রানীশংকৈল ও হরিপুর প্রতিনিধি

  ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৯

সীমান্তে মিলনমেলায় প্রাণের বন্যা

‘হায় মাঝে হলো ছাড়াছাড়ি, গেলেম কে কোথায়/আবার দেখা যদি হলো, সখা, প্রাণের মাঝে আয়।’ রবীন্দ্রনাথের এই গানের মতোই আকুতি নিয়ে দীর্ঘদিন পর মিলিত হয়েছিল ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল ও হরিপুর উপজেলার বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে দুই বাংলার মানুষ। প্রতি বছরের মতো গতকাল শুক্রবারও ওই সীমান্তে এপার-ওপারের লক্ষাধিক মানুষের মিলন মেলায় অধিকাংশের চোখে ছিল আনন্দাশ্রু। ছিল কান্নার রোল, অনুভব করেছেন প্রিয়জনকে চোখে দেখার আনন্দ।

স্বজনরা প্রতি বছরের এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করে থাকেন। এই দিনটিতে নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পান। লাখো লোকের ভিড়ে স্বজনকে খুজতে চলে যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কুশল বিনিময়, উপহার প্রদান, চোখের দেখায় পার করেন নির্ধারিত সময়। জেলা শহর থেকে প্রায় ৭৫ কিলোমিটার দূরে রানীশংকৈল উপজেলার কোচল ও হরিপুর উপজেলার ভাতুরিয়া ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামের জামোরকালি জিউ মন্দির কমিটি প্রতি বছর এই মেলার আয়োজন করে। ওই দুই উপজেলার কোচল ও চাপসার সীমান্তের গোবিন্দপুরে কুলিক নদীর পাড়ে বসে সেই মিলন মেলা।

এই দিন ভোর থেকেই দুই দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে হাজার হাজার নানা বয়সি নারী-পুরুষ এসে সেখানে জড়ো হন। স্থানীয়রা বলেন, ব্রিটিশ আমল থেকেই সীমান্ত ঘেঁষা গোবিন্দপুরের এই মেলা ‘পাথর কালি মেলা’ নামে পরিচিত ছিল। প্রতি বছরে এখানে এক দিনের জন্য এই মেলা বসে। দেশ বিভাগের পর মেলাটি বাংলাদেশের অংশে পড়ায় সেখানে ভারতীয়দের অংশগ্রহণের জন্য ওই দিন সীমান্ত উন্মুক্ত করে দেয় ভারত। কোনো প্রকার বাধা ছাড়া সীমান্তের কাঁটাতারের এপারে-ওপারে জড়ো হয়ে স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় একে অপরকে মিষ্টি, আপেল, কমলা, থ্রিপিজ, শাড়ি, লুঙ্গি, ইলিশ মাছসহ নানা প্রকার উপহার প্রদান করে। আলাপচারিতায় মেতে উঠেন প্রিয়জনের সঙ্গে।

সাধারণত কালী পূজার পরে ডিসেম্বর মাসের সপ্তাহের প্রথম শুক্রবারে এ মেলা বসে। প্রিয়জনের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হাতছাড়া করতে চান না বলে অনেকে দূর-দূরান্ত থেকে স্থানীয়দের বাড়ি ঘরে এসে আশ্রয় নেন। অনেকে শখের বসেও মেলাটি দেখতে আসেন। ভারতের মাকর হাট ক্যাম্পের বিএসএফ সদস্যরা সীমান্তের ৩৪৬নং পিলারের সীমানায় কাঁটাতারের পাশে সাক্ষাৎ করতে দেয় দুই দেশের মানুষকে।

মেলাস্থলে কথা হয়, গাইবান্ধার গোবিন্দ উপজেলার অখিল চন্দ্র পাল (৬২) এর সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানালেন ভারতের রায়গঞ্জ তার বড় ভাই শিশির চন্দ্রের বাড়ি। দেশ স্বাধীনের আগে তার বড় ভাই ভারতে চলে যান। প্রথমদিকে ভিসা-পাসপোর্ট ছাড়া খুব সহজে যাতায়াত করতে পারতেন। এখন কড়াকড়ির কারণে ভাই ও ভাইয়ের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে দেখা করতে প্রতি বছর এই মেলায় আসেন। এ ছাড়াও দিনাজপুরের জ্যাতিষ চন্দ্র রায়ের সঙ্গে কথা হয়, জ্যাতিষ চন্দ্র রায় (৫০) বলেন, ভারতের উত্তর দিনাজপুরে আমার বোনজামাই থাকেন। তাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম। রসুলপুরের মুর্তজা (৫৫) জানান, পশ্চিমবঙ্গের মালদার কালিয়াচোখ থানাই ভাগিনা আশরাফ আলী (৩৫) থাকেন। দেশ স্বাধীনের আগে আমার বোনের ভারতে বিয়ে হয়েছে। বোনের শ্বশুরবাড়িতে যাওয়া হয় না। তাই এখানে এসেছি দেখা করতে।

সেতাবগঞ্জের বিমল, রঞ্জন, দীপু, সঞ্জয়, পীরগঞ্জের রাজু, শাহা আলম, ঠাকুরগাঁওয়ের অনিল, গনেশ, পুলক, মধু, পঞ্চগরের বিনয় চন্দ্র, মহেশ চন্দ্র, গীতা রানী, দেবীগঞ্জের শ্যামলী জানান, ভারতে বসবাসরত আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতেই এ মেলায় এসেছি। এই দিনটির জন্য সারা বছর অপেক্ষা করি।

জামোরকালি জিউ মন্দির কমিটি সভাপতি ও পূজা উদ্যাপন কমিটি সভাপতি নগেন কুমার পাল বলেন, ভারত বিভাগের আগে থেকেই এই মেলা হয়ে আসছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা পাই। মেলাকে কেন্দ্র করে বিজিবি ও বিএসএফের পতাকা বৈঠক হয়। এটি এই অঞ্চলের ঐতিহ্য।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close