আরিফ মঈনুদ্দীন

  ০১ মার্চ, ২০২৪

ধারাবাহিক উপন্যাস (পর্ব ৭)

তাহারা ফিরিয়া আসিলেন

অত্যাধুনিক প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতায় সমৃদ্ধ অর্থনীতিতে যদি সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি এবং ভালোবাসার বন্ধনযুক্ত পরিবার নিশ্চিত করা যায়, তাহলে উন্নয়নের ফলে স্বাচ্ছন্দ্য যে জীবন- তা নিবিড় একাগ্রতায় ভোগ করা যায়। এসব দেশে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করার জন্য যত নিয়মনীতি পদ্ধতি অবলম্বন করা হচ্ছে, পরিবারকে একটি সুশৃঙ্খল কাঠামোয় স্থাপন করার জন্য কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। পরিণামে যে যার মতো জীবন ভোগে বিশ্বাসী হয়ে একটি ছেরাবেরা পরিবেশের জন্ম দিয়ে যাচ্ছে। এখন মাথাব্যথা অবশ্য একটি গোষ্ঠীর ভেতর অনুভূত হচ্ছে- তারা হলেন, যারা সমাজ নিয়ে ভাবে, গবেষণা করে এবং উত্তর পুরুষদের যারা ভালোবাসে। শিথিল সামাজিক বন্ধনে বিচ্ছিন্ন এদের পারিবারিক জীবন। একের প্রতি অন্যের সহানুভূতি তেমন জোরালো ভূমিকা দাবি করে না। বয়সের একটি নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করার পর মা-বাবা সন্তানের খোঁজখবর করা বাহুল্য মনে করেন। বৃদ্ধ বয়সে নর-নারীর যে অসহায় অবস্থার সৃষ্টি হয়, তা আমাদের দেশে তো চিন্তাই করা যায় না। সন্তানদের কাছ থেকে বেখবর বাবা-মারা কখনো একাকী, কখনো ওল্ড হোমে গিয়ে দিন কাটান। আত্মকেন্দ্রিকতায় পেয়ে বসেছে সবাইকে। পরিবারভুক্ত সদস্যরা একের প্রতি অন্যের দায়দায়িত্ববোধ করে না। আমাদের যেমন ছোট ভাইবোনের প্রতি বড় ভাইবোনদের কর্তব্য, সন্তানের প্রতি বাবার আবার বাবার প্রতি সন্তানের কর্তব্য স্বীকৃত। মোটামুটিভাবে পরিবারভুক্ত একের প্রতি অন্যের দায়িত্ব-কর্তব্য অবশ্য করণীয় একটি মানবিক নিয়ম। আসলে আর্থিক সাফল্য এবং সুখ নিশ্চিত দুটো ভিন্ন জিনিস। যদিও আর্থিক সাফল্যের ওপর সুখের আগমন পথ রচিত হয়- তথাপি দেখা যায়, নিবিড় সুখ ভোগে এমন কতগুলো ব্যাপার কাজ করে, যা অর্জন করতে হলে ব্যক্তিজীবনেও শৃঙ্খলা প্রয়োজন। যেমন বিয়ে এমন একটি সামাজিক বন্ধন, যা প্রকৃতির নিয়মনীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। মানুষের সর্বোৎকৃষ্ট ভোগ অর্থাৎ শরীরবৃত্তীয় চাহিদা নিবারণের জন্য এবং বংশ বিস্তার করে পৃথিবীকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার জন্য নর-নারীর এই পারস্পরিক মেলামেশা জরুরি। তাই প্রকৃতির সব নিয়মের মতো এখানেও একটি নিয়ম বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এটা ধর্মীয়ভাবে পরিশুদ্ধ হয়ে আসার আগেও ছিল। প্রকৃতির একটি নিয়ম হলো, সকালে সূর্য উঠবে বিকেলে অস্ত যাবে। ফুল থেকে ফল হয়ে পেকে ঝরে যাবে। মানুষ জন্ম নেবে একসময় বয়স শেষ করে পরলোকে চলে যাবে। এসব নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলে বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী। তদ্রূপ এসব নিয়মের সঙ্গে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হলো ব্যক্তি-বিয়ে-পরিবার-সমাজ-দেশ; সুতরাং নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটিয়ে স্বেচ্ছাচারীভাবে যাচ্ছেতাই জীবনযাপনে অবাধ ভোগ বিলাসে যদি তথাকথিত মুক্ত সমাজ রচনা করা হয়, তাহলে সেটা একসময় প্রকৃতি-বিরুদ্ধতার কারণে প্রকৃতির রোষবিদ্ধ হওয়া খুবই স্বাভাবিক। যেমন এই শতাব্দীতেই তা টের পাচ্ছে ইউরোপবাসী। এইডসের মতো মহামারির আগমন তো এই প্রেক্ষিতে পরীক্ষিতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এই অবাধ যৌনাচারসমৃদ্ধ সমাজ কাঠামোর প্রবর্তনের মাধ্যমে তারা সমাজ থেকে প্রেম-ভালোবাসা এবং পারিবারিক পিছুটানকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে করতে যে উল্টোস্রোত সৃষ্টি করেছে, তা এখন বোঝানো মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য তারা যে একাগ্রতার চর্চা করেছে, তার বিপরীত দিকে পারিবারিক জীবনের প্রতি ছিল সাংঘাতিক রকমের উদাসীন। যে উদাসীনতার ফলে ব্যভিচারই হয়ে দাঁড়িয়েছে সামাজিক প্রথা এবং প্রকৃতি নিচ্ছে এর প্রতিশোধ।

সমাজবিজ্ঞানীরা অতীতের বিভিন্ন ঘটনা যেমন ইতিহাস থেকে আরম্ভ করে ধর্মগ্রন্থ পর্যন্ত ঘাঁটছেন এবং দেখছেন অনেক জাতি ব্যভিচার এবং প্রকৃতিবিরুদ্ধ আচার-আচরণের কারণে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। অতশত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি কী কাজে আসবে, তা যদি ওই রকম একটি বিপর্যয়ের মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। বিশ্বব্যাপী অবাধে অনিয়ন্ত্রিত সুখ ভোগে বিশ্বাসী জনগোষ্ঠীরা যে পৃথিবী নামক গ্রহটাকে কোনদিকে নিয়ে যাচ্ছে কে জানে। মুক্ত জীবন এবং স্বাধীনতার চর্চা যদি এই হয় যে, রাস্তায় নগ্ন হয়ে হাঁটো আর যেখানে-সেখানে যখন-তখন যাচ্ছেতাই জীবন বিনিময় করো, তাহলে তো কুকুরের সঙ্গে মানুষের পার্থক্য থাকে না। এ রকম নগ্নতা যদি অসভ্যতা হয়, তাহলে অবাধ যৌনাচারকে সভ্য বলব কোন দুঃখে।

তাই তো সমাজবিজ্ঞানীরা ভাবছেন- কীভাবে পাশ্চাত্যবাসীকে একটি সুন্দর-শালীন উপভোগ্য জীবন উপহার দেওয়া যায়। এ পর্যায়ে শোনা যাচ্ছে, প্রাচ্য দেশীয় পরিবার জীবনের ওপর একটি জরিপ পরিচালনা করার জন্য বেশ কিছু সমাজবিজ্ঞানী এবং গবেষক কয়েক শ সাংবাদিক সমভিব্যাহারে প্রথম পর্যায়ে এশিয়া সফরে বেরিয়ে পড়বেন। তারা পারিবারিক জীবন গঠন এবং এর শান্তি নিশ্চিত করার জন্য সম্ভব সব ধরনের চেষ্টা করে কয়েকটি গ্রহণযোগ্য ফর্মুলা আবিষ্কারের চেষ্টায় ব্রতী হয়েছেন। বিশেষ করে পাশ্চাত্যের শিক্ষাবিদ বুদ্ধিজীবী এবং রাজনীতিকদের ভেতর যারা গঠনমূলক ও সুশৃঙ্খল জীবনাচারে বিশ্বাসী, তারা সবাই সমাজবিজ্ঞানীদের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়িয়ে দিয়েছেন এ বিষয়ে। এখানেও দেখা গেছে, লেখাপড়ার বিষয়ে যাদের সমাজবিজ্ঞান অন্তর্ভুক্ত, এ ধরনের ছাত্রছাত্রীরা বিভিন্ন সময়ে বাঙালি পরিবার বিশেষ করে মুসলিম পরিবার থেকে এতদ্বিষয়ে বিভিন্ন ডাটা সংগ্রহ করে থাকে।

রাশেদা আক্তারের মাথা এখন আর কাজ করতে চাচ্ছে না। এবার একটু ঝিম মেরে পড়ে থাকা যাক। সন্ধ্যা গড়িয়ে গেছে সামান্য ক্ষণ হলো। প্রকৃতি নরম হয়ে এসেছে। চোখগুলো মনে হচ্ছে ক্লান্ত। অনেকক্ষণ কোনো বিষয়ে চিন্তা করলে রাশেদা আক্তারের এমন হয়। কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিলে কেমন হয়! সবে তো মাত্র সন্ধ্যা গেল। এমন সময় ঘুমানোও তো ঠিক না। ঘরদোর লক্ষ্মীছাড়া হয়। এককাপ চা খাবেন কি না ভাবছেন। মনে হলো, কফিতে দারুণ কাজ হবে। ঠিক আছে চা না, কফিই এক কাপ খাওয়া যাক।

কফির ফ্লেভারটা নাক-কান-চোখ সব জায়গা দিয়েই মনে হলো ঢুকে পড়েছে। শরীরটা ভীষণ রকম চাঙা হয়ে আসছে। নিজের হাতে বানানো কফির স্বাদই আলাদা। হঠাৎ কলিংবেল বাজল। এ অসময় আবার কে এলো! রাশেদা আক্তার দরজা খুলতে এগিয়ে গেলেন।

কী ব্যাপার তুমি? এখন তো তোমার আসার কথা না। যাক এসেই যখন পড়েছ কিছু কথা বলা যাবে। একা একা আর ভাবতে পারছি না।

আজিমুল হক তফাদার খাটে বসতে বসতে এক রকম রসিকতা করেই বললেন, কী এমন কথা তোমার, সংবাদ সম্মেলন ডেকে বসব নাকি?

তোমার হেঁয়ালি রাখো। কথাটা আসলে খাঁটি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close