কাজী জহিরুল ইসলাম

  ২০ এপ্রিল, ২০১৭

সমাজ

ধর্ম ও সংস্কৃতি দেশে দেশে

ভিনদেশি আচার-আচরণ এবং কিছু ধর্মীয় অনুষঙ্গ দেশীয় সংস্কৃতিতে যুক্ত হয়ে ধীরে ধীরে নতুন সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। যেমন পাকিস্তানিরা বা আরবরা আমাদের ভালো মুসলমান বলে না, কারণ আমাদের আচার-আচরণে বাঙালিত্ব আছে। ঠিক তেমনি বাংলাদেশের হিন্দুদের পশ্চিম বাংলার হিন্দুরা ভালো হিন্দু নাও বলতে পারে, কারণ তারা অনেক মুসলমানি আচরণ রপ্ত করে ফেলেছে। এই যে কিছু ধর্মীয় অনুষঙ্গ যুক্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে একটি সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, হতে পারে সংকট, এটাকেই মেনে নিতে হবে, শ্রদ্ধা করতে হবে এবং লালন করতে হবে। শুদ্ধীকরণ প্রচেষ্টা কোনো ভালো উদ্যোগ নয়। এতে উপকারের চেয়ে ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি। মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়ার দিকে তাকালে দেখা যায়, তাদের জীবনাচারের পরতে পরতে রামায়ণ-মহাভারত, কিন্তু তারা মুসলমান। মুসলমানিত্বের কারণে তারা রামায়ণ মহাভারত পরিহার করেনি। কারণ এটিই তাদের সংস্কৃতি। আমাদের বিশুদ্ধ বাঙালি বানানোর প্রচেষ্টা যেমন ঠিক নয়, তেমনি খাঁটি মুসলমান বানানোর প্রচেষ্টাও গর্হিত। বাংলাদেশে বাঙালি মুসলমানদের একটি নিজস্ব কালচার তৈরি হয়েছে। এটিই আমাদের আইডেন্টিটি।

এবার ছোট দুটো গল্প বলি। ২০০৭ সালের কথা। আমি তখন কাজ করি আইভরিকোস্টে। আমাদের অফিস একটি পাঁচতারা হোটেলে। হোটেলের নাম সেব্রোকো। পাহাড়ের ওপর হোটেল। অফিসের জানালা দিয়ে দেখা যায় বিশাল নীল লেগুনের অনেকখানি, কিছুদূর গিয়েই মিশেছে অতলান্তিকে। কাজ সেরে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরছি। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসছে আমার গাড়ি। নিচে, যেখানে হোটেল সেব্রোকোর সীমান্ত মিশেছে পিচঢালা সদর রাস্তায়, সেখানে দাঁড়িয়ে আছে কেউ একজন। হাত তুলল মেয়েটি। আমি গাড়ি থামালাম। সে তার আইডি তুলে ধরে বলল, আমাকে একটি রাইড দেবেন, ট্যাক্সির জন্য অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি। আমি ঝুঁকে পড়ে তার আইডি দেখলাম, নাম লেখা মরিয়ম ফাতুমাতু। অর্থাৎ, মেয়েটি মুসলমান। আমি ইশারা করতেই সে সামনের আসনে উঠে বসল। ২২-২৩ বছরের উর্বশী। আমার বাড়ি দ্যু-পাতু, মেয়েটি থাকে মার্কোরি। উল্টোপথ, লেগুনের অন্য পাড়ে। দ্য গল সেতু পার হতে হবে। কী আর করা, গাড়িতে যখন তুলে ফেলেছি, পৌঁছতে তো হবে।

দুজন মানুষ পাশাপাশি ৩৫-৪০ মিনিট বসে থাকবে অথচ কথা বলবে না, তা কি হয়? আমিই শুরু করি। বাসায় কে কে আছে তোমার? আমি আর আমার ছেলে, লামিন। লামিনের দেখাশোনা করে যে মেয়েটি, সেও থাকে আমাদের সঙ্গে থাকে। বয়স কত লামিনের? তিন বছর। আর তোমার স্বামী? আমার বিয়ে হয়নি। হঠাৎ আমি ব্রেকে পা দিই, ক্যা ক্যা করে একটি শব্দ হয়। চাকা এবং রাস্তার মল্লযুদ্ধ, নাকি আমার সংস্কার এবং মেয়েটির বাস্তবতার দ্বন্দ্ব? বুঝতে চেষ্টা করি। তুমি মুসলমান না? হ্যাঁ। এরপর মেয়েটি হাসে। দেখ, আমরা প্রথমে আফ্রিকান পরে মুসলমান। অনেক কট্টরপন্থি মুসলমান আছে এদেশে, যারা লিভ টুগেদার করে না। তবে আমাদের এখানে মুসলমানিত্বের কারণে লিভ টুগেদারকে কেউ খারাপ মনে করে না। এটিই আমাদের সংস্কৃতি। তুমি অনেককেই দেখবে নিয়মিত নামাজ পড়ছে, বিয়ে না করেই স্বামী-স্ত্রীর মতো সমাজে বসবাস করছে। একসময় আবার তাদের ছাড়াছাড়িও হয়, তখন খুঁজে নেয় নতুন সঙ্গী। আমি শুধু বললাম, আই সি। এরপর ওকে আরো একটি প্রশ্ন করি, তোমার বয়ফ্রেন্ড কি অন্য বাসায় থাকে? ওর সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। মার্কোরি এসে গেছি, লেবানিজ মসজিদটা পেরিয়ে বাঁয়ে বাঁক নিতেই মরিয়মের বাসা। সে ছুটছে তার শিশুপুত্র যিশুর কাছে। আমি ফিরে যাই দ্যু-পাতু, আমার প্রবাস নিবাসে। দ্য গল সেতু পেরুতে পেরুতে মনে হয়, ওপারে আফ্রিকা এপারে মুসলমান, সেতুটি কি সুন্দর মিলিয়ে দিয়েছে দুটি পারকে।

২০১২ সালের কথা। বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম কাজ করছেন জাতিসংঘ সদর দফতরে। এখানকার পুলিশ বিভাগের তিনি একজন পদস্থ কর্মকর্তা। এই বিভাগে পৃথিবীর নানান দেশের পুলিশ সদস্যরা কাজ করেন। বাহারুল আলম আমার খুব কাছের মানুষ, আমরা রোজই একসঙ্গে মধ্যাহ্নভোজনে যাই। প্রতিদিন নতুন নতুন রেস্টুরেন্ট খোঁজার ফলে ম্যানহাটনের প্রায় সব রেস্টুরেন্টেই আমাদের খাওয়া হয়ে গেছে। একদিন বাহার ভাই বলেন, আপনাকে একটা মজার গল্প বলি। আমার এক সহকর্মী আছে, ওর নাম জয়রাম কৃষ্ণমূর্তি। প্রতি শুক্রবারে জয় আমাকে বলে বাহার জুমায় যাবে না। আমি ওকে কিছুই বলি না। মনে মনে খুব রাগ হই। বেটা তুই হিন্দু মানুষ, আমি জুমায় যাই বা না যাই তাতে তোর কি? গত শুক্রবার যখন সে আমাকে আবার জিজ্ঞেস করল, বাহার জুমায় যাবে না? আমি তখন ওকে ধরলাম। তুমি জুমা সম্পর্কে কী জান? সে আমার এক প্রশ্নেই বুঝে ফেলেছে ঘটনা কী। সে তখন হো হো করে হাসতে শুরু করে। ওর হাসি দেখে আমার মেজাজ আরো খারাপ হয়। আমার কাঁধে হাত রেখে জয় বলে, বুঝেছি। আমার নাম জয়রাম কৃষ্ণমূর্তি বলে তুমি ভেবেছ আমি হিন্দু, তাই না? এমন পরিস্থিতিতে আমি আগেও পড়েছি। শোনো আমি তোমার মতোই একজন খাঁটি মুসলমান। ইন্দোনেশিয়ার সংস্কৃতিতে রামায়ণ-মহাভারতের ব্যাপক প্রভাব। আমাদের প্রায় সবার নামই রামায়ণ মহাভারত থেকে নেওয়া। এই নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। আমরা রামায়ণ-মহাভারতের প্রভাবকে কোনোভাবেই ধর্মীয় প্রভাব হিসেবে দেখি না। এটা সংস্কৃতি।

১৯২৭ সালের শরৎকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইন্দোনেশিয়ার জাভা ভ্রমণে যান। সেখানে তিনি যা দেখেন সেই অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে বেশ কিছু চিঠি লেখেন। একটি চিঠি তিনি লিখেছেন তার সাহিত্য সচিব কবি অমিয় চক্রবর্তীকে। সেই চিঠির কিছু অংশ এখানে উদ্ধৃত করছি। এতেই ইন্দোনেশিয়ার মুসলমানদের জীবনাচারের কিছু ধারণা পাওয়া যাবে। ‘কল্যাণীয়েষু অমিয়, এখানকার দেখাশোনা প্রায় শেষ হয়ে এলো। ভারতবর্ষের সঙ্গে জোড়াতাড়া-দেওয়া এদের লোকযাত্রা দেখে পদে পদে বিস্ময়বোধ হয়েছে। রামায়ণ মহাভারত এখানকার লোকের প্রাণের মধ্যে যে কি রকম প্রাণবান হয়ে রয়েছে সে কথা পূর্বেই লিখেছি। প্রাণবান বলেই এ জিনিসটা কোনো লিখিত সাহিত্যের সম্পূর্ণ পুনরাবৃত্তি নয়। এখানকার মানুষের বহুকালের ভাবনা ও কল্পনার ভেতর দিয়ে তার অনেক বদল হয়ে গেছে। তার প্রধান কারণ, মহাভারতকে এরা নিজেদের জীবনযাত্রার প্রয়োজনে প্রতিদিন ব্যবহার করেছে। সংসারের কর্তব্যনীতিকে এরা কোনো শাস্ত্রগত উপদেশের মধ্যে সঞ্চিত পায়নি, এই দুই মহাকাব্যের নানা চরিত্রের মধ্যে তারা যেন মূর্তিমান। ভালোমন্দ নানা শ্রেণির মানুষকে বিচার করবার মাপকাঠি এইসব চরিত্রে। কাল আমরা যে ছায়াভিনয় দেখতে গিয়েছিলেম তার গল্পাংশটাকে টাইপ করে আমাদের হাতে দিয়েছিল। সেটা পাঠিয়ে দিচ্ছি, পড়ে দেখো। মূল মহাভারতের সঙ্গে মিলিয়ে এটা বাংলায় তর্জমা করে নিয়ো। এ গল্পের বিশেষত্ব এই যে, এর মধ্যে দ্রৌপদী নেই। মূল মহাভারতের ক্লীব বৃহন্নলা এই গল্পে নারীরূপে ‘কেনবর্দি’ নাম গ্রহণ করেছে। কীচক একে দেখেই মুগ্ধ হয় ও ভীমের হাতে মারা পড়ে। এই কীচক জাভানি মহাভারতে মৎস্যপতির শত্রু, পা-বেরা একে বধ করে বিরাটের রাজার কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছিল।

আমি মঙ্কুনগরো-উপাধিধারী যে রাজার বাড়ির অলিন্দে বসে লিখছি চারদিকে তার ভিত্তি গাত্রে রামায়ণের চিত্র রেশমের কাপড়ের ওপর অতি সুন্দর করে অঙ্কিত। অথচ ধর্মে এঁরা মুসলমান। কিন্তু, হিন্দুশাস্ত্রের দেবদেবীদের বিবরণ এঁরা তন্ন তন্ন করে জানেন। ভারতবর্ষের প্রাচীন ভূমি বরণের গিরিনদীকে এঁরা নিজেদের দেশের মধ্যেই গ্রহণ করেছেন। বস্তুত, সেটাতে কোনো অপরাধ নেই। কেননা রামায়ণ-মহাভারতের নর-নারীরা ভাবমূর্তিতে এঁদের দেশেই বিচরণ করছেন। আমাদের দেশে তাঁদের এমন সর্বজনব্যাপী পরিচয় নেই। ক্রিয়াকর্মে উৎসবে আমোদে ঘরে ঘরে তাঁরা এমন করে বিরাজ করেন না।’

১৯২৭ থেকে ২০১৭ সাল। কেটে গেছে ৯০ বছর। এই ৯০ বছরে ওরা কিন্তু খুব একটা বদলায়নি। আজও জয়রাম কৃষ্ণমূর্তি একজন খাঁটি মুসলমান। বাংলা আমাদের ভাষা। অথচ বাঙালি মুসলমানরা যখন তাদের শিশুদের বাংলা নাম রাখতে চান তখন নানান সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। ভাষা এবং সংস্কৃতিকে ধর্মের সঙ্গে মেলাতে গেলে সমস্যা কেবল ঘনীভূত হবে, সমাধান আসবে না। বাংলা ভাষাভাষী হিন্দুরা ‘জল’ না বলে ‘পানি’ বললে যেন জাত গেল এমন ভাব করেন অথচ দেখুন উত্তর প্রদেশের হিন্দুরা জল কি জিনিস জানেই না, ওরা দিব্যি ‘পানি’ বলছে। শুধু কি তাই, মেহেরবান, শুকরিয়াসহ প্রচুর আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করছে।

যেকোনো ভূখণ্ডেরই ভাষা ও সংস্কৃতি ধীরে ধীরে বদলাতে থাকে। এতে শুদ্ধতা ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে চিৎকার করা যেতে পারে, কিন্তু একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এই অশুদ্ধতাই সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে যায়, তখন আর একে বাদ দেওয়া যায় না। আমাদের মনে রাখতে হবে, জোর করে কিছু আরোপ করা যেমন অন্যায় তেমনি শুদ্ধতার দোহাই দিয়ে কিছু বাদ দেওয়াও অন্যায়। সংস্কৃতির এই প্রবাহ নদীর স্রোতের মতো। নদীর পানিকে বাঁধতে গেলে বিপদের আশঙ্কাই বেশি।

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক, নিউইয়র্ক প্রবাসী

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist