রায়হান আহমেদ তপাদার

  ১৫ মার্চ, ২০২০

সিরিয়া ইস্যুতে তুরস্ক ও রাশিয়া

পৃথিবীর বহুল আলোচিত ইস্যু সিরিয়া। ২০১১ সালে শুরু হওয়া এই সংঘাতে পরাশক্তি রাশিয়া সরাসরি জড়িয়ে পড়ে ২০১৫ সালে। ওই সময়ের মধ্যে সিরিয়ার বেশির ভাগ এলাকাই বিদেশি মদদপুষ্ট সন্ত্রাসীদের দখলে চলে যায়। এ সময় বিদ্রোহীদের হাতে নাস্তানাবুদ হতে থাকে আসাদ বাহিনী। এ পর্যায়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দামেস্কের প্রধান মিত্র রাশিয়া সামরিক সহযোগিতার মাধ্যমে সেখানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সক্ষম হয়। এই প্রেক্ষাপটেই সিরিয়ার সরকার ও জনগণের মধ্যকার ঐক্য সুদৃঢ় হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে সমগ্র দেশে সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হলেও ব্যতিক্রম থাকে সামান্য কিছু এলাকা। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ইদলিব। তুরস্কের সীমান্তবর্তী সিরিয়ার এই গুরুত্বপূর্ণ এলাকার শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে এখন পর্যন্ত প্রধান বাধা তুরস্ক।

আমরা যদি লক্ষ করি তাহলে দেখব যে, ২০১৫ সালের পর কোনো একসময় তুরস্ক রাশিয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সিরিয়া ইস্যুতে পশ্চিমাদের বিপরীতে অবস্থান নেয়। যদিও আঙ্কারা আসাদ সরকারকে শত্রু হিসেবেই বিবেচনা করে। আর গত বছর দুয়েক ধরে তুরস্ক নানাভাবে সিরিয়া ইস্যুতে আলোচনায় থাকলেও তার ভূমিকা নিয়ে সবাই ছিলেন সন্দিহান। তুরস্কের মনোভাবের এই নগ্নতা সম্প্রতি খুব পরিষ্কার হয়ে ওঠে। সিরিয়ার ইদলিব শহর আঙ্কারা-মস্কো এবং আসাদপন্থি ও আসাদবিরোধী বিদ্রোহীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। মূলত তিনটি বিষয়ের জন্য আঙ্কারার কাছে ইদলিবের গুরুত্ব অসীম। প্রথমত, ইদলিবেই রয়েছে আসাদবিরোধী বিদ্রোহীদের সর্বশেষ ঘাঁটি, যারা তথাকথিত আরব বসন্তের শুরু থেকেই আসাদ পরিবারের নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াই করে চলছে। এবং দ্বিতীয়ত, ইদলিবেই রয়েছে সিরিয়ার সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির।

যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার নানা প্রান্তের মানুষ জীবনের তাগিদে জড়ো হয়েছে ইদলিবে। তাই ইদলিব আসাদের দখলে গেলে জাতিসংঘের তথ্যানুসারে প্রায় ৭ লাখ শরণার্থীকে জায়গা দিতে হবে তুরস্ককে। এরই মধ্যে তুরস্কে অবস্থানরত ৪০ লাখ সিরীয় শরণার্থীর সঙ্গে আরো ৭ লাখ শরণার্থী যোগ হলে তার ভরণপোষণের ক্ষমতা আদতে আঙ্কারার নাগালের বাইরে। তৃতীয়ত, ইদলিব আসাদের করতলগত হলে, তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্তবর্তী অঞ্চল পুনরায় দখল করার জন্য হামলা চালাবে আসাদ বাহিনী। তুর্কি সেনাবাহিনী এই অঞ্চল আন্তর্জাতিকভাবে সন্ত্রাসী ঘোষিত পিকেকের কাছ থেকে দখল করেছিল। পিকেকে ৪০ বছর ধরে তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে এবং আদর্শিক বোঝাপড়ার জায়গা বদল করে মার্কিনদের সহযোগী হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতা কাঠামো ইসরায়েলকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। তাই রাশিয়ার পক্ষে কোনোভাবেই ইসরায়েলকে পাশ কাটিয়ে কাজ করার সুযোগ নেই।

গত মাসে পুতিনের ইসরায়েল সফরের সময়ে নেতানিয়াহু ইসরায়েলের নিরাপত্তার কথা ভেবে সিরিয়ায় আঙ্কারা-মস্কোর মৈত্রীর বিষয়টি পুতিনের কাছে তোলেন এবং এই মৈত্রীর ইতি টানতে পুতিনকে রাজি করাতে সমর্থ হয়। সেই সূত্র ধরেই ইদলিবে এই হাঙ্গামার অবতারণা বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। সিরিয়ার ইদলিব শহরের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে থাকবে, তা নিয়ে মস্কো ও আঙ্কারার মধ্যে কয়েক দফা আলোচনা নিষ্ফল হয়েছে। উভয়পক্ষের অনড় অবস্থান ইদলিবে যুদ্ধাবস্থা জিইয়ে রেখেছে। চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে সিরীয় সেনাবাহিনী রুশ বিমানের সহায়তায় ১২ তুর্কি সেনাকে হত্যা করা থেকে এই হাঙ্গামার শুরু।

কিন্তু এই হামলায় রুশ বিমানবাহিনীর অংশগ্রহণের ঘটনায় মস্কো-আঙ্কারার বন্ধুতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যে মস্কো-আঙ্কারার জোটের এই বিবাদ পশ্চিমাদের খুশি করেছে। ওয়াশিংটন, ব্রাসেলস থেকে আঙ্কারার প্রতি সমর্থনের রব উঠেছে এবং হামলার জন্য আসাদ ও রাশিয়াকে দায়ী করা হয়েছে। আল জাজিরার সর্বশেষ খবরে প্রকাশ, বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি এরদোয়ান-ট্রাম্প ফোনালাপ হয়েছে। তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্তে সম্ভাব্য সিরীয়-রুশ যৌথ হামলা মোকাবিলায় তুরস্কের পক্ষ থেকে আমেরিকার প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের অনুরোধ করা হয়েছে। ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে এখনো কোনো প্রতিশ্রুতি আসেনি। তবে ইদলিবে তুর্কি সেনাদের ওপর হামলাকারীদের বিরুদ্ধে অবরোধের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। আপাতত আঙ্কারা ওয়াশিংটনের এই অবস্থানে সন্তুষ্ট। কারণ আঙ্কারা বড় দুই শক্তির কোনো এক দলের দিকে পুরোপুরি না ঝুঁকে ভারসাম্য রক্ষা করে নিজস্ব শক্তি বাড়াতে চায়। ভারসাম্য রক্ষার এই নীতি আঙ্কারাকে অনেক সময় সুবিধা দিলেও বন্ধুহীন করার বেলায়ও ইতোমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

এদিকে তুরস্কের কর্মকান্ড সিরিয়া ইস্যুতে আন্তর্জাতিক পক্ষগুলোর ষড়যন্ত্রমূলক ভূমিকা আরো প্রকাশ্য হয়ে উঠল। এ রকম উত্তেজনাকর অবস্থানের মধ্যেই তুরস্কের পাল্টা আক্রমণে কয়েকজন সিরীয় সেনা নিহত হলে ইদলিব ঘিরে যুদ্ধের দামামা শুরু হয়। তুরস্কের যুদ্ধংদেহী মনোভাবে পরিস্থিতি ঘোলাটে হতে থাকলে সিরিয়া ইদলিবের আকাশসীমা বন্ধ করে দেয়। এরপর তুরস্কের কিছু ড্রোন সিরিয়ার আকাশে অনুপ্রবেশ করলে সিরিয়ান সেনারা সেগুলোকে গুলি করে ভূপাতিত করে।

অন্যদিকে তুরস্ক সিরিয়ার একটি পুরোনো মডেলের যুদ্ধবিমান টিএল-৩৯ গুলি করে নামায়। এ রকম পরিস্থিতির মধ্যেই সিরিয়ার আকাশসীমা ও তৎসংলগ্ন কৌশলগত এলাকায় টার্কি বিমানের চলাচলের ব্যাপারে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে মস্কো। ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে খুব স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়া হয় যে, তুরস্কের বিমানের নিরাপত্তা নিশ্চয়তার ভার মস্কো আর নিতে পারবে না। অন্যদিকে ইরানের সেনাবাহিনীও টার্কি সেনাদের দায়িত্ব-কর্তব্য ও সীমাবদ্ধতা-সংক্রান্ত প্রচ্ছন্ন হুশিয়ারি উচ্চারণ করলে অনেকটাই চাপে পড়ে তুরস্ক। ফলে ইদলিব পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে।

এদিকে এই ইস্যুতে আমেরিকা ও ন্যাটো তুরস্ককে সমর্থন দিয়ে সিরিয়াকে চাপে ফেলে দেয়। যদিও ন্যাটো ও আমেরিকার চাপ অগ্রাহ্য করে সিরিয়ার সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী। এ রকম প্রেক্ষাপটে মাত্র কদিন আগে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান মস্কোতে রুশ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ইদলিব ইস্যুতে একটি সমঝোতায় পৌঁছেন। এরপরই সেখানে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। যদিও এই যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়নের পথে সবার সহযোগিতা চেয়ে নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়ার উত্থাপিত একটি প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে আমেরিকা ও ব্রিটেন। ওয়াশিংটন যখন সিরিয়া আর ইরাকযুদ্ধকে অমরত্ব দিয়ে চলছিল, তখন আঙ্কারা ন্যাটোর সদস্য হওয়া সত্ত্বেও যুদ্ধ থামিয়ে আলোচনার মাধ্যমে বিবাদ মীমাংসার আবেদন নিয়ে রাশিয়ার দ্বারস্থ হয়। কারণ ইরাক আর সিরিয়ার যুদ্ধে তুরস্কের অর্থনীতি ও সামাজিক কাঠামো সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

অপরদিকে তুরস্কের আবেদনে সাড়া দিয়ে ইরান ও রাশিয়া তুরস্কের সঙ্গে একযোগে সিরিয়া যুদ্ধের সমাধান খুঁজে বের করে। এবং পশ্চিমাদের বাইরে গিয়ে ২০১৭ সালের মে মাসে চুক্তি স্বাক্ষর করে, যা আস্তানা চুক্তি নামে পরিচিত। পরবর্তী সময়ে বহুবার এই চুক্তির আওতায় রাশিয়া, ইরান আর তুরস্ক মিলিত হয়েছে সোচি, জেনেভা আর ইস্তাম্বুলে। চুক্তির ধারা অনুযায়ী রাশিয়া, ইরান আর তুরস্ক মিলে সিরিয়ায় ‘স্ট্যাটাস কু’ রক্ষা করে ‘সংঘর্ষবিহীন অঞ্চল’ প্রতিষ্ঠা করবে। সেই মোতাবেক শর্ত মেনে রাশিয়ার পাশাপাশি তুরস্ক ইদলিবে বিদ্রোহী আর সরকারি বাহিনীকে সংঘর্ষ থেকে বিরত রাখার উদ্দেশ্যে ১২টি ছোট ছোট সেনা পোস্ট স্থাপন করে। পশ্চিমাদের বিশেষ করে মার্কিনদের বাইরে রেখে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধকে থামাতে এটাই ছিল বড় ধরনের কোনো প্রচেষ্টা। যে প্রচেষ্টার মাধ্যমেই মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার উপস্থিতি রাজনৈতিকভাবে বৈধতা পেয়েছে। একই সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিনবিরোধীরা তুরস্ক-রাশিয়া-ইরানে জোটের মধ্যে নতুন মার্কিনবিরোধী জোটের আশার আলো পেয়েছিল। মার্কিনদের বন্ধুত্ব বিশ্ব দরবারে পিকেকে বিপ্লবীর খেতাব এনে দিলেও কুর্দিদের একটি অংশ এই খেতাব মেনে নেয়নি। রাশিয়ার কল্যাণে আসাদ ও পিকেকে অতীতের ঝামেলা মিটিয়ে তুরস্কের বিরুদ্ধে এক হয়েছে। তাই আঙ্কারার পক্ষ থেকে হিসাব পরিষ্কার। তুরস্ক সীমান্তবর্তী অঞ্চলে আসাদের কর্তৃত্বের অর্থ পিকেকের বিজয়োল্লাস। তাই ইদলিব ধরে রাখার মধ্যেই আঙ্কারা নিজ সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোর নিরাপত্তা দেখছে। আস্তানা চুক্তি বাতিলের মধ্য দিয়ে রাশিয়া নিজেদের কল্পিত মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র অঙ্কনে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে।

এমনকি ইদলিবের পাশাপাশি আসাদ এম-৪ এবং এম-৫ মহাসড়কের দখলও ফিরে পেতে চান। কারণ, এই দুটি মহাসড়ক ঘিরেই সিরিয়ার বাণিজ্যের প্রায় ৬০ ভাগ সম্পন্ন হয়। এই সড়ক দামেস্কের সঙ্গে আলেপ্পোকে যুক্ত করেছে। তবে আসাদকে হামলার এই উসকানি দিয়ে মস্কো নিজেদের করা চুক্তিকেই ভেঙে ফেলল। নতুন এই জোটের অবয়ব ধীরে ধীরে পরিষ্কার আকার ধারণ করে বিস্তৃত হয়েছিল লিবিয়া পর্যন্ত। কিন্তু কাশেম সোলাইমানির মৃত্যু আর মার্কিনদের ফিলিস্তিনকে কেন্দ্র করে শতবর্ষের চুক্তি ঘোষণা করার পর রাশিয়া আগের চুক্তিতে অটল না থেকে সিরিয়ার ভূখন্ড থেকে তুর্কি সেনাদের প্রত্যাহার চাইছে। ইদলিব থেকে সৈন্য প্রত্যাহারে আঙ্কারা অস্বীকৃতি জানালে রাশিয়ার সহযোগিতায় সিরীয় সেনারা তুর্কি সেনাদের ওপর আক্রমণ করা শুরু করে। তবে রাজনৈতিক সমালোচকরা বলছেন অন্য কথা। পুতিন লিবিয়ায় হাফতারের বৈধতায় আঙ্কারার সম্মতি আদায়ে ব্যর্থ হয়ে এবং ইসরায়েলের স্বার্থ রক্ষার জন্য ইদলিবে আক্রমণ শুরু করে। আঙ্কারা শুরু থেকেই হাফতারের বৈধতার বিপক্ষে।

এদিকে সিরীয় জনগণ কিংবা দেশটির সরকারকে সহযোগিতা করার কোনো লক্ষণ তুরস্কের আচরণে লক্ষ করা যায়নি; কিন্তু সিরীয় পরিস্থিতির আরো অবনতি হওয়ার কোনো আশঙ্কাই আর নেই। দিন যত যাবে সিরিয়ার সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ ততটাই বেগবান হবে। এ ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে যুদ্ধবিরতি শর্তের সামান্যতম অন্যথা হলে সিরিয়ান সেনারা কঠোর জবাব দেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে? প্রশ্ন হচ্ছে—এই যুদ্ধবিরতি কতটা মেনে চলবে তুরস্ক? একই সঙ্গে এই যুদ্ধবিরতির আওতায় সিরিয়ায় ক্রিয়াশীল সন্ত্রাসীদের সুরক্ষা দিতে তুরস্কও নতুন কোনো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হবে কি না? আর এমনটি হলে পরবর্তী পরিস্থিতি কী হতে পারে? বিশ্ববাসীর কাছে এই প্রশ্ন থেকেই যায়।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও বিশ্লেষক [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
রাশিয়া,সিরিয়া,তুরস্ক
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close