ফারজানা সিদ্দিকা

  ২৯ এপ্রিল, ২০১৭

নারীর উপন্যাসে ইতিহাসের সত্য ও ছায়া

বাংলা উপন্যাসের যাত্রা শুরু হয়েছিল একজন নারীর হাত ধরে। সেই নারী কিন্তু বাঙালি নন; ইংরেজ। উপন্যাসের শিল্প বিষয়ে যারা গবেষণা করেন, তাদের মতে, হানা ক্যাথরিন ম্যালেন্সের সেই ফুলমণি ও করুণার বিবরণ আদৌ উপন্যাস নয়; উপন্যাসের বীজযুক্ত কোনো কাহিনী গদ্য মাত্র। এই বিতর্ককে একপাশে সরিয়ে রেখে কেবল এই সত্যটুকু উপলব্ধি করা যায় যে, একজন ইংরেজ নারী নিজের অভিজ্ঞতায় দেখা ভারতীয় নারীর জীবনচিত্রের বাস্তব বিবরণ প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন তার রচনায়। তারপর উনিশ শতকে আধুনিক শিক্ষা গ্রহণের অধিকার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি নারী বিরুদ্ধ সময় ও সমাজে দ্রুততম সময়ের মধ্যে কবিতা-গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ-নাটকে নিজের উপলব্ধি ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে যখন বাঙালি নারী কলম হাতে নিয়েছে, তখনো কিন্তু সেই নারী প্রথমেই তার অন্তঃপুরের জীবনকেই লেখার প্রধান বিষয় হিসেবে নির্বাচন করেছেন। কখনো কেবল নিজের কিংবা তার দেখা অন্য নারীর জীবনচিত্র, কখনো সমাজ ও প্রচলিত সংস্কার সম্পর্কে ঘনিয়ে ওঠা কোনো প্রশ্ন, কখনো প্রচলিত সামাজিক রীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ইত্যাদি বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে নারী ঔপন্যাসিকরা অন্তঃপুরের জীবন থেকে ধীরে ধীরে পা ফেলেছেন বাইরের জীবন বাস্তবতায়। সময়ের পালাবদলে ভারতবর্ষের বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক আন্দোলনের অভিঘাত পড়েছে তাদের রচনায়। নারী তার নিজস্ব ধরন দিয়েই ঘরে-বাইরের জীবনাভিজ্ঞতা বিচার-বিশ্লেষণ করে বাংলা উপন্যাস শিল্পে এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছেন।

ইতিহাস স্বভাবতই তার নিজস্ব গতিপথে চলে। রাষ্ট্রের কোনো একটি বিশেষ ঘটনাকে বহু কোণ থেকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা সম্ভব। একজন ঐতিহাসিক ইতিহাসের সন-তারিখ ধরে ধরে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের পথে এগিয়ে যান। কিন্তু শিল্পী-সাহিত্যিক ওই সন-তারিখের পথে হেঁটে হেঁটে ঢুকে পড়েন ব্যক্তিমানুষের চৈতন্যে, পরিবারে, সমাজের অলিগলিতে। রাষ্ট্রের ইতিহাসের দলিলের নিচে চাপা-পড়া ব্যক্তিমানুষের অনুভূতি, আনন্দ, হর্ষ, বিষাদ, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের অনুরণন আবিষ্কার করা শিল্পী-সাহিত্যিকের লক্ষ্য। ঐতিহাসিক আবেগবর্জিত নিরেট-বাস্তব ঘটনাকে ইতিহাসে ধারণ করেন। শিল্পী-সাহিত্যিক সেই নিরেট-বাস্তবতায় অনুভূতির রং মেশান। ঐতিহাসিকের মতো সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির করার দায় নেই তাদের। সেরকম দায় তাদের কাছে কেউ প্রত্যাশাও করে না। এভাবেই ইতিহাসের পুনর্নির্মাণ ঘটে শিল্পী-সাহিত্যিকের হাতে।

কিন্তু সবচেয়ে জরুরি প্রশ্নটি হলো, কাকে বলে ইতিহাস? কার লেখা ইতিহাস? ইতিহাসেরও সত্য-মিথ্যা-নিরপেক্ষ ভাগ থাকে। শাসক বদলের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর বহু রাষ্ট্রে বদলে যায় ইতিহাসের পাঠ্যসূচি। ইতিহাস কার হাতে রচিত হয়েছে, সেটাও এক জটিল বিষয় হয়ে ওঠে। বিজয়ী আর বিজিতের রেখা ইতিহাসের গন্তব্য কোনোদিনই এক হওয়ার নয়। প্রাচীন বাংলার ধন-সম্পদ-ঐশ্বর্যের বর্ণনায় মুখে মুখে প্রচলিত ইতিহাসে ‘গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু আর পুকুর ভরা মাছের’ আহামরি চিত্র মেলে। অথচ ৩৩ নাম্বার চর্যাপদে কবি ঢেণ্ঢনপা জানান, হাঁড়িতে ভাত নেই, কিন্তু অতিথির নেই বিরাম। কিংবা মধ্যযুগের অন্নদামঙ্গলের কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর ঈশ্বরী পাটুনির মুখ দিয়ে দেবীর কাছে সন্তানের সারাজীবনের দুধ-ভাতের নিশ্চয়তা চান। বৈপরীত্যে ভরা দুই চিত্র স্বভাবতই ইতিহাসের নিরপেক্ষতা নিয়ে সন্দিহান করে তোলে।

উনিশ শতকে ইতিহাসকে বিজ্ঞানরূপে দেখার দাবি তুলেছিলেন প্রত্যক্ষবাদীরা। তারা বললেন, ‘প্রথম কাজ তথ্য নির্ণয় করো, তারপর তা থেকে নিজের সিদ্ধান্তে এসো।’ কিন্তু প্রথম কাজটি ততটা সহজ হয়ে থাকেনি। তথ্য নির্ণয়ের মাপকাঠি তৈরি করা জরুরি হয়ে পড়ে। কেননা, অতীতের সব তথ্যই ঐতিহাসিক তথ্য নয়। ইতিহাসবিদ বা ঐতিহাসিকরা সব তথ্যকে সমানভাবে বিবেচনাও করেন না। ঐতিহাসিক মনে করেন, ‘মতামত প্রভাবিত করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় বিভিন্ন তথ্যের নির্বাচন ও বিন্যাস। বলা হতো, তথ্য নিজেই কথা বলে। এটা অবশ্যই অসত্য। তথ্যরা একমাত্র তখনই কথা বলে, যখন ঐতিহাসিক তাদের ডাক দেন। তিনিই ঠিক করেন, কোনো তথ্যকে তিনি বলতে দেবেন, কোন ক্রমে বা কোন প্রসঙ্গে।’ মূলত অন্যভাবে বলা যায়, মানবজীবনের প্রবহমান অতীত আর ইতিহাসে আশ্রিত অতীত আসলে এক নয়, এমনকি সমার্থকও নয়। আর প্রতিটি অতীতের মধ্যেই বর্তমানকে খুঁজে পাওয়া যায় কিংবা খুঁজে নিতে হয়। ইতিহাসবিদ ইএইচ কার মনে করেন, ‘সমাজবদ্ধ মানুষের অতীতাশ্রয়ী ও তথ্যনিষ্ঠ জীবনব্যাখ্যাই ইতিহাস। তার মধ্যে একা মানুষ ও সমাজবদ্ধ মানুষের বৈপরীত্য লক্ষণীয়। মানুষ যখন সত্যিকারের একা, ইতিহাস তাকে ছুঁতে পারে না। একক মানুষের অস্তিত্ব আছে; ইতিহাস নেই। মানুষ সামাজিক হলে পরেই ইতিহাস হয়।

১৯৩০ সালে প্রকাশিত ‘নির্বাচিত নিবন্ধাবলী’ গ্রন্থে জে বি ব্যুরিও ইতিহাসের সংজ্ঞার্থ প্রসঙ্গে এমনই মন্তব্য করেছেন। তার মতে, ইতিহাস হলো ভাঙা টুকরো দিয়ে জোড়া এক বিশাল ধাঁধা, যার অনেক টুকরো হারিয়ে গেছে। এই হারিয়ে যাওয়াটা কোনো দুর্ঘটনাক্রমে হয়নি। আসলে কিছু জিনিসকে হারিয়ে যেতে দিতে বাধ্য হতে হয়। পূর্বে উল্লিখিত তথ্যের নির্বাচন ও বিন্যাসের সঙ্গে এই হারিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গটি সম্পর্কিত। কিছু তথ্য ইতিহাসবিদ ইচ্ছাকৃতভাবেই হারিয়ে ফেলেন নির্বাচনের তাগিদে। এ কারণেই বোধ করি, জি ব্যারাক্লফে তার ‘পরিবর্তমান জগতে ইতিহাস’ (১৯৫৫) গ্রন্থে মধ্যযুগের ইতিহাস বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে মনে করেন, যে ইতিহাস আমরা পড়ি, তা তথ্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত হলেও সঠিকভাবে বলতে গেলে তথ্যভিত্তিক নয়, বরং এক সারি স্বীকৃত অভিমত। এই অভিমত গড়ে ওঠে মূলত ইতিহাসবিদের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর ভিত্তি করে। ‘ইতিহাসের দর্শন’- এই শব্দগুচ্ছটি আবিষ্কার করেছিলেন ভলত্যার। আর তারপর থেকে এটির ব্যবহার হয়েছে নানা অর্থে। অর্থাৎ, ইতিহাসবিদের ব্যক্তিগত দর্শন ইতিহাস রচনায় গভীর প্রভাব বিস্তার করে। ঐতিহাসিক তথ্য যাচাই-বাছাই থেকে শুরু করে সর্বত্রই তার দর্শনজাত রুচি, বিশ্বাস, দৃষ্টিভঙ্গি, নিরপেক্ষতা, চেতনা ইত্যাদির প্রকাশ ঘটে। ইতিহাসাশ্রিত শিল্পী-সাহিত্যকদের ক্ষেত্রেও একই মন্তব্য প্রযোজ্য। একজন সৃষ্টিশীল ব্যক্তি ইতিহাসকে তার শিল্প-সাহিত্যে কিভাবে ব্যবহার করবেন, তা নির্ভর করে প্রধানত তার ব্যক্তিগত দর্শন বা দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। সৃষ্টিশীল ব্যক্তির সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনৈতিক মতাদর্শ, সর্বোপরি শ্রেণিগত চেতনা তার জীবনদর্শন নির্ধারণ করে দেয়। ইতিহাসের কোন সত্যকে তিনি তার শিল্প-সাহিত্যে গ্রহণ করবেন, কোনটি বর্জন করবেন, তা বিবেচিত হয় এই জীবনদর্শন দ্বারাই।

পশিচমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত দেশভাগের প্রেক্ষাপটে শান্তা সেনের আত্মজৈবনিক রচনা ‘পিতামহী আর সুনন্দা শিকদারের দয়াময়ীর কথা’ অসংখ্য পাঠকের চৈতন্যে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছিল। ভারতবর্ষের ইতিহাসে দেশভাগের প্রতিক্রিয়া আজও কতটা ভয়াবহ যন্ত্রণার, তা ফ্রেমবন্দী হয়ে আছে ওই ছোট্ট রচনা দুটিতে। এই দুই লেখকই দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন। দেশভাগের ইতিহাসের রূপ-রূপান্তরের পুনর্নির্মাণে ব্যক্তিগত দীর্ঘশ্বাস আর নিজস্ব পর্যবেক্ষণ-ব্যাখ্যা একাকার হয়ে আছে তাদের লেখায়। উদ্বাস্তু হতে বাধ্য হওয়া শিল্পী-সাহিত্যিকদের জীবনে ‘দেশভাগ’ গভীরতম অনুভূতির এক গোপন অধ্যায়। ১৯৪৭-এ বাঙালির সত্তাকে জেনেবুঝেই দুই ভাগ করা হয়েছিল। তারপর ১৯৫২তে আরেকবার আঘাত আসে বাঙালির ভাষার ওপর। বাঙালিকে নিশ্চিহ্ন করার চূড়ান্ত আঘাতটি আসে ১৯৭১-এ। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত বাঙালির জীবনে অভিঘাতময় সময়টিকে ইতিহাসবিদ, রাজনীতিবিদ, শিল্পী-সাহিত্যিক নানাভাবে পর্যবেক্ষণ, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন বহুবার। বাঙালির জীবনে ১৯৪৭-এর দেশভাগ এবং ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মতো যুগান্তকারী দুটি ঐতিহাসিক ঘটনাকে বাংলাদেশের নারী ঔপন্যাসিকরা তাদের সাহিত্যে কিভাবে ধারণ করেছেন, ইতিহাসের কোন সত্যকে কিভাবে শিল্পভাষ্যে পুনর্নির্মিত করেছেন, তার খোঁজ নিতে গিয়ে অন্যমাত্রার এক জগৎ আবিষ্কার করার অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়।

‘কেন শুধুই নারী ঔপন্যাসিক?’- এমন প্রশ্ন ওঠাটা স্বাভাবিক। নারীর সহজাত দৃষ্টিভঙ্গি ইতিহাস পর্যবেক্ষণে বিশেষ ভূমিকা রাখতে সক্ষম। নারীর সঙ্গে সমাজের উপরিতলের সম্পর্কই কেবল থাকে না, থাকে গভীরতলেরও। দেশভাগ প্রসঙ্গে বলা যায়, যখন কোনো পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে। তখন পরিবারটির পুরুষ সদস্য কেবল জমিজমা, ঘরবাড়ির শোকে মুহ্যমান থেকেছে। কিন্তু নারী থেকেছে আরো বেশি কিছুর জন্য। মাটি-লেপা উনুনের সঙ্গে, উঠানের পাশে লাগানো লাউগাছটার সঙ্গে, পুকুরপাড়ের জবাফুলের সঙ্গে নারীর থাকে প্রতিদিনের নিবিড় কোমল গোপন সম্পর্ক। সেসব সম্পর্কের গভীরতা কেবল নারীই বুঝতে পারে; অন্য কেউ নয়। কিংবা অন্য আরেকটি উদাহরণ দেয়া যাক, মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালি নারী পাক হানাদার বাহিনী, স্বদেশী দালাল বাহিনীর হাত থেকে প্রতিনিয়ত রক্ষা করতে চেয়েছে স্বামী, ভাই কিংবা সন্তানকে; ঘরবাড়ি, গরুছাগল, ফসল, এমনকি নিজের শরীর ও সম্ভ্রমকে। বাঙালি নারীর এই অজস্র গোপন কোমল বন্ধন গড়ার মানবিকতা বোধ বা বহুকিছুর সঙ্গে লীন হয়ে থাকার ক্ষমতা আর বিরুদ্ধ সময়ে টিকে থাকার জন্য লড়াইয়ের মনোভঙ্গি থেকেই বাংলাদেশের নারী ঔপন্যাসিকরা দেশভাগ ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে পুনর্নির্মাণ করেছে স্বকীয়তায়। এই পুনর্নির্মাণের কর্মযজ্ঞে নারীর নিজস্ব ধরন হয়ে উঠেছে ব্যক্তিনিরপেক্ষ। উপন্যাসের কারিগর হিসেবে নারী সমাজ প্রচলিত ধারণাকে বদলে দিয়ে ইতিহাস ও সমাজ বাস্তবতা পর্যবেক্ষণে স্বতন্ত্র স্বর নির্মাণ করতে পেরেছে। কেবল নারীর দৃষ্টিভঙ্গি বা নিজস্ব উপলব্ধি দিয়ে নয়, দেশভাগ ও মুক্তিযুদ্ধের মতো ঐতিহাসিক দুটি ঘটনাকে উপন্যাসে তারা পুনর্নির্মাণ করেছে ব্যক্তির উপলব্ধি দিয়ে। বলা যেতে পারে, ইতিহাসকে পর্যবেক্ষণ করেছে তারা শিল্পের সত্য নির্মাণের ব্রত নিয়ে। ‘উপন্যাস ও জনগণ’ গ্রন্থে র‌্যালফ ফক্স যেমন বলেছিলেন, ‘বাস্তবকে বুঝতে এবং জানতে চাইলে প্রয়োজন হয় সত্যানুসারী এক জ্ঞানের তত্ত্ব। এবং সত্য তো কোনো বিমূর্ত স্থবির ধারণা নয়, যাকে এক নিয়মমাফিক যৌক্তিক ও বিমূর্ত চিন্তাপ্রণালীর সাহায্যে আবিষ্কার করতে হবে কিংবা আবিষ্কার করতে হবে কোনো এক বিশেষ মতানুযায়ী, সংজ্ঞা বা ইনট্যুইশনের সাহায্যে। একমাত্র বাস্তব ক্রিয়াকলাপের মধ্য দিয়েই সত্যে উপনীত হওয়া যায়। কারণ, কোনো বিষয়বস্তুর জন্য মানুষের যে নিজস্ব প্রগাঢ় অনুসন্ধান, তারই প্রকাশ সত্য। আর এই অনুসন্ধান হলো সবার আগে এক মানবিক ক্রিয়াকলাপ, বিশেষ করে এক সামাজিক ও উৎপাদনমূলক কর্মকা-। শিল্পীকে অবশ্যই সত্যের সঙ্গে একাত্ম হতে হয়।’

১৯৪৭-এর দেশভাগ এবং ১৯৭১-এর ও এর পরবর্তী কয়েকটি বছরের ইতিহাসের পুনর্নির্মাণের এক বিশাল ক্যানভাসের সন্ধান মেলে বাংলাদেশের নারী ঔপন্যাসিকদের উপন্যাসে। দেশভাগের প্রতিক্রিয়া, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ধর্মকেন্দ্রিক রাজনীতির উত্থান, বাঙালি মুসলমানের স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ, বাঙালি জাতিসত্তার উপলব্ধি ও সংকট, ভাষা আন্দোলন, সামরিক শাসন ও পশ্চিম পাকিস্তানিদের বৈষম্যমূলক শাসনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের অনিবার্যতা, মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা, মুক্তিযুদ্ধের তৎপরতা, মুক্তিযুদ্ধে নারীর আত্মত্যাগ, যুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশের সমাজবাস্তবতা, রাষ্ট্র পরিচালনায় দক্ষতা, মুক্তিযোদ্ধাদের হতাশা, বীরাঙ্গনাদের প্রতি রাষ্ট্র্রযন্ত্র ও সমাজের অসম্মান ও দায়িত্বহীনতা, স্বাধীন বাংলাদেশে সুবিধাবাদীদের উত্থান ও ষড়যন্ত্র, সাধারণ মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা ও হতাশার প্রতিফলন ঘটেছে তাদের বেশিরভাগ উপন্যাসেই। বাংলাদেশের নারী ঔপন্যাসিকরা ইতিহাসের সত্যের সঙ্গে একাত্ম থেকেই পুনর্নিমাণ করেন সত্যশিল্পভাষ্য উপন্যাস।

একটি বিষয় স্বীকার করা জরুরি, শুধু দেশভাগের বহুমুখী প্রতিক্রিয়া নিয়ে বাংলাদেশের নারী ঔপন্যাসিকদের লেখা উপন্যাসের সংখ্যা বিস্ময়করভাবেই কম। ওপার থেকে যারা এপারে আসতে বাধ্য হয়েছিল, কেবল তাদের লেখায়ই উঠে আসে দেশত্যাগের যন্ত্রণা। যারা দেশ হারায়নি, তারা এই যন্ত্রণা অনুভব করতে পারে না। রিজিয়া রহমান ছাড়া বাংলাদেশে এমন বাস্তবতার নারী ঔপন্যাসিক নেই বললেই চলে। চেনা প্রতিবেশী রাতের অন্ধকারে কেন, কোথায় হারিয়ে গেল- এমন প্রশ্ন অবশ্য তাড়িত করেছে তাদের। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে আশ্রয় নেওয়া উদ্বাস্তু শিবিরের জীবনাভিজ্ঞতার কোনো চিত্রও তাদের উপন্যাসগুলোতে তেমনভাবে পাওয়া যায়নি। তবে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর পশ্চিম পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালির শ্বাসরুদ্ধকর অভিজ্ঞতা প্রকাশ পেয়েছে দিলারা হাশেমের ‘মিউর‌্যাল’ উপন্যাসে। সেলিনা হোসেনের ‘যুদ্ধ’ উপন্যাসেই পাওয়া গেছে ১৯৭১-এর সম্মুখ সমরের প্রায় নিখুঁত বর্ণনা। ‘দেশ’-এর সংজ্ঞার্থ নির্ধারণ ও সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে দিলারা হাশেমের ‘স্তব্ধতার কানে কানে’ উপন্যাসে। দেশভাগ-ভাষা আন্দোলন-মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক সেলিনা হোসেনের ‘যাপিত জীপন’, ‘নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি’, ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ ও ‘যুদ্ধ’ উপন্যাসে ইতিহাসের বাস্তব চরিত্ররা হাত ধরাধরি করে চলেছে কাল্পনিক চরিত্রের সঙ্গে। বিশেষ করে তার গায়ত্রী সন্ধ্যা বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র গড়ে ওঠার দীর্ঘ অভিযাত্রাকে কেন্দ্র করেই সৃষ্টি হয়েছে। রাবেয়া খাতুনের ‘মেঘের পরে মেঘ’, রিজিয়া রহমানের ‘রক্তের অক্ষর’, মকবুলা মনজুরের ‘শিয়রে নিয়ত সূর্য’ এবং শাহীন আখতারের ‘তালাশ’ উপন্যাসে স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে বীরাঙ্গনাদের বিরূপ বাস্তবতার খোঁজ মেলে। মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা ও সৈয়দপুরের বিহারিদের ভূমিকা উঠে এসেছে রাবেয়া খাতুনের ‘ঘাতক রাত্রি’ আর সেলিনা হোসেনের ‘যুদ্ধ’ উপন্যাসে। চা-বাগানে বাঙালি-কুলি হত্যাযজ্ঞের বীভৎস বয়ান পাওয়া যায় রাবেয়া খাতুনের ‘বাগানের নাম মালনি ছড়া’ উপন্যাসে। তার ‘ফেরারী সূর্য’, ‘হানিফের ঘোড়া’, ‘মেঘের পরে মেঘ’, ‘যা কিছু প্রত্যাশিত’ উপন্যাসে বাঙালি রাজাকার-আলবদর-স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের ঘৃণ্য কর্মকা- আর স্বাধীনতা-উত্তর তাদের পুনর্বাসনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ১৯৮৬ সালে রচিত রিজিয়া রহমানের ‘একটি ফুলের জন্য’ উপন্যাসে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ষড়যন্ত্র সম্পর্কে যেসব আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে, সেই আশঙ্কাকেই যেন সত্য প্রমাণ করে একটি দৈনিক সংবাদপত্রের শেষের পাতায় প্রকাশিত শিরোনাম : ‘মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট এখন সরকারের বোঝা/৩২ প্রতিষ্ঠানের ২৯টি বন্ধ’ সমকাল (ঢাকা, ২০ জানুয়ারি, ২০১২)। যে আকাক্সক্ষা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল বাঙালি, সেই আকাক্সক্ষার প্রত্যাশিত প্রতিফলন ঘটেনি স্বাধীনতার পর। মুক্তিযোদ্ধারা হতাশায় আক্রান্ত হয়েছে যেমন, তেমনি কেউ কেউ হয়েছেন বিপথগামী। ‘হীরণ দাহ’, ‘একদা এবং অনন্ত’, ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’, ‘একটি ফুলের জন্য’, ‘রক্তের অক্ষর’, ‘তালাশ’ ইত্যাদি উপন্যাসে কান পাতলে পাওয়া যায় স্বপ্নভঙ্গের তীব্র দীর্ঘশ্বাস!

ঔপন্যাসিক এভাবেই হয়তো ইতিহাসের সত্য অনুসন্ধান করে ভবিষ্যতের সত্যকে আবিষ্কার করে নিজ শিল্পসত্য নির্মাণের তাড়নায়। বাংলাদেশের নারী ঔপন্যাসিকরা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল এবং এর পরবর্তী সময়কালকে তাদের উপন্যাসে পুনর্নির্মাণ করেছেন ইতিহাসের সত্যের প্রতি অনুগত থেকে। এ কারণেই তাদের উপন্যাসে বাঙালি তার নিজস্ব স্বপ্ন-আকাক্সক্ষা, স্বপ্নভঙ্গ-হতাশা, সংকল্প-সংগ্রাম, প্রেম-অপমান আর মূল্যবোধের অবক্ষয় ইত্যাদি অনুভূতি বহুমাত্রিক স্বর নিয়ে বিচরণ করেছে। ১৯৪৭-১৯৭১ বাঙালির চৈতন্যে যে বিচিত্র অভিঘাতের জন্ম দিয়েছে, সেই অভিঘাতকে নারী ঔপন্যাসিকরা ইতিহাসের সত্য আর শিল্পের প্রতি দায়বদ্ধতা নিয়ে নতুন এক শিল্পসত্যে পরিণত করেছেন। ইতিহাস পুনর্নির্মিত হয়েছে সত্য আর শিল্পের যুগলবন্দিতে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist