আলমগীর খোরশেদ

  ১৯ জানুয়ারি, ২০২৪

গ্রামীণ ঐতিহ্য

পৌষসংক্রান্তি

শীতের হিমেল পরশে গ্রামীণ জনজীবন যেন ম্রিয়মান নীরব নিথর। শিশির ঝরা ভোর ভিজিয়ে দেয় দূর্বা ঘাস, সূর্যের আলোয় ঝুলে থাকা শিশির বিন্দু মুক্তোদানা হয়ে চিকচিক করে উঠে প্রিয়তমা বঁধুয়ার নাকফুলের মতো। প্রকৃতির রঙ্গমঞ্চে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যেখানে ছয়টি ঋতু পালা করে আসে রঙিলা কিশোরীর মতো। বদলে যায় প্রকৃতি, পরিবেশ, সমাজ ও জীবনপ্রণালি। মানুষের মনকে স্পর্শ করে, জাগিয়ে দেয়, ওরা হয়ে উঠে ভাবুক, কবি, লেখক, প্রেমিক অথবা দার্শনিক। ঋতুচক্রের মঞ্চে পৌষ আসে শীতের কুয়াশায় হামাগুড়ি দিয়ে। এমনি করে মাসের শেষ দিন মাঘ মাসের হাতছানি, যে-দিন মাস শেষ হয়, সে-দিনকে সংক্রান্তি বলা হয়। একটি প্রচলিত কথা, মাঘের শীতে বাঘ কাঁপে। পৌষের কোমল মিঠে রোদে পিঠা খাওয়া, ভোরে উঠে আগুন পোহানোও যেন সংস্কৃতির অংশ ছিল। গ্রামবাংলার বারো মাসে বারোটি সংক্রান্তির মধ্যে পৌষসংক্রান্তি আসে ফসল তোলার উৎসব নিয়ে। শীতের টুটি ধরে তোয়াক্কা না করে কষ্ট করে ফসল ঘরে তোলে কৃষক। নতুন ফসল তোলার আনন্দ, কৃষাণী স্বপ্ন দেখে এবার মিনসে ধান বিক্রি করে টাকা হলে গড়ে দেবে নাকের নোলক। মেয়েকে নাইওরি আনে। সঙ্গে জামাই। বিকেল থেকেই ঢেঁকির শব্দ। নতুন ধানের চালের পিঠা কুটা। জামাইয়ের পছন্দের পিঠাপুলি বানাতে মধ্যরাত। হিন্দু মতে, সূর্য দেবতাকে উৎসর্গ করে পৌষসংক্রান্তি করা হয়। সংক্রান্তি কথাটার অর্থ হলো সঞ্চার বা গমন। জ্যোতির্বিদ্যায় সূর্যের একরাশি থেকে অন্যরাশিতে সঞ্চার বা গমনকে বলে সংক্রান্তি। আবহমান বাংলার গ্রামীণ সংস্কৃতি জুড়ে মিশে আছে পৌষসংক্রান্তি। এটা মূলত হিন্দু লোকোৎসব। এই সম্প্রদায়ের লোকজন নদীতে সূর্যপূজা দেয় ও ঘুড়ি উড়ায়। হিন্দু মতে, ঘুড়ি ওড়ানোর উদ্দেশ্য হলো দেবতার কাছাকাছি পৌঁছানো।

রাজধানীর পুরান ঢাকায় এখনো হয় ঘুড়ি ওড়ানো উৎসব, যা নবাবি আমল থেকে চলে আসছে। বাংলাদেশে এ সময় হয় ফসল তোলা উৎসব। পৌষ মাসের শেষদিন পৌষসংক্রান্তি পালন করে লোকজন। গ্রামবাংলায় শীতের পিঠাপুলির আয়োজন চলে ঘরে ঘরে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা পৌষ মাসের শেষদিন চিতই পিঠা বানানোর খোলা পুড়িয়া চিতই পিঠা বানায়। মেয়ের জামাইকে ডেকচিভর্তি পিঠা পাঠিয়ে দেওয়া হয় জামাই বাড়িতে।

দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ পৌষসংক্রান্তি পালন করে বেশি। মহাভারতে এই উৎসবের কথা উল্লেখ আছে। এইদিন আলপনা আঁকা হয়। ঘরবাড়ি সাজানো হয়। এইদিন সূর্য তার নিজ কক্ষপথ থেকে মকর রাশিতে প্রবেশ করে। তাই এটাকে পৌষসংক্রান্তির পাশাপাশি মকরসংক্রান্তিও বলা হয়। পিঠা তৈরি, আত্মীয়-স্বজনদের দাওয়াত, ভালো খাওয়া-দাওয়া, বাড়িতে চলত উৎসবের আমেজ।

আধুনিকতার গ্যাঁড়াকল এসে ভুলিয়ে দিয়েছে মানুষের চিরায়ত ঐতিহ্যের অনুষঙ্গকে। এখন সবাই ইন্টারনেটে বুঁদ হয়ে থাকে দিন-রাত। প্রজন্মের সময় কই ঘুড়ি ওড়ানোর? এখন পুরো গ্রাম ঘুরলেও একটা ঢেঁকি, গাঁইল সেঁহাইট পাওয়া যাবে না পিঠা তৈরির জন্য। নারীরাও ঢেঁকিতে ‘পাহার’ দেয় না। এটাকে অনেক ছোট কাজ মনে করা হয়। তার পরও গ্রামীণজীবনের নস্টালজিক স্মৃতি, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে পৌষসংক্রান্তিতে এসে থেমে যায়, শীতে কাবু হয়ে যাওয়া জনজীবন দেখে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close