জুবায়ের চৌধুরী

  ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

আটকের গুঞ্জনও আছে

সম্রাটকে নিয়ে ধোঁয়াশা

*যেকোনো সময় গ্রেফতার *দেশত্যাগ ঠেকাতে রেড অ্যালার্ট *প্রতিদিন ৪০ লাখ টাকা চাঁদা আদায়

ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট

ক্রীড়ার জন্য গড়ে ওঠা ক্লাবে দীর্ঘদিন চলে আসছিল অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসা। আর এ ব্যবসা রমরমা করে গড়ে তোলেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট। সম্প্রতি ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হওয়ার পর তাই সম্রাট নামটি বেশি আলোচনায় এসেছে। বলা যায়, তিনি এখন ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। যুবলীগের এই সভাপতি শুধু নামেই নয়, ক্যাসিনো বাণিজ্যে তিনি ঢাকার মুকুটহীন সম্রাট! অভিযোগ আছে, রাজধানীর অন্তত ১৫টি ক্লাবে অবৈধ ক্যাসিনো পরিচালিত হচ্ছে তার মদদে।

গত ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গ্রেফতারের পর দু-এক দিন সম্রাটকে কাকরাইলের অফিসে দেখা গেলেও এরপর থেকে তিনি লাপাত্তা। তার অবস্থান নিয়ে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে, তার সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া দুষ্কর হয়ে গেছে। কেউ বলছেন আত্মগোপনে রয়েছেন। কেউ বলছেন তিনি হয়তো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে আছেন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি, সম্রাট প্রভাবশালী এক নেতার বাসায় আত্মগোপন করে আছেন। এ কারণেই বেশ কয়েক দিন ধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলে আসছে, যুবলীগ নেতা সম্রাট এখন তাদের নজরদারিতেই আছেন। সবুজসংকেত পেলেই যেকোনো সময় তাকে গ্রেফতার করা হবে।

এই ‘ক্যাসিনো সম্রাট’ যাতে দেশ থেকে পালাতে না পারেন, সে জন্য নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। জব্দ করা হয়েছে তার সব ব্যাংক হিসাব। এদিকে তার সহযোগী প্রভাবশালী একাধিক নেতাও পলাতক।

এদিকে গত শুক্রবার বনানী এলাকার একটি বহুতল ভবন থেকে ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটকে গ্রেফতারের গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। তবে দায়িত্বশীল কেউ গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করেনি। তবে গতকাল শনিবার এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছেন, ‘সম্রাট গ্রেফতার হয়েছে কি না তা দ্রুতই জানা যাবে।’

জানা গেছে, ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট চলমান ক্যাসিনো-জুয়াবিরোধী অভিযানের শুরু থেকে তাদের নজরদারির মধ্যেই ছিলেন। এ সময়ের মধ্যে তিনি বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও চালিয়েছিলেন। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার কারণে তিনি দেশ ছাড়তে পারেননি।

ঢাকায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছাকাছি পৌঁছেও তিনি ফিরে আসতে বাধ্য হন। পরে কাকরাইলে ভূঁইয়া ম্যানশনে ব্যক্তিগত কার্যালয়ে টানা ছয় দিন অবস্থান করেন। আর পাহারায় বসান শতাধিক যুবলীগ কর্মীকে। সেখান থেকে গত ২২ সেপ্টেম্বর তিনি বনানীর ডিওএইচএস এলাকার একটি বাসায় অবস্থান করছিলেন। সর্বশেষ সেখান থেকেই তাকে আটক করা হয়েছে। এই আটকের বিষয়টি স্বীকার করছে না সংশ্লিষ্ট কেউ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সম্রাট গোয়েন্দা হেফাজতেই আছেন। খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ও গোলাম কিবরিয়া শামীমকে জিজ্ঞাসাবাদে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছেন তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা। আর ওই দুজনের দেওয়া তথ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশে সম্রাট দম্পতির ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। একই সঙ্গে সম্রাটের আর্থিক লেনদেনের বিষয়টির চুলচেরা বিশ্লেষণ শুরু করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সরকারের কয়েকটি সংস্থা।

ক্যাসিনোবিরোধী সাঁড়াশি অভিযানেও গডফাদার হিসেবে পরিচিত সম্রাটকে কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে নাÑ এমন প্রশ্ন এখন সবার মুখে মুখে। তবে সম্প্রতি ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘শুধু সম্রাট নয়, অনেকের নামই উঠে আসছে। তদন্ত শুরু হয়েছে, তদন্ত করে সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ক্যাসিনোর টাকার ভাগ যারাই পেয়েছেন, তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, গডফাদার-গ্র্যান্ডফাদার বলতে কিছু নেই। আমরা চিনি অপরাধীকে। অপরাধী যে বা যারাই হোক, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। আর র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) কর্নেল তোফায়েল মোস্তফা সরোয়ার বলেছেন, সম্রাটের অবস্থানের বিষয়ে আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তাকে গ্রেফতারের ক্ষেত্রেও কোনো বাধা নেই। তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, শুধু দেশেই নয়, সিঙ্গাপুরের সেরা কয়েকজন জুয়াড়ির মধ্যে সম্রাট অন্যতম। সেখানে তিনি ভিআইপি জুয়াড়ি হিসেবে পরিচিত। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, টাকার বস্তা নিয়ে মাসে অন্তত ১০ দিন সিঙ্গাপুরে জুয়া খেলতে যান সম্রাট। সিঙ্গাপুরের সবচেয়ে বড় জুয়ার আস্তানা মেরিনা বে স্যান্ডস ক্যাসিনোতে প্রথম সারির জুয়াড়ি তিনি। সিঙ্গাপুরের চেঙ্গি এয়ারপোর্টে ভিআইপি মর্যাদা পান সম্রাট। এয়ারপোর্ট থেকে বিশেষ সম্মানের সঙ্গে রিসিভ করে বিলাসবহুল গাড়ি লিমুজিনে করে মেরিনা বে স্যান্ডস ক্যাসিনোতে নিয়ে যাওয়া হয় সম্রাটকে। বেশির ভাগ সময় যুবলীগ দক্ষিণের নেতা এনামুল হক আরমান, মমিনুল হক সাঈদ ওরফে সাঈদ কমিশনার, সম্রাটের ভাই বাদল ও খোরশেদ আলমও মাঝেমধ্যে তার সফরসঙ্গী হন।

জানা গেছে, সিঙ্গাপুর ছাড়াও ঢাকায় ইসমাইল হোসেন সম্রাট মুক্তিযোদ্ধা ক্লাব, ব্রাদার্স ক্লাব ও বনানী এলাকার গোল্ডেন ঢাকা ক্লাবের ক্যাসিনোগুলো সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করতেন। এ ছাড়া সম্রাটের হাত ধরে চলতে মতিঝিল এলাকার ফুটবল ক্লাব, আজাদ স্পোর্টিং ক্লাব, সোনালী অতীত ক্লাব, দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাব, আরামবাগ ক্লাব ও মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের ক্যাসিনো। ক্যাসিনো-জুয়াবিরোধী অভিযানে গ্রেফতার অনেকেই জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, ঢাকায় ক্যাসিনো ব্যবসার মূলে আছেন সম্রাট। তাকে গ্রেফতার করতে পারলেই অবৈধ এ বাণিজ্যের আদি-অন্ত বের করা যাবে।

ঢাকার ১৫ ক্লাবের চাঁদা পেতেন সম্রাট : গোয়েন্দা তথ্য বলছে, ক্যাসিনো সাম্রাজ্যের বড় একটি অংশই চালাতেন সম্রাট। তার অধীনে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে ১৫টিরও বেশি ক্যাসিনো। এসব ক্যাসিনো থেকে নাকি প্রতি রাতে ৪০ লাখ টাকারও বেশি টাকা পেতেন সম্রাট! কোনোটি থেকে প্রতি রাতে দুই লাখ টাকা, কোনোটি থেকে তিন লাখ টাকা, কোনোটি থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্তও চাঁদা পেতেন তিনি।

এসব ক্লাবের মধ্যে আলোচিত হচ্ছে—ভিক্টোরিয়া ক্লাব, কলাবাগান ক্লাব, সৈনিক ক্লাব, ঢাকা গোল্ডেন ক্লাব, ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, দিলকুশা ক্লাব, আরামবাগ ক্লাব, মোহামেডান ক্লাব, ফুয়াং ক্লাব, মুক্তিযোদ্ধা ক্লাব, ইয়াংমেন্স ক্লাব, এজাক্স ক্লাব ও উত্তরা ক্লাব। প্রতিদিনই ক্লাবগুলোতে কোটি কোটি টাকার জুয়া খেলা চলত।

জানা গেছে, সম্রাটের ক্যাডাররা গিয়ে ভাগের টাকা নিয়ে আসত। কোনো ক্যাসিনো ক্লাব টাকা দিতে অস্বীকার করলে নানা ধরনের চাপ প্রয়োগ করা হতো। কলাবাগান ক্লাবের ক্যাসিনো পরিচালনাকারী সম্রাটকে চাঁদা দিতে রাজি না হওয়ায় পুলিশ পাঠিয়ে সেটি বন্ধ করে দেন। এতে তার বিষয়ে ভীতি আরো পোক্ত হয়—ক্যাসিনো ব্যবসা করতে হলে সম্রাটকে চাঁদা দিয়েই করতে হবে। তবে, নানা খাত থেকে প্রাপ্ত অর্থ থেকে তার কর্মীদের ভাগ দিতে ভুল করতেন না সম্রাট। যে কারণে সুদৃঢ় চেইন অব কমান্ড মেনে ব্যবসা করে যেতে পেরেছেন তিনি।

দেশত্যাগ ঠেকাতে রেড অ্যালার্ট : ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে জড়িতদের দেশত্যাগ ঠেকাতে বেনাপোল সীমান্তে সর্বোচ্চ সতর্কতা (রেড অ্যালার্ট) জারি করা হয়েছে। বিষয়টি বেনাপোল ইমিগ্রেশন ও বিজিবি কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করেছেন। বেনাপোল ইমিগ্রেশনের ওসি মহাসিন খান পাঠান জানান, সীমান্তে সর্বোচ্চ সতর্কতা ও ইমিগ্রেশন পুলিশের নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। ঢাকা পুলিশের এসবি (স্পেশাল ব্রাঞ্চ) থেকে তাদের কাছে একটি নির্দেশনা এসেছে। ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে জড়িত ব্যক্তিসহ ৯ নেপালি নাগরিক যাতে কোনোভাবেই দেশ ত্যাগ করতে না পারেন, তার জন্য বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিদিন নতুন নতুন আরো নামের তালিকা আসছে বলেও জানান তিনি।

বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড বিজিবির ৪৯ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল সেলিম রেজা ও ২১ ব্যাটালিয়ন বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল ইমরান উল্লাহ সরকার জানিয়েছেন, রাষ্ট্র ঘোষিত অপরাধীরা যাতে কোনোভাবে সীমান্ত পথে অবৈধভাবে ভারতে পালাতে না পারেন, সে জন্য সীমান্ত এলাকায় সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করা হয়েছে।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট,ক্যাসিনো,যুবলীগ
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close