মিনহাজ উদ্দীন শরীফ

  ৩১ আগস্ট, ২০১৯

রাজ ও দাদার গল্প

দা ভাইয়ের নিজ হাতে লাগিয়ে যাওয়া আতা গাছটা বেশ কয়েকটা ডালপালা ছেড়ে উঠোনের বেশির ভাগ স্থান নিজের দখলে রেখেছে। বাড়ির ছোট-বড় সবাই গাছটার খুব যত্ন করে। দাদা ভাইয়ের সর্বশেষ স্মৃতি হিসেবে তাদের মধ্যে এই গাছটাই একমাত্র সম্বল হয়ে আছে। গাছটার জন্য উঠোনে ধান, খড় কিছুই শুকানো যায় না; কারণ গাছের ডালপালা সূর্যের আলো উঠোনে আসতে বাধা দেয়। তার পরও গাছটা কেউ কাটে না।

আষাঢ়ের সকাল মেঘে ছেয়ে গেছে নীল আকাশটা। বাড়ির ছোট ছেলে রাজ রেডি হচ্ছে বাবার সঙ্গে আজমিরিগঞ্জ যাবে। বাবা দুহাতে বারণ করছে নিবে না। রাজ বাবাকে বলল, বাবা আমাকে নিবায় না ক্যান? বাবা বলল, ওই দূর আকাশে চেয়ে দেখ মেঘ উড়াউড়ির করছে। যেকোনো সময় বৃষ্টি হবে, তুই তো জানিস-ই নৌকা দিয়ে আজমিরিগঞ্জ যেতে হবে। তখন যদি বৃষ্টি বা ঢেউ বহে এবং কোনো দুর্ঘটনা ঘটে; তাহলে কী হবে বুঝতেই তো পারিছিস রাজ? সে গম্ভীর হয়ে কী জানি ভাবছে! বাবা বলল, এরপরও কি যেতে চাস? সে বলল, বাবা তাহলে তো তোমারও না যাওয়া ভালো! বাবা একটু হেসে বলে, বোকা আমি বড় মানুষ আমার জন্য চিন্তা করতে হবে না। আজ যে আমার যাওয়াটা খুব জরুরি।

তোর দাদা ভাইয়ের আগামীকাল মৃত্যুবার্ষিকী কিছু কেনাকাটা করা দরকার, সেটার জন্যই তো যাওয়া। রাজ যাবে না; বাবাকে বলে দিল যাতে তার জন্য গেঞ্জি ও লিচু নিয়ে আসে। বাবা হ্যাঁ বলে চলে গেল। বাবা বাড়ি থেকে বাহির হওয়ার আধাঘণ্টা পর চতুর্দিক ঝাপসা করে শিলাবৃষ্টি নামল। রাজ তখন জানালার কাছে বসে আতা গাছটা দেখছে। ধীরে ধীরে বৃষ্টি বাড়তে লাগল। বৃষ্টির জন্য কিছুই দেখা যায় না দুচোখে। রাজের কানে কিসের আওয়াজ ভেসে আসছিল, সেটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না বৃষ্টির শব্দে। একটু মনোযোগী হয়ে আবারও আওয়াজটা শুনল ভালো করে। কে জানি বলছে আমাকে কেন এভাবে কষ্ট দিচ্ছেন প্রভু আমি তো কোনো অপরাধ করিনি, আমি যে এমন আঘাত সহ্য করতে পারছি না? রাজ আঁতকে উঠল কাউকে না দেখতে পেয়ে। আতাগাছের নিচে চেয়ে দেখে একটা পাতা ঝরে আছে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে। পাতাটা চিৎকার করে বলছে রাজ আমাকে তুমি রক্ষা করো; আমি যে সইতেই পারছি না শিলার আঘাত। রাজ ভাবছে দাদাভাই বলছে, তাই রাজ বাহির হয়ে পাতাটা যেই না ছুঁতে গেল। ঠিক তখনই ঢলের পানি স্রোতের বেগে ভাসিয়ে নিয়ে গেল রাজের নাগালের বাইরে।

সে গাছটা ধারে দাঁড়িয়ে দাদাভাই বলে ডাকছে। তখন আবারও ঝরাপাতার আর্তনাদ শুনতে পেল, কিন্তু সে দেখতে পাছে না পাতাটা কোথায়। পাতাটা খুঁজছে দাদাভাই, দাদাভাই বলে। রাজ বাড়ির সামনে ডোবার জলে খুঁজতে গেল, সেখানেও পাতাটা দেখতে পেল না। রাজ ডাঙায় উঠে বাড়ির পথ ধরে হাঁটছে তখন, পিছু থেকে আবারও ঝরাপাতার আর্তনাদ শুনতে পায়। কিন্তু পাতাটা সে দেখতে পায় না।

রাজ চিৎকার করে বলছে, দাদাভাই তুমি আমাকে দেখা দাও? আমি যে তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না। হঠাৎ দমকা বাতাস এসে রাজকে ধাক্কা দিয়ে বাঁশবাগানে ফেলে দিল। ওইদিকে তাকে ঘরে দেখতে না পেয়ে মা হইহুল্লোড় শুরু করে দিয়েছেন বাড়িতে। তাকে খুঁজতে মা; কাকা; ভাইয়েরা ও গ্রামের কয়েকজন মানুষ বাহির হলো। আরিফ ভাই রাজকে ফজলু কাকার বাঁশের কেল্লায় পেল। রাজকে আরিফ ভাই বলছে, কি রে রাজ বাড়িতে সবাই তোকে খুঁজে তো হয়রান? এখানে তুই ঘাপটি মেরে বসে আছিস, ব্যাপার কী? রাজের মুখ থেকে কোনো উত্তর পেল না। আরিফ ভাই গায়ে ধাক্কা দিয়ে দেখে তার দেহ কাঁপছে ও ভীষণ জ্বর; আরিফ ভাই কোলে করে বাড়িতে এনে সবাইকে খবর দিল রাজকে পাওয়া গেছে।

মা এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করছে, কিরে এই শিলাবৃষ্টি কি তোর চোখে লাগে না? তুই কোথায় গিয়েছিলি আমাকে না বলে? সে মাকে জড়িয়ে কেঁদে কেঁদে বলছে, মাগো দাদাভাই খুব কষ্টে আছে। দাদাভাই আমাকে বলছিল, শিলা থেকে রক্ষা করতে। কিন্তু আমি শেষ রক্ষা করতে পারিনি দাদাভাইকে। বৃষ্টির পানি ভাসিয়ে নিয়ে গেছে আমার চোখের সামনে কোন সে অজানায়। বিশ্বাস করো মা, আমি সব জায়গা খুঁজেছি। কিন্তু কোথাও পাইনি। রাজের মুখে এসব আবোলতাবোল কথা শুনে গ্রামের মানুষ বলছে, কিরে রাজ তোর কী হয়েছে? এমন পাগলের প্রলাপ করছিস কেন? রাজ বলল, আমি পাগলের প্রলাপ করছি না; বিশ্বাস না হলে আতাগাছটা দেখে আসো; তাহলেই বুঝতে পারবে। আতাগাছটা দেখতে এসে সবাই দেখে শিশুদের মতো গাছের নিচে কে কান্না করছে! মা, কাকা, ভাইয়েরা ও গ্রামের মানুষ কে কান্না করছে, সেটা খুঁজতে খুঁজতে প্রায় আধমরা।

রাজ এসে সব কথা খুলে বলল। আতাগাছের পাতা যে আর্তনাদ করছে। অবশেষে রাজ পাতাটা দেখতে পেল এবং সবাইকে দেখাল। মা জিজ্ঞাসা করল ঝরাপাতাকে, তোমার কিসের কষ্ট আর কেন এভাবে কান্না করছো? ঝরাপাতা বলল, আমার কী অপরাধ যে আমাকে অল্প বয়সে এভাবে নিজের অঙ্গ থেকে ছিটকে পড়তে হলো? গাছেরও প্রাণ আছে এবং তারাও মানুষের মতো দুঃখ-কষ্ট অনুভব করতে পারে। শিলা তাকে অঙ্গ থেকে ঝরানোর কারণে আর্তনাদ করছে, এটা সবাই বুঝতে পারল। কিন্তু রাজ যে ওর দাদাভাইয়ের নামে কিসব বলল? সেটা গ্রামের মানুষ জানতে চায়। বাড়ির সবাই জানে কিন্তু গ্রামের মানুষ জানে না, তাই মা বলল এই আতাগাছটা আমার শ্বশুর মানে রাজের দাদাভাই লাগিয়ে গেছিল। রাজ ছোট থেকেই জেনে আসছে এই গাছের মধ্যে ওর দাদাভাই লুকিয়ে আছে। এজন্যই রাজের এমনটা মনে হয়েছে।

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
দাদাভাই,গল্প,আতাগাছ
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close