ইয়াসমীন রীমা

  ১৪ জানুয়ারি, ২০১৮

স্বাস্থ্য

ঘাতক ব্রেস্ট ক্যানসার

বকুল ভাবির ওপর ভীষণ রাগ হয় শেফালীর ওরফে শেফুর। কী কথা বলে তিনি ডাক্তারের কাছে নিয়ে এসেছে তাকে। আর এখন কী করতে বলছে। তা ছাড়া ডাক্তার মহিলাইবা কেমন। সে-ও শেফুর ব্লাউজ খুলে স্তন দেখতে চাইছে। কী যে লজ্জার কথা। অপরিচিত কারো সামনে কি স্তন খুলে দেখানো যায়? হোন না তিনি একই লিঙ্গের। পরে ডাক্তারের শত পীড়াপীড়িতে শেষতক দেখাতে হলো তাকে। স্তন হাত দিয়ে ধরে লাইট জ্বেলে অনেকক্ষণ নিরীক্ষা করে ডাক্তার হতাশ হয়ে গেলেন। শেফুকে পাশের রুমে গিয়ে বসতে বলে বকুল ভাবির সঙ্গে ডাক্তার কি যে পরামর্শ করলেন। শেফুকে ঘুণাক্ষরেও জানাল না ওসব কথা।

জেলা কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার ছোট্টগ্রাম ছাতিয়া। সে গ্রামের বড় মসজিদের মুয়াজ্জিন খলিলুর রহমানের একমাত্র মেয়ে শেফালী খানম ওরফে শেফু। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। বাবার আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না বিধায় ১৭ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যায় পাশের গ্রামের মতিন খলিফার ছেলে ওমান প্রবাসী সফিকের সঙ্গে। বিয়ের দুই মাস পর সফিক বিদেশে চলে যায়। বিয়ের ছয় মাস পর থেকে শেফুর বাম স্তনে মৃদু মৃদু ব্যথা অনুভূত হতো প্রায় সময়ে। প্রথম প্রথম তেমন গুরুত্ব দেয়নি সে। কিন্তু গেল দুই সপ্তাহ ধরে সেই ব্যথা মৃদু থেকে তীব্র আকার ধারণ করে। অত্যন্ত পর্দানশিন পরিবারে শেফু বেড়ে উঠেছে, তাই লজ্জায় কাউকে বলেনি তার এই শারীরিক সমস্যার কথা। কিন্তু যন্ত্রণা যখন সহ্য করতে আর পারছিল না সে। তখন এক সন্ধ্যায় সে তার স্বামীর বড়ভাইয়ের বউ বকুল ভাবিকে জানায়। বকুল ভাবি তার স্বামী সফিককে বিষয়টি অবহিত করলে সে উপজেলার কোনো ডাক্তারকে দেখাতে অনুরোধ করে। বকুল অনেক অনুনয়-বিনয় করে আজ উপজেলা কমপ্লেক্সের মহিলা ডাক্তারের কাছে নিয়ে আসেন। ডাক্তার প্রাথমিকভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানালেন, শেফালী স্তন ক্যানসারে ভুগছে। জরুরি ভিত্তিতে তার উচ্চতর চিকিৎসা প্রয়োজন। নতুবা জীবন বিপন্ন হতে পারে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেক নারীই স্তন ক্যানসারে ভুগছেন। কেবল সামাজিক কুসংস্কার ও তথ্য না জানার কারণে অকালে ঝরে পড়ছেন মৃত্যুর কোলে। তা ছাড়া সঠিক খাদ্যভাব ও সুষ্ঠু জীবনযাপন প্রক্রিয়ার কারণে উন্নত বিশ্ব অপেক্ষা দেশে অধিক সংখ্যায় নারী স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন। এর মধ্যে ১৫.৫০ শতাংশ তরুণী। তবে এই তরুণীরা দেশীয় সবজি-ফলমূল না খাওয়ার অভ্যাসে ও মাত্রারিক্ত ফাস্টফুড খাওয়ার কারণে এই শ্রেণিরা স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন।

ঢাকা মহিলা সমিতির কাউন্সিলি সভায় উপস্থিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার কর্মকর্তা বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, উন্নত দেশগুলোয় ৩০ বছর পরে এমনকি চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ বছর বয়সে স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি মাত্রা বৃদ্ধি পায়। আমাদের দেশে উল্লিখিত বয়সের নারীদের স্তন ক্যানসার হলেও তরুণীদের মধ্যেও স্তন ক্যানসার বেড়ে চলেছে। এসব টিনএজ ক্যানসার আক্রান্ত রোগী গ্রাম শহর সব স্থানে লক্ষিত হয়। বর্তমানের ভেজাল খাদ্য গ্রহণ তার অন্যতম কারণ। তা ছাড়া বংশগত ক্যানসার ছাড়াও শহরে এই বয়সের তরুণীদের মধ্যে ফাস্টফুড অগ্রহীতা স্তন ক্যানসার ঝুঁকি বাড়ায়। উপরন্তু আজকাল টিনএজরা অট্টালিকা বা ভবনে ওঠার সময় সিঁড়ি না ভেঙে লিফট বা এক্সসেলেটার ব্যবহারে আসক্ত হয়ে পড়ছে, একটুও কায়িক পরিশ্রম করতে আগ্রহী নয়। তা ছাড়া বিভিন্ন মাদকাসক্তও স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়।

অ্যাপোলে হাসপাতালের কো-অর্ডিনেটর অ্যান্ড কনসালট্যান্ট জেনারেল অ্যান্ড ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারি বিভাগের প্রফেসর ডা. আনিসুর রহমান জানান, চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় স্তনে ব্যথা হওয়াকে বলা হয় ম্যাস্টালজিয়া। প্রতি ১০ মহিলার মধ্যে সাতজন মহিলার জীবনে কোনো না কোনো সময় স্তনে ব্যথা হয়ে থাকে। তবে এই ব্যথা নিয়মিত অনুভূত হলে বা স্তনে অথবা বাহুর নিচে চাকা বা ল্যাম্প দেখা দিলে, ওই চাকার অথবা স্তনবৃন্ত থেকে রস বের হলে, পরিবারের অন্য কারো স্তন ক্যানসার হয়ে থাকলে, স্তনের কোথাও ফুলে গেলে অথবা লাল হলে, গর্ভধারণের বিভিন্ন উপসর্গের উপস্থিতি যে নিয়মিত ঋতুস্রাব না হলে মোটামুটিভাবে বুঝতে হবে ব্যক্তিটি স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত। তা ছাড়া নিয়মিত স্তন প্রদাহ সময়ের ব্যবধানে স্তনে ব্যথাই সাধারণত বেশি দেখা যায়। নারীর ঋতুস্রাব বা মাসিক শুরু হওয়ার পর থেকে যেকোনো বয়সেই এটা প্রথম হতে পারে, তবে সচরাচর দেখা যায় ৩০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যেই প্রথম ব্যথা অনুভূত হয়। নারীদের রজোনিবৃত্তি অতিক্রান্ত হওয়ার পর যখন মাসিক বন্ধ হয়ে যায় তখন এই ব্যথা অনুভূত হয় না। স্তনের ফাইব্যোসিসটিক পরিবর্তন কোনো ধরনের ল্যাম্প বা চাকার অনুপস্থিতি সত্ত্বেও স্তন কোষকলা থেকে ব্যথা অনুভূত হওয়া টিউমার অথবা অন্য বিভিন্ন অস্বাভাবিকতা দেখা দেওয়া। স্তনের চেয়ে বরং বুকের নিচের দিকের বক্ষ প্রাচীর থেকে ব্যথা বেশি হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে আবার মাংসপেশি অথবা হাড়ের সমস্যা থেকে এ ধরনের ব্যথা হতে পারে।

আন্তর্জাতিক ক্যানসার গবেষণা সংস্থা গ্লোবক্যান পরিসংখ্যান মতে, দেশে প্রতি বছর স্তন ক্যানসারে ১৭ হাজার ৭৮১ জন নারী আক্রান্ত হয় এবং ৮ হাজার ৩৯৬ জনের মৃত্যু ঘটে। তবে প্রকৃত সংখ্যা আরাে অধিক হতে পারে। বিশেষভাবে শিল্পসমৃদ্ধ পাশ্চাত্য দেশগুলোয়ই স্তন ক্যানসার বেশি দেখা যায়। এ জন্য স্তন ক্যানসারকে Disease of Civilization বলা হয়ে থাকে। স্তন ক্যানসারের চিকিৎসায় নিয়োজিত ও গবেষণারত চিকিৎসকের পরিসংখ্যান মতে, প্রতি বছর ৩৬ হাজার স্তন ক্যানসার আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু হয়। যার মধ্যে টিনএজদের সংখ্যা প্রায় ৫ হাজার ৫০০। তবে সঠিক সরেজমিনের পরিসংখ্যানটি নেই বিধায় তাদের ধারণার ওপর ভিত্তি করে কাজ চালিয়ে যেতে হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গাইনি ক্যানসার বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সাবেরা খাতুন টিনএজেেদর স্তন ক্যানসার নিরাময়যোগ্য বিষয়ে উল্লেখপূর্বক বলেন, ‘স্তন ক্যানসারের চারটি ধাপ নির্ধারণ করে চিকিৎসাকর্ম করতে হয়। প্রথম ধাপে চিহ্নিত হলে সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব। আর অন্য স্তরগুলোয় পর্যায়ক্রমে জটিল থেকে জটিলতর অবস্থা থাকে। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তিকে কোনোভাবে নিরাময় করা সম্ভব হয় না। টিনএজদের স্তন ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসা দুভাবে করা হয়। প্রথমে ক্যামোথেরাপি দিয়ে চাকাটি হ্রাস করে অস্ত্রোপচার করা হয়। এতে রোগী ক্যানসারের প্রাদুর্ভাবের কবল থেকে মুক্ত হয়। পরে প্রয়োজনবোধে রেডিওথেরাপি দেওয়া হয়। তবে বলাবাহুল্য, রোগী তার স্তনে চাকার উপস্থিতি টের পেলেও অভিভাবকদের জানাতে বিলম্ব করে ফেলে। আর অভিভাবকরা চিকিৎসকের কাছে শরণাপন্ন হতে দেরি করে ফেলে। ফলে বেশির ভাগ সময়ে অভিভাবকরা দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং ক্ষেত্রে বিশেষে চতুর্থ ধাপ পর্যন্ত বিলম্ব ঘটিয়ে ফেলেন। স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত অনেক নারী আবার হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকের দ্বারস্থ হন। এতে ঝুঁকির মাত্রা আরো বৃদ্ধি পায়।’

স্তন ক্যানসার নারীদের জন্য একটি ভীতিকর অসুখ। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ শনাক্ত করা গেলে চিকিৎসার মাধ্যমে আয়ু বৃদ্ধি করা সম্ভব। তাই বিলম্ব না করে রোগটি শনাক্ত করে চিকিৎসার জন্য ২০ বছর বয়স থেকেই মেয়েদের মাসে অন্তত একবার নিজে হাত দিয়ে স্তন ও বগল পরীক্ষা করা দরকার। অর্থাৎ স্তন ক্যানসার প্রাথমিক পর্যায়ে নির্ণয়ের জন্য একটি অত্যন্ত কার্যকর পদ্ধতি হলো নিজের স্তন নিজে পরীক্ষা করা (Breast Self Examination-BSE)। যদি হাতে কোনো চাকা অনুভব করা যায়, যা আগে ছিল না তাহলে সতর্ক হওয়া জরুরি। চাকাটি স্তনের চামড়া বা স্তনবৃন্তের সঙ্গে ঘনভাবে সন্নিবেশিত থাকলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। তা ছাড়া চল্লিশের অধিক বয়সী নারীদের নিজের স্তন নিজে পরীক্ষা ছাড়াও বছরে অন্তত একবার মোমোগ্রাম করানো ভালো। মরণঘাতী স্তন ক্যানসার থেকে মুক্ত থাকতে হলে নারীদের এখন সচেতন হতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist