত পণ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে সারা দেশের ২১ জেলায় পাটশিল্প পল্লী গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে সরকার। এসব পাটপল্লীর জন্য চালু ও বন্ধ হয়ে যাওয়া পাটকলের খালি জায়গা ব্যবহার করা হতে পারে। অপর এক খবরে জানা যায়, ২০১৯ সালের মধ্যে দেশে পাট থেকে সুতার প্রধান কাঁচামাল ভিসকস উৎপাদন শুরু হবে। দেখতে সুতার মতো কিন্তু সুতার চেয়েও সূক্ষ¥ ভিসকস এক ধরনের রেশম, যা দিয়ে সুতা তৈরি করা যায়। ভিসকস ব্যবহার হয় তুলার বিকল্প হিসেবে সুতা তৈরির কাজে। বলা হচ্ছে, পাট থেকে ভিসকস বা রেশম তৈরি করা গেলে তা সোনালি আঁশের সম্ভাবনা আরো বহু গুণে বেড়ে যাবে। আরো আশার খবর হচ্ছেÑপাট থেকে ডেনিম কাপড় তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। প্রথমে পাট ও তুলার মিশ্রণে সুতা তৈরি করা হবে। সেই সুতা থেকে বানানো হবে ডেনিম কাপড়। উৎপাদিত কাপড় থেকে প্যান্ট, জ্যাকেট, শার্টের মতো পোশাক বানিয়ে রফতানি ও বেসরকারি খাতে কাপড় সরবরাহ করা হবে। খবর আরো আছে, পাট দিয়ে প্রচলিত পলি ব্যাগের মতোই তৈরি হয়েছে পচনশীল পলিথিন ব্যাগ। বাজারে যে পলিথিন ব্যাগ আছে তার চেয়ে দেড় গুণ বেশি টেকসই এবং ব্যবহার স্বাচ্ছন্দ্য পাওয়া যাবে এই পাটের পলিথিনে। দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশেও রফতানি হবে এই ব্যাগ। পাট দিয়ে এখন তৈরি হচ্ছে রকমারি পণ্য। যার ব্যবহারে স্বাছন্দ্যবোধ করছেন শৌখিনরা। পাটের বাহারি পণ্যসম্ভারে এসেছে নান্দনিক ডিজাইন ও পরিবেশবান্ধব রঙের ব্যবহার। পাট দিয়ে ব্যাগ, স্যান্ডেল এমনকি গহনাও তৈরি করা হচ্ছে। এখন শহুরে আধুনিক মেয়েরা বিয়ে, গায়ে হলুদের সাজে পাটের গহনায় নিজেদের সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তুলছেন প্রাকৃতিক নান্দনিকতায়। পাটের গহনা তৈরি করেছে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। যার ফলে এখন পাটের হ্যান্ডিক্রাফটস পণ্য ‘পাটের গয়না’ নামে ২০০ থেকে ৩০০ টাকার মধ্যেও পাওয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে দেশি পাটের লবণসহিষ্ণু নতুন চার জাতের পাট চাষে শতভাগ সফলতা পাওয়া গেছে। যার ফলে কৃষি অর্থনীতিতে দেখা দিয়েছে নতুন সম্ভাবনা। লবণাক্ত জেলাগুলোÑসাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ভোলা, বরগুনা, কক্সবাজার, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, পটুয়াখালী এবং পিরোজপুরে লবণসহিষ্ণু নতুন চার জাতের পাট চাষের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। পাটের নতুন সম্ভাবনা উপলব্ধি করে দেশদরদি নেত্রী শেখ হাসিনার সরকার কয়েকটি যুগান্তকরী পদক্ষেপ নিয়েছেন। পাটকে কৃষিপণ্য হিসেবে ঘোষণা করায় পাটচাষি ও রফতানিকারকরা উপকৃত হচ্ছেন। বাংলাদেশ থেকে কাঁচা পাট রফতানি বন্ধ করা হয়েছে। সিনথেটিক বস্তা নিষিদ্ধ করে ‘প্যাকেজিং অ্যাক্ট’ পাস করায় পাটের বস্তার অভ্যন্তরীণ চাহিদা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। বার্ষিক পাটের বস্তার চাহিদা ১০ কোটি থেকে বেড়ে ৭০ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। ২০২১ সাল নাগাদ কাঁচা পাট ও পাটপণ্যের চাহিদা ২০০ শতাংশ বৃদ্ধি আশা করা হচ্ছে, যা আমাদের প্রত্যাশার পরিপূরক।

লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক ও উন্নয়ন গবেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist