আরিফ মঈনুদ্দীন

  ২২ মার্চ, ২০২৪

ধারাবাহিক উপন্যাস (পর্ব ১০)

তাহারা ফিরিয়া আসিলেন

শিক্ষিত রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী হক সাহেব স্ত্রীর কথা শুনে তাজ্জব বনে গেলেন। রসিকতা করে বললেন, তুমি দেখছি স্বদেশ সম্পর্কে এরই মধ্যে পিএইচডি করে ফেলেছ।

রাশেদা আক্তার বললেন, তুমি কি মনে করেছ- আমি সারাদিন গল্পের বই পড়ি? কোনো সময় তো ভালো করে আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহগুলো দেখোনি। ওখানে যেসব বই আমি সংগ্রহ করেছি, তার বেশির ভাগই হলো স্বদেশের ব্যবস্থা- অব্যবস্থা-সম্পর্কিত। আমার তো ইচ্ছে করে- সোনার বাংলার পুরো নেতৃত্ব হাতে নিতে। দেশের সব পুরুষ মনে হচ্ছে অথর্ব হয়ে গেছে। কিছু যোগ্য লোক প্রয়োজন, যারা নিঃস্বার্থ নির্লোভ এবং নিরহংকার হবেন। যেসব বিশ্বাসী মরে যাওয়ার পরই শুধু পুরস্কারের আশা করেন। শুধু নীতি-নৈতিকতায় উত্তীর্ণ হতে পারলেই আমরা হয়ে যাব সোনায় সোহাগা। কারণ সামাজিক রীতিনীতি এবং সাংস্কৃতিক শুদ্ধতার কারণে আমাদের দেশে পারিবারিক জীবন এখনো সুন্দর বলয়ে অবস্থান করছে। সামান্য কিছু দিকভ্রান্ত পাশ্চাত্যানুসারী পশ্চিমা বিষ্ঠাখোর ছাড়া; সুতরাং পারিবারিক জীবনাচারে এই শুদ্ধতা ও পবিত্রতাকে ধরে রেখে যদি পুরো সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় নীতি-নৈতিকতা এবং সঠিক আদর্শের প্রতিফলন ঘটানো যায়, তবে প্রাকৃতিকভাবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অর্থাৎ নাতিশীতোষ্ণ এই ভূমণ্ডলকে পৃথিবীর স্বর্গ বানিয়ে ফেলা তেমন কঠিন কিছু নয়। আর এজন্যে আমাদের নারীদেরও জাগ্রত হতে হবে; সুতরাং আমি মনে মনে ঠিক করেছি- দেশে যাব। ঢাকার বাড়িটায় গিয়ে উঠব। ভালো একটা স্কুল দেখে ওদের ভর্তি করিয়ে দেব। ওখানের ভালো স্কুলে পড়ার দুটো লাভ- একটি হলো, লেখাপড়াও ভালো করে শিখল এবং নিজ দেশের কালচারের সঙ্গে সমানে এগিয়ে গেল। পশ্চিমাদের মতো আমাদের বেশির ভাগ লোকের সংস্কৃতি এখনো নষ্ট হয়ে যায়নি। এখনো ভবিষ্যতের সমূহ সাংস্কৃতিক ক্ষতি থেকে উদ্ধার পাওয়ার সময় আছে এবং সময়টা এখনই। আমাদের অনাকাঙ্ক্ষিত এই গতিকে রুখতে না পারলে বিপর্যয়টা পশ্চিমাদের মতোই হবে। কারণ পাশ্চাত্যের সামাজিক নষ্টামিটা এক দিনে এখানে এসে দাঁড়ায়নি। ওরা যদি আজকের পারিপার্শ্বিক হতাশা সম্পর্কে পূর্বাহ্নেই জানত এবং ব্যবস্থা নিত তবে পাশ্চাত্যের এই সমাজজীবনও অন্যরকম সুন্দর হতে পারত। আমাদের পাশ্চাত্যবাসীর এই উচ্ছৃঙ্খল জীবনাচার থেকে শিক্ষা নিতে হবে এবং সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। যদি আমরা এই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হই তবে শান্তি সুদৃর পরাহত- এটাই স্বাভাবিক। কথায় আছে না, ইতিহাসের বড় শিক্ষা- কেউ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না। আমাদের আজ সময় এসেছে এই সেনটেন্সকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার। আমাদের পারিবারিক জীবনে এখনো পুরোপুরি ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়নি। পশ্চিমা হাওয়ায় কিছু কিছু পরিবার যদিও গা ভাসিয়ে দিয়েছে। তবে এদের বেশির ভাগই সামরিক ও বেসামরিক আমলা এবং আঙুল ফুলে কলাগাছ মার্কা কিছু পয়সাওয়ালা। এদের টাকাপয়সার বেশির ভাগই শেষ হয় অকল্যাণে। যেমন বৈধ বিলাস ছাড়াও সামাজিকভাবে অবৈধ বিলাসে এদের প্রচণ্ড ঝোঁক। এদের পরিবারে একজন অন্যজনের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে মাথা ঘামায় না। যার যা খুশি- যার সঙ্গে ইচ্ছে রাত কাটাবে, এতে তো দোষের কিছু নেই? এরা ডোন্ট মাইন্ড ফ্যামিলি। অর্থাৎ পাশ্চাত্য সবক এরা পুরোপুরি রপ্ত করে ফেলেছে। এদের পরিবারে পশ্চিমাদের মতো খামখেয়ালি বাসা বেঁধেছে এবং শান্তি বিঘ্নিত হওয়া শুরু করেছে।

আজিমুল হক সাহেব মন্ত্রমুগ্ধের মতো স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। এ কী শুনছেন তিনি! ভেতরে ভেতরে রাশেদা আক্তার এতদূর উত্তীর্ণ হয়েছে। স্ত্রীর জ্ঞানের কাছে তার পৌরুষ নতজানু হয়ে যাচ্ছে। তিনি তো শুধু ব্যবসাপাতি নিয়েই ব্যস্ত আছেন। তিনি পরম পরিতৃপ্তির মেজাজে বউকে বললেন, রাসু তোমার মননের উৎকর্ষতায় আমি ধন্য হয়ে গেলাম। আজ দ্বিতীয়বার বুঝলাম কেন এত শান্তি এসে আমার কুঁড়েঘরে ভিড় করছে। কেন লীরা মা আমার আদর্শ সন্তানের গৌরবে আমাকে উদ্ভাসিত করেছে। হাসান-জিসানের লেখাপড়ায় ওদের মেধার বিকাশ দেখে আমি মুগ্ধ হই। সেও তোমারই কারণে। যেভাবে তুমি আমাকে এবং আমার এই ছোট্ট পরিবারকে আগলে রেখেছ, শান্তি না এসে কি পারে? তোমার অর্জন আরো সমৃদ্ধ হোক রাসু। আমি দোয়া করি নেপোলিয়নের সেই কথা আমার আবার মনে পড়ল, ‘তোমরা আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও, আমি একটি আদর্শ জাতি উপহার দেব।’ তবে তাই হবে রাসু, তোমার কথাই আমি রাখব। আমি বুঝলাম, তোমার কথার সারমর্ম হলো আমাদের সমাজে পারিবারিক ব্যবস্থা এখনো এমন উচ্ছন্নে যায়নি যে, এটা থেকে উদ্ধার পাওয়া যাবে না। আমাদের অধিকাংশ নাগরিকই সুশৃঙ্খল পারিবারিক জীবনে অভ্যস্ত; সুতরাং নষ্ট পথগামীদের ঠিক করা বা দমন করা তেমন কঠিন কিছু নয়। বিশেষ করে আমাদের রাষ্ট্রীয় আইনেও এরকম বেলেল্লাপনার ছাড় নেই। যারা তথাকথিত মুক্ত সমাজের চর্চা করে তারা একান্ত নিজ দায়িত্বেই করে। এরা বেশির ভাগই ধনাঢ্য পরিবার। অশুদ্ধ রাজনৈতিক আমলা। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা যেহেতু এদের বা এদের লোকদের হাতে, সেহেতু এদের যাচ্ছেতাই আচরণে কেউ ছাই দেওয়ার মওকা পায় না।

হক সাহেব দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, আসলে কষ্ট লাগে কখন জানো, যখন দেখি যে, পাশ্চাত্যের সুনাগরিকরা একটা সুন্দর-সুশৃঙ্খল সামাজিক কাঠামোয় সুখী ঘরোয়া পরিবারের আশায় সম্ভব সবরকম ব্যবস্থায় ব্রতী হচ্ছেন, তখন আমাদের দেশের তথাকথিত মুক্ত নাগরিকরা ঘর ছেড়ে বের হওয়ার প্রতিযোগিতায় নামছেন। আগেই বলেছি, সংখ্যায় এরা যেহেতু অল্প, ওদের ঘরে ঢোকাতে আমাদের তেমন বেগ পেতে হবে না, কিন্তু পাশ্চাত্যবাসী আজ যে অবস্থায় এসে পৌঁছেছে, এ নষ্ট বলয় থেকে ওরা প্রলয়ের আগপর্যন্ত উদ্ধার পায় কি না, কে জানে। তবে বড় ধরনের একটা সামাজিক বিপ্লব হয়তো এ পথে সাফল্য আনতে পারে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close