হাসান ইমন

  ০১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

দেশে খাদ্য নিরাপত্তা তলানিতে

স্টিকার-লিফলেট প্রকাশ ছাড়া কিছুই করেনি কর্তৃপক্ষ

শুক্রবার জাতীয় নিরাপদ খাদ্য দিবস

বাজার থেকে বড় কাতল মাছ নিয়ে এসেছে মোসলেম উদ্দিন। মাছ দেখে কাটতে গেল স্ত্রী রোকসানা বেগম। কাটার পর ধোয়ার জন্য পাত্রে গিয়ে দেখে মাছ কমলা রং ধারণ করেছে। যতই ধোয়ার চেষ্টা করেন, ততই পিচ্ছিল হয়ে যায়। মাছ পরিষ্কার করে গরম তেলে ভাজার জন্য ফ্রাইপ্যানে ছাড়তেই মাছ খুলে খুলে ফ্রাইপ্যানে লেগে যায়। অতিরিক্ত রং ও রাসায়নিক দিয়ে রাখা এই মাছ খাওয়া দূরে থাক, রান্নার উপযোগী আর করতে পারেননি রোকসানা বেগম। তার মতো অভিজ্ঞতা নগরবাসীর অনেকেরই। কেবল মাছ নয়, বিভিন্ন ধরনের খাদ্যদ্রব্য নিয়েই এমন বিড়ম্বনায় পড়তে হয় তাদের। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, উৎপাদনের ক্ষেত্রে মাটি ও পানি ভালো না হওয়া এবং বিভিন্ন ধরনের ‘বিষ’ হরমোনের সংস্পর্শে আসার কারণে অনিরাপদ খাদ্য গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছে মানুষ। আর এসব বিষয় দেখভালের জন্য গঠিত বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ এখনো যথেষ্ট সক্রিয় নয়। কেবল মোবাইল কোর্ট ও আর কিছু তথাকথিত প্রচার-প্রচারণার মধ্যেই আটকে আছে তারা।

বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের বর্তমান অবস্থান দোদুল্যমান। সাংগঠনিক অর্গানোগ্রাম তৈরি, বিশেষত কর্তৃপক্ষের অধীনে বিভিন্ন ধরনের জনবল সৃষ্টি ও তাদের কাজে লাগানোর পরিকল্পা তৈরি করতে পারেনি সংস্থাটি। অন্যদিকে, দায়িত্ব প্রদানকৃত নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শকরা সরাসরি রিপোর্ট-রিটার্ন না করায় খাদ্য ভেজালের তথ্য-উপাত্ত ও পরিসংখ্যান বিষয়ে কর্তৃপক্ষ রয়েছে অন্ধকারে। নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শকদের ওপর কখনো বিএফএসএ, কখনো ডিজিএইচএস/আইপিএইচ-এর ফরমান জারিতে অহেতুক দ্বৈত শাসনের আমলাতান্ত্রিক জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্ট্রের বেতনভুক জনবলের একটি অংশ (১৪৩ জন স্যানিটারি ইন্সপেক্টর) কাজ করার অনুমতি পেয়েও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দ্বৈত নির্দেশনাজনিত জটিলতায় পড়েছেন, অন্য অংশ (৪১৮ জন স্যানিটারি ইন্সপেক্টর) আইনসম্মতভাবে কাজ করার অনুমতি না থাকায় হাত গুটিয়ে বসে আসেন এবং কাজের উপযোগী সনদপ্রাপ্ত বড় একটি সংখ্যা (প্রায় ১৬০০ স্যানিটারি ইন্সপেক্টরশিপ সনদপ্রাপ্ত) কাজে লাগবেন কি না এই আশঙ্কার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন! স্যানিটারি ইন্সপেক্টরশিপ নামের দক্ষ সরকারি জনবল নিয়ে চরম অব্যবস্থাপনার নজির সৃষ্টি হয়েছে!

সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সবার জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে ২০১৩ সালে নিরাপদ খাদ্য আইন তৈরি করে সরকার। ২০১৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর এই আইনের আওতায় ২ ফেব্রুয়ারি গঠন করা হয় বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। তারা গত কয়েক বছরে নিরাপদ খাদ্য আইন নিয়ে জনসচেতনতা তৈরি করার জন্য পোস্টার, স্টিকার ও একটি প্ল্যানপ্লেট তৈরি করেছে। এছাড়া জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের কর্মশালাও আয়োজন করেছে। কিন্তু আজ বিশ্ব খাদ্য দিবসে এসেও প্রশ্ন রয়েই গেছে, এসব উদ্যোগে খাদ্য কতটা নিরাপদ হয়েছে।

জীবনযাত্রার প্রায় সব ক্ষেত্রেই রয়েছে ভেজাল আর নকলের সীমাহীন দৌরাত্ম্য। অতিমাত্রায় কীটনাশক, কেমিক্যাল আর রঙের আধিক্যতায় বেশির ভাগ খাদ্যপণ্যই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কেমিক্যাল আর পেঁয়াজের রস মিশিয়ে তৈরি করা হয় খাঁটি সরিষার তেল। এছাড়া শাক-সবজিতে রাসায়নিক কীটনাশক, জিলাপি-চানাচুরে মবিল। ব্রেড, বিস্কুট, সেমাই, নুডলসসহ সবরকম মিষ্টিতে টেক্সটাইল-লেদারের রং, মুড়িতে ইউরিয়া-হাইড্রোজেনের অবাধ ব্যবহার চলছে। চাল, আটা, লবণ, চিনি, ভোজ্যতেল, আলু থেকে শুরু করে রুটি, কেক, মিষ্টি, বিস্কুট কিছুই ভেজালের ছোবল থেকে বাদ যাচ্ছে না। জীবন ধারণের জন্য সবচেয়ে জরুরি ‘পানি’ পর্যন্ত নিরাপদ থাকছে না।

কলা, আম, পেঁপে, পেয়ারা, আনারস থেকে শুরু করে আপেল, আঙুর, নাশপাতিসহ দেশি-বিদেশি প্রায় সব ফলেই মেশানো হচ্ছে বিষাক্ত কেমিক্যাল। অপরিপক্ব ফল পাকাতে ক্যালসিয়াম কার্বাইড ও তা উজ্জ্বল বর্ণে রূপান্তরের জন্য অধিক ক্ষার জাতীয় টেক্সটাইল রং ব্যবহার হচ্ছে অবাধে। জানা গেছে, ফল গাছে থাকা পর্যায় থেকে বাজারে বিক্রির মুহূর্ত পর্যন্ত একেকটি ফলে ছয় দফা কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। মূলত গ্যাস জাতীয় ইথাইলিন ও হরমোন জাতীয় ইথরিল অতিমাত্রায় স্প্রে করে এবং ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহার করার কারণেই ফলগুলো রীতিমতো বিষে পরিণত হয়।

এই বিষয়ে কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ২০১৩ সালের ১০ অক্টোবর জাতীয় সংসদ নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করতে নিরাপদ খাদ্য আইন অনুমোদন করে। এরপর ২০১৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ গঠিত হলেও এখন পর্যন্ত জনবল দেওয়া হয়নি। সরকারের বিভিন্ন দফতর থেকে ‘ধারদেনা’ করে জোড়াতালি দিয়ে চালাচ্ছে তারা। এসবের ফলে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ এগোতে পারেনি। খাদ্য নিরাপদ নিশ্চিত করতে শুধু খাদ্য কর্তৃপক্ষ নয়, মানুষকে আগে সচেতন হতে হবে বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ।

গত ২৭ জানুয়ারি রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে বাংলাদেশ সোসাইটি ফর সেইফ ফুড (বিএসএসএফ) আয়োজিত এক সেমিনারে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ বলেন, আমরা খাদ্যে নিরাপত্তা অর্জন করেছি সত্যি কিন্তু এখনো জনগণের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে পারিনি।

অনুষ্ঠানে তিনি আরো বলেন, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী খাদ্যে ভেজাল দিচ্ছে। পাশাপাশি নানা ক্ষতিকর কেমিক্যাল ব্যবহারের ফলে আমাদের মাটি-পানি ও বাতাস দূষিত হওয়ায় খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। খাদ্য ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত জনশক্তি ও মন্ত্রণালয়সমূহের মধ্যে সমন্বয়হীনতা নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনায় অনেক বড় এক চ্যালেঞ্জ।

খাদ্যের নিরাপত্তার বিষয়টিকে অনেক বড় ইস্যু উল্লেখ করে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সচিব খালেদ হোসেন বলেন, আমরা অনেক কাজ শুরু করেছি। এগুলো সংক্ষেপে জানানো সম্ভব না। নিরাপদ খাদ্যের জন্য কী করছেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি এখন বেশি ব্যস্ত। বিস্তারিত জানতে হলে অন্যদিন আসতে হবে। আজ সময় দিতে পারব না। এদিকে, ‘নিরাপদ খাদ্যে ভরবো দেশ, সবাই মিলে গড়বো সোনার বাংলাদেশ’ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে শুক্রবার জাতীয় নিরাপদ খাদ্য দিবস পালিত হবে। দিবসটি উপলক্ষে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ র‌্যালি ও আলোচনা সভার আয়োজন করেছে।

পিডিএসও/মুস্তাফিজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
খাদ্য নিরাপত্তা,স্টিকার-লিফলেট
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist