সাবরিনা শুভ্রা

  ১২ জানুয়ারি, ২০১৮

বাল্যবিয়ে

একটি সামাজিক রোগ

বাল্যবিয়ে আমাদের সমাজে অতি প্রাচীন একটি রোগ। শিক্ষা ও সভ্যতার আলো বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে এই রোগ থেকে সমাজ ক্রমেই মুক্তি লাভ করছে। কিন্তু সমাজে এখনো এমন মানুষের সংখ্যা অনেক, যারা এই রোগ থেকে মুক্ত নন। তারা মেয়ের জন্য ভালো কোনো ‘সম্বন্ধ’ এলেই হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। মেয়ের বয়সের দিকে না তাকিয়েই ‘উপযুক্ত’ পাত্রের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য তাড়াহুড়া শুরু করেন। অথচ এই কাজটির মাধ্যমে তিনি মেয়ের কত বড় ক্ষতি করতে চলেছেন, তা একবারও ভাবেন না। মেয়ের শারীরিক বৃদ্ধি বা পরিবর্তন পূর্ণতা পাওয়ার আগে বিয়ে দিলে কী ধরনের ক্ষতি হয়, সে সম্পর্কেও তাদের বিশেষ জ্ঞান নেই। এ কারণেই আইন করে বিয়ের বয়স নির্দিষ্ট করে দেওয়া সত্ত্বেও সারা দেশেই এখনো ব্যাপক হারে চলছে বাল্যবিয়ে।

নারীর ক্ষমতায়ন, স্বাস্থ্য পরিচর্চা, বিনামূল্যে শিক্ষা, শিশুমৃত্যুর হার রোধসহ নানা বিষয়ে বাংলাদেশের সাফল্য বিশ্বজুড়ে নন্দিত। এ আলোর পাশাপাশি রয়েছে অন্ধকার। বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের প্রবণতা নানা ক্ষেত্রের সাফল্যকে মøান করে দিচ্ছে। আমাদের দেশের মেয়েদের এক বড় অংশের বিয়ে হয় ১৮ বছরের নিচে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, বাল্যবিয়ের জন্য যাতে আইনগত ঝামেলায় পড়তে না হয় তা নিশ্চিত করতে বিয়ে নিবন্ধনের সময় ছেলে ও মেয়েদের বয়স বাড়িয়ে দেখানো হয়। বিয়ে নিবন্ধনকারী শুধু নয়, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি অর্থাৎ চেয়ারম্যান ও মেম্বার এমনকি সংসদ সদস্যদের উপস্থিতিতেও বাল্যবিয়ের ঘটনা অহরহ ঘটছে। বাল্যবিয়ে দেশের সুনামের জন্য বিড়ম্বনা সৃষ্টি করছে।

বাল্যবিয়ে একটি সামাজিক কু-প্রথা। কঠোর আইন, গণসচেতনতার অভাব, ভ্রাম্যমাণ টাউট-বাটপার শ্রেণির মোড়ল ও মাতাবরদের কারণে বাল্যবিয়ের ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। সমাজের তথাকথিত এসব মোড়ল বা মাতাবর গ্রামের মানুষকে জিম্মি করে বাল্যবিয়েসহ বিভিন্ন অপকর্ম করে যাচ্ছে। পারিবারিক, সম্পত্তিগত ও সামাজিক বিরোধের সুযোগ নিয়ে এই তথাকথিত মোড়লরা নিরীহ মানুষদের মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে সর্বস্বান্ত করে দেয়। এদের কারণে অনেক পরিবার ভেঙে যায়। মামলা-মোকদ্দমায় সহায় সম্পদ হারিয়ে অনেক নিঃস্ব হয়ে নিজের জš§স্থান ছেড়ে চলে যায়। তথাকথিত এই মোড়লরা নিজের সামান্য আর্থিক লাভের জন্য মানুষের বড় ধরনের ক্ষতি করছে।

শিক্ষাই জাতির মেরুদ-। বিশ্বে যে জাতি যত শিক্ষিত সে জাতি তত উন্নত। সন্তানদের শিক্ষা গ্রহণে মায়েদের ভূমিকা অপরিসীম। মা শিক্ষিত হলে সন্তানরা সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়। এ জন্য বিশ্বজয়ী নেপোলিয়ন বলেছিলেন, ‘তোমরা আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের শিক্ষিত জাতি দেব’। একটি দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। আমাদের দেশের নারীরা শিক্ষা ক্ষেত্রে এখনো পিছিয়ে রয়েছে। আমাদের রক্ষণশীল সমাজে নারী শিক্ষাকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হয়। অনেক গ্রামাঞ্চল রয়েছে, যেখানে মেয়েদের শিক্ষা অর্জন তো দূরের কথা, ঘর থেকে বের হতে দেওয়া হয় না। সরকার দেশের শিক্ষা প্রসারে নারী শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। নারীদের শিক্ষাগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে স্নাতক পর্যন্তÍ অবৈতনিক, বিনামূল্যে বই বিতরণ ও উপবৃত্তির ব্যবস্থা করেছে। এ ক্ষেত্রে মেয়েদের আঠারো বছরের আগে বিয়ে না দেওয়ার শর্ত রয়েছে। বাল্যবিয়ে রোধে সরকার আইনপ্রণয়ন করেছে। তার পরও এক শ্রেণির বাবা-মা তাদের মেয়েদের বাল্যবিয়ে দিচ্ছে। প্রবাসী পরিবারে এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটছে।

বিআইডিএস ও ইউনিসেফের যৌথ গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৮ বছরের আগে প্রতি পাঁচজন মেয়ের একজনের বিয়ে হয়ে যায়। মেয়েদের বিয়ের সর্বনিম্ন বয়স ১৮ বছর নির্ধারণ করা হলেও তা মানা হয় না বললেই চলে। পরিণতিতে দেশে ১৫ বছরের নিচে বিবাহিত নারীর সংখ্যা এখন ২০ লাখ, যা মোট বিবাহিত নারীর ২৯ ভাগ। অন্যদিকে ১৮ বছরের নিচে বিবাহিত নারীর সংখ্যা ৪৫ লাখ, যা মোট বিবাহিত নারীর ৬৫ ভাগ। বাল্যবিয়ের কারণে অল্প বয়সে মেয়েরা সন্তানসম্ভবা হচ্ছে। প্রসূতি স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি ডেকে আনছে।

প্রতি বছর ১৮ বছরের কম বয়সী সন্তানসম্ভবা ২৩ হাজার মা প্রাণ হারাচ্ছেন প্রসব জটিলতায়। বাল্যবিয়ের কারণে বাড়ছে বিবাহবিচ্ছেদ ও বহুবিবাহের প্রবণতা। বাল্যবিয়ে টিকে আছে কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনোভাবের কারণে। শখ পূরণের জন্য নিজেদের শিশুসন্তানকে বিয়ে দেন এমন বাবা-মায়ের সংখ্যা এ দেশে অসংখ্য। এর পাশাপাশি রয়েছে সামাজিক নিরাপত্তার অভাব। আমাদের দেশের শতকরা ৯০ ভাগ মেয়েকে কিশোরী বেলার শুরুতেই বখাটেদের উৎপাতের মুখে পড়তে হয়। যে কারণে গ্রামাঞ্চলের বাবা-মায়েরা তাদের কন্যাসন্তানের বিয়ের ক্ষেত্রে তাড়াহুড়া করেন। বাল্যবিয়ে বন্ধে সর্বাগ্রে সামাজিক সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। একই সঙ্গে দরকার আইন মেনে চলার মনোভাব। কাবিনে বয়স কমিয়ে বিয়ে রেজিস্ট্রেশন করা অলিখিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বেআইনি কর্মকা- বা অনাচার বন্ধে সক্রিয় হতে হবে। বিয়ের সময় জন্মনিবন্ধন সার্টিফিকেট কিংবা স্কুলের বয়স-সংক্রান্ত প্রমাণপত্র হাজির বাধ্যতামূলক করা যায় কিনা ভেবে দেখতে হবে।

লেখক : গবেষক, কলামিস্ট ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist