জুবায়ের চৌধুরী

  ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

শুদ্ধি অভিযান জোরদার আতঙ্কে অপরাধীরা

ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে অভিযান। ফাইল ছবি

দীর্ঘদিন ধরে রাজধানীর অভিজাত ক্লাবগুলোয় ক্রীড়া কার্যক্রমের আড়ালে চলছিল নিষিদ্ধ ক্যাসিনো। খেলাধুলার চেয়ে সেখানে প্রাধান্য পেত জুয়া, মাদক আর অবৈধ বাণিজ্য। এই ক্যাসিনো ঘিরে রমরমা ছিল আন্ডারওয়ার্ল্ড। সারাদেশের ঠিকাদারি কাজ নিয়ন্ত্রণ হতো সেখান থেকেই। অভিযান শুরুর পর মাফিয়া চক্রের কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদের পরই বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য।

দেশে পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট, ১৮৬৭ নামের যে আইনটি রয়েছে সেটি রাজধানীতে প্রয়োগ করার সুযোগ নেই। এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকা ছাড়া সমগ্র বাংলাদেশে ইহা প্রযোজ্য হইবে’। অন্যদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশ অধ্যাদেশ, ১৯৭৬-এর ৯২ ধারায় প্রকাশ্যে জুয়া খেলার জন্য মাত্র ১০০ টাকা জরিমানা করার বিধান রয়েছে।

চলমান ক্যাসিনো অভিযানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটা দুর্বল দিক হচ্ছে, নেপালি প্রশিক্ষিত জুয়াড়িসহ কোনো বিদেশিকেই এখন পর্যন্ত গ্রেফতার করতে পারেনি। ঢাকার এসব ক্যাসিনো পরিচালনার শুরু থেকেই নেপালি নাগরিকদের জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। যারা ক্যাসিনোর বোর্ড পরিচালনার পাশাপাশি বাংলাদেশিদের এ সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ দিতেন। তবে এখন পর্যন্ত একজন নেপালি নাগরিককেও আটক করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। আবার গত ১৮ সেপ্টেম্বর অভিযানের রাতে ১৫ নেপালি পালিয়ে যাওয়ার পেছনে পুলিশের কয়েকজন সদস্যকেও দায়ী করা হচ্ছে। সিসিটিভির ফুটেজ থেকে এমন তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে। সেসব পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে।

সরকারের পক্ষ থেকে বরাবরই বলা হচ্ছে, দুর্নীতিবাজদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। গতকাল ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, দুর্নীতি, মাদক ও জুয়ার বিরুদ্ধে চলমান অভিযান লোক দেখানো নয়। সহনীয় পর্যায়ে না আসা পর্যন্ত এই অভিযান চলবে। রাজধানীতে অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসায় জড়িত, কয়েকজন সংসদ সদস্য, ওয়ার্ড কাউন্সিলরসহ সরকার দলীয় নেতারা। অন্ধকার এ জগতের সঙ্গে সম্পৃক্ত, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্যও। গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য বলছে, এসবের মূল উদ্যোক্তা যুবলীগ নেতা সম্রাট ও আরমান। র‌্যাবের হুশিয়ারি, কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। অভিযুক্তদের বেশিরভাগই যুবলীগ নেতা হওয়ায় ক্ষুব্ধ ও হতাশ সংগঠনটির চেয়ারম্যান।

ক্যাসিনোতে পুলিশের সাঁড়াশি অভিযানের পর এখন গিয়ে লেগেছে সিনেমা পাড়াতেও। কারণ ক্যাসিনোর কাঁচা টাকা বিনিয়োগ হতো চলচ্চিত্র নির্মাণ কিংবা শোবিজের অঙ্গনের নানা আমোদ-প্রমোদে। আবার ক্যাসিনোর সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে উচ্চারিত হচ্ছে চলচ্চিত্র জগতের বেশ কয়েকজন অভিনেত্রীর নাম। পুলিশের হাতে আটক ক্যাসিনো মালিক ও টেন্ডারবাজ জি কে শামীম গোয়েন্দা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে বলেন, টেন্ডার পেতে চলচ্চিত্রের নায়িকাদের ব্যবহার করতেন তিনি! এতেই নড়েচড়ে বসেছে চলচ্চিত্র অঙ্গন।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলেন, অনেকেই অবৈধ ব্যবসা গুটিয়ে পালিয়েছেন। তালিকা ধরে সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। অভিযুক্তদের অধিকাংশই যুবলীগ নেতা। সংগঠনটির প্রধান ওমর ফারুক চৌধুরী জানান, ক্যাসিনো-কাণ্ডে যুবলীগ এখন ধ্বংসের পথে। দলটি পঙ্গু হয়ে গেল। বিএনপি বলছে, ঢাকা শহর মসজিদের শহর ছিল এখন ক্যাসিনোর শহর। এর থেকে নিগৃহীত হওয়ার আর কি আছে।

‘দুর্বল’ জুয়া আইনের ফাঁকফোকর : দেশে জুয়াবিরোধী একটি আইন আছে। তবে সে আইন দিয়ে রাজধানীতে গত এক সপ্তাহে বিভিন্ন ক্রীড়া ক্লাবের জুয়ার আসর থেকে আটক শতাধিক ব্যক্তির কারো বিরুদ্ধেই ওই আইনের আওতায় ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কারণ আইনটির সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকা ছাড়া সমগ্র বাংলাদেশে ইহা প্রযোজ্য হইবে’। অন্যদিকে ডিএমপির ৯২ ধারায় প্রকাশ্যে জুয়া খেলার জন্য মাত্র ১০০ টাকা জরিমানা করার বিধান রয়েছে। গত ১৮ সেপ্টেম্বর আটক ১৮০ জন জুয়াড়ির বিরুদ্ধে মাদক রাখা ও সেবনের অভিযোগে সাজা দেওয়া হয়েছে। শুধু যুবলীগ নেতা খালেদের বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক ও মুদ্রা পাচার আইনে মামলা হয়েছে।

মেনন, মাহবুব ও সামশুল হককে আইনি নোটিস : ক্যাসিনো চালিয়ে আসা ঢাকার ফকিরাপুলের ইয়ংমেনস ক্লাবের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান স্থানীয় সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন, বেসামরিক বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী এবং জাতীয় সংসদের হুইপ সামশুল হক চৌধুরীকেও আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. ইউনুছ আলী আকন্দ। নোটিসে বলা হয়, ‘ঢাকা-৮ সংসদীয় আসনের সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন ইয়ংমেনস ক্লাবের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান। ক্যাসিনে-কাণ্ডে অনেককে গ্রেফতার করলেও ক্লাবের চেয়ারমান রাশেদ খান মেননের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। অথচ এই সংসদ সদস্যকে প্রকাশ্য জুয়া আইনের ৩, ৪, ১৫ ধারা অনুযায়ী দায়ী করা যায়। তাছাড়া একজন আইন প্রণেতা হিসেবে রাশেদ খান মেনন ‘ক্যাসিনোর সাথে যুক্ত থেকে’ সংবিধানের ১৮ (২) অনুচ্ছেদ ও প্রকাশ্য জুয়া আইন, ১৮৬৭ লঙ্ঘন করেছেন। সংবিধান ও দণ্ডবিধি অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ এনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়।’

লাপাত্তা নেপালি জুয়াড়িসহ বিদেশিরা : ঢাকার ক্যাসিনো পরিচালনার শুরু থেকেই নেপালি নাগরিকদের জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। যারা ক্যাসিনোর বোর্ড পরিচালনার পাশাপাশি বাংলাদেশিদের এ সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ দিতেন। তবে এখন পর্যন্ত একজন নেপালি নাগরিককেও আটক করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। সংশ্লিষ্টরা বলেন, অভিযান শুরুর দিন থেকেই জড়িত সব নেপালি গা ঢাকা দিয়েছেন। তাদের সন্ধানে বেশ কয়েকটি স্থানে অভিযান চালিয়েও কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এরই মধ্যে তাদের কেউ কেউ দেশ ছেড়ে পালাতে পারেন বলেও ধারণা করা হচ্ছে।

জানা যায়, ঢাকার ক্যাসিনো ব্যবসা পরিচালনা শুরু হয় নেপালি নাগরিক দীনেশ মানালি ও রাজকুমারের হাত ধরে। তাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করতেন বিনোদ মানালি। পরে তাদের হাত ধরেই অজয় পাকরাল, হিলমি, ছোট রাজকুমার, কৃষ্ণা ঢাকার বিভিন্ন ক্যাসিনোতে কাজ শুরু করেন। চাহিদা অনুযায়ী ঢাকায় বিভিন্ন ক্লাবে নেপালি নাগরিকদের জোগানও দিতেন দীনেশ ও রাজকুমার। ঢাকার বিভিন্ন ক্যাসিনোতে শতাধিক নেপালি কাজ করতেন। তাদের কেউ কেউ প্রতিদিন মোট লাভের ২০ শতাংশ পেতেন। আবার অনেকে উচ্চ বেতনে চাকরি করতেন। নেপালিরা মূলত ক্যাসিনো ম্যানেজমেন্টের কাজ করতেন। ক্যাসিনো পরিচালনায় তারা বেশ দক্ষ। নেপালের নাগরিকদের বেতন অন্যদেশের ক্যাসিনো অপারেটরদের তুলনায় কম বলে ঢাকায় তাদের চাহিদা বেশি ছিল। তাদের মাধ্যমে বিপুল অর্থ পাচার হয়ে আসছিল।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
অপরাধী,আতঙ্ক,শুদ্ধি অভিযান,ক্যাসিনো
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close