বলরাম দাশ অনুপম, কক্সবাজার

  ২১ জুন, ২০২২

কক্সবাজারে পাহাড়ধস আতঙ্ক

ছবি : প্রতিদিনের সংবাদ

কক্সবাজার জেলা শহর ও বিভিন্ন উপজেলায় পাহাড়ে বসতঘর তৈরি করে বসবাস করছে প্রায় তিন লাখ মানুষ। বন উজাড় ও পাহাড় কেটে বসতঘর তৈরিসহ নানা কারণে পাহাড় ধসে গত ১০ বছরে শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও বর্ষার শুরুতে দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীতে পাহাড়ধসে রবিউল হোসেন নামে পাঁচ বছর বয়সী এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে।

রোববার (১৯ জুন) রাত ৯টার দিকে মহেশখালীর কালারমারছড়ার অফিসপাড়ার পাহাড়ি এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। রবিউল ওই এলাকার নজির হোসেনের ছেলে। বর্ষা শুরু হওয়ায় সাথে সাথেই পাহাড় ধসের ঘটনায় সর্বত্র পাহাড় ধস আতঙ্ক বিরাজ করছে।

সূত্রমতে, পাহাড় কেটে বসতবাড়ি নির্মাণ ও পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের বিরুদ্ধে সারা বছর কোনো উদ্যোগ না নিলেও প্রতিবছর বর্ষা শুরু হলেই প্রশাসনের পক্ষ থেকে চলে জুরেসুরে মাইকিং। যেন পাহাড়ে বসবাসকারীরা নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। এই মাইকিংয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার কারণেই বর্ষা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘটে পাহাড় ধসে মৃত্যুর ঘটনা। পাশাপাশি প্রশাসন কোনোরকম দায় এড়ানোর জন্য মাইকিং কিংবা জরুরি মিটিংয়ের মধ্যে নিজেদের দায়-দায়িত্ব শেষ করে।

স্থানীয়রা জানায়, গত কয়েকদিনের ভারীবর্ষণ ও ঝড়ো বাতাসে জেলা শহরসহ বিভিন্ন উপজেলায় পাহাড়ধসের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। যেকোনো মুহূর্তে ঘটতে পারে প্রাণহানির ঘটনা। এ আশঙ্কায় পাহাড়ের পাদদেশ বা পাহাড়ের চূড়ায় ঝুঁকিপূর্ণ আবাসগড়া লোকজনদের নিরাপদ আশ্রয়স্থলে সরে যেতে নির্দেশ দিয়ে মাইকিং হয়েছে। স্বেচ্ছায় না সরলে অভিযানের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারিও দেয়া হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কক্সবাজার শহরের মোহাজের পাড়া, বৈদ্যঘোনা, লাইটহাউজ পাড়া, ঘোনারপাড়া, পাহাড়তলী, বর্মাইয়া পাড়া, এবিসি ঘোনা, টেকনাইফ্ফা পাহাড়, সিটি কলেজ এলাকা, নতুন জেলখানা, ডিককুল বিজিবি ক্যাম্প, মহুরিপাড়া, কলাতলীর চন্দ্রিমা, আর্দশগ্রাম, প্রশাসনের কর্মচারিদের ৫১ একর, কক্সবাজার সদর উপজেলার ঈদগাঁও, খুরুশকুল, পিএমখালী, ভারুয়াখালী, রামুর খুনিয়াপালং, দক্ষিণ মিঠাছড়ি, জোয়ারিয়ানালা, ঈদগড়, গর্জনিয়া, উখিয়ার রাজাপালং, হলদিয়াপালং, পালংখালী, টেকনাফের হোয়াইক্যং, বাহারছড়া, হ্নীলা, টেকনাফ সদর ইউনিয়ন, চকরিয়ার খুটাখালী, বরইতলী, ডুলাহাজারা, হারবাং, পেকুয়ার বারবাকিয়া, টৈটং, পহঁরচাদা, মহেশখালীর কালারমারছরা, হোয়ানক, ছোট মহেশখালী, শামলাপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় পাহাড় কেটে বসবাস করছে সহস্রাধিক পরিবার।

এসব এলাকায় প্রায় পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন করা হয়েছে। বর্ষা শুরু হলে উল্লেখিত এলাকায় টানা বৃষ্টিতে ক্ষতবিক্ষত পাহাড়ের মাটি নরম হয়ে ধসে পড়ে। এতে ঘটে অনাকাংখিত মৃত্যুর ঘটনা।

এ বিষয়ে কক্সবাজার সদর উপজেলার ঝিলংজা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান টিপু সুলতান বলেন, প্রতি বর্ষায় ঝিলংজা ইউপির বিসিক নগরী ও মুহুরী পাড়া এলাকায় পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। গত তিনদিন ধরে টানা বৃষ্টিপাত হচ্ছে কক্সবাজারে। এমন বৃষ্টিতে পাহাড় ধসের ঝুঁকি থাকায় পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারীদের নিরাপদে আশ্রয় নিতে বলা হচ্ছে।

মহেশখালী উপজেলার কালারমারছড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তারেক বিন ওসমান শরীফ জানান, পাহাড় কেটে বসতি নির্মাণ কঠোরহস্তে দমন করা না গেলে প্রতি বছরই পাহাড় ধসের ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল লেগে থাকবে। যে কারণে বর্ষার শুরুতেই পাহাড় ধসের ঘটনায় আমার এলাকায় রবিউল নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। বিষয়টি শোনার পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করি এবং নিহতের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দিই। এছাড়া, পাহাড়ি এলাকায় বসবাসকারীদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যেতে মাইকিং করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের উপ পরিচালক শেখ নাজমুল হক বলেন, জেলার মোট ভূমির ৩৮ শতাংশ অঞ্চল। সব পাহাড়েই কোনো না কোনোভাবে বেদখল রয়েছে। এসব পাহাড়ে ঝুঁকি নিয়ে প্রায় দেড় দুই লাখের অধিক লোকজন বসবাস করে।

তিনি আরো বলেন, পাহাড় ধসের জন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের চেয়ে ভয়ঙ্কর পাহাড় কাটা। বৃষ্টির সময় পাহাড়ের লোকজনরা পাহাড় থেকে মাটি সরাতে ঢালু করে দেয়। ফলে পাহাড় ধস হয়। ইতঃপূর্বে পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে অভিযান হয়েছে, যা এখনো চলমান রয়েছে।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মো. আবু সুফিয়ান বলেন, কক্সবাজার পৌরসভার অভ্যন্তরে ৬টি ওয়ার্ডে সবচেয়ে বেশি মানুষ ঝুঁকিতে বাস করছে। তাদের সরিয়ে আনাটা একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। তারপরও ঝুঁকি এড়াতে কর্মপরিকল্পনা নিয়েছে জেলা প্রশাসন।

এডিএম আরো বলেন, চলমান সময়ে কি পরিমাণ মানুষ ঝুঁকিতে বাস করছে তার সঠিক কোনো তালিকা তৈরি করা যায়নি। তবে, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা পর্যবেক্ষণ করে ঝুঁকিতে থাকা পরিবারের তালিকা তৈরি করতে দায়িত্ব পালন করছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) মুক্তি কক্সবাজার, পালস্, ইপসা, গ্রীণকক্স, নোঙ্গর, এক্সপাউরুল, নেকম, হেলফ, কোস্ট ট্রাস এবং ওয়াল্ডভিশন। এসব সংস্থাগুলো দুর্যোগকালীণ সময়েও প্রশাসনকে সহযোগিতা করবে। অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু এড়াতে কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে জেলা প্রশাসন।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ বলেন, ঝুঁকিপূর্ণভাবে পাহাড়ে বসবাসকারীদের সরাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে পাহাড়ধস কমাতে হলে জনগণকে সচেতন হতে হবে। পাহাড় কাটা না কমালে পাহাড় ধস হবেই। সে কারণে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য পাহাড় কাটা বন্ধ করতে জনগণকে অনুরোধ করেন তিনি। পাশাপাশি পাহাড়ে বেশি করে গাছ লাগানোর পরামর্শ দেন।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
কক্সবাজার,পাহাড়ধস,আতঙ্ক,অতিবৃষ্টি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close