বাবুল আনোয়ার

  ১৯ জানুয়ারি, ২০২৪

জাহিদুল হক

কবিতার পথ ধরে অনেক দূর

জাহিদুল হক কবিতার পথ বেয়ে হেঁটে গেছেন অনেক দূর। কবিতায় তার উপস্থিতি স্থিত হয়েছে। যেন এ আবাহনে বেঁধেছিলেন প্রাণ। সৃজনশীলতার সঙ্গে আবেগ, মনন ও মেধার কারুকাজে লিখেছেন কবিতা। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছেন হৃদয়ে সূর্যোদয়, সূর্যাস্তের রং মেখে। ষাটের দশকে লেখালেখি শুরু। প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘পকেটভর্তি মেঘ’ বের হয় ১৯৮১ সালে। এরপর একে একে ‘তোমার হোমার’, ‘নীল দূতাবাস’, ‘সেই নিঃশ্বাসগুচ্ছ’, ‘পরীগুচ্ছ ও অন্যান্য কবিতা’, ‘এই ট্রেনটির নাম গার্সিয়া লোরকা’, ‘এ উৎসবে আমি একা’র মতো কাব্য।

জাহিদুল হক স্বচ্ছবোধ ও আবেগময়তার কবি। কবিতায় শব্দ, ছন্দ, চিত্রকল্প প্রয়োগে সাশ্রয়ী। অতিরিক্ত কিছুতে তিনি আগ্রহী ছিলেন না। তবে দীর্ঘ কবিতাও লিখেছেন। তার কবিতায় এক ধরনের নমিত চেতনা ও বেদনা মূর্ত হয়েছে। শব্দ ও ভাষার ক্ষেত্রে অনেক প্রথানুরাগী। যাপিত জীবনের প্রাত্যহিক অনুষঙ্গ থেকে আহরিত উপাদানে নির্মাণ করেছেন কবিতার পঙ্ক্তিমালা। আবেগ, উচ্ছ্বাস, চিন্তার সমন্বয় ঘটিয়েছেন সরল দীপ্তিতে। রোমান্টিকতা আছে। ব্যক্তিগত আবেগ, অনুরাগে খণ্ড খণ্ড ঘটনা,অনুভূতিকে কবিতায় রূপ দিতে তিনি চমৎকারিত্ব ও সক্ষমতা দেখিয়েছেন। অভিমান, অনুযোগ যাপিত জীবনের ভালোলাগা, ভালোবাসা, ব্যর্থতা অস্ফুট বাসনা তার কবিতাকে করেছে হৃদয়াশ্রয়ী। উৎকণ্ঠিত, উদ্বেলিত ভাষায় কবিতাকে করেছেন সৃজনশীলতার বাহন। বিরূপ সময়ের অভিঘাত প্রতিরূপে তার উচ্চারণ ধ্বনিত হয়েছে। তিনি যখন লেখেন- ‘আমি আমার দুচোখ দেখিনি/দেখিনি আমার মগজ/তবু মগজ থেকে ধেয়ে আসা জল/বৃষ্টির মতো ঝরতে দেখেছি/দুচোখ থেকে।/আমি আমার নাশারন্ধের গহীনে দেখেনি/আমি আমার কর্ণ গুহায় দৃষ্টি ফেলেনি/তবু বাতাসে থাকা অজস্র ঘ্রাণ/আর শব্দ শুঁকেছি শুনেছি/নাকে-কানে মেখে।

বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে ষাট দশক একটি বিশেষ ক্রান্তিকাল। এ সময়ে আবির্ভূত কবিরা বাংলা কবিতায় নানাভাবে দ্যুতি ছড়িয়েছেন। তাদের কেউ কেউ জীবনবাদী উচ্চারণে শানিত করেছেন কবিতা। প্রতিবাদী চেতনাকে প্রবলভাবে ধারণ করেছেন। কেউ কেউ আবার হতাশা, অস্থিরতায় নিমজ্জিত থেকেছেন। এ অবস্থার মধ্যে থেকেও তারা কবিতার শিল্পময়তা থেকে দূরে সরে যাননি। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তযুদ্ধ-পরবর্তী আশা-নিরাশাকে কমবেশি সবাই কবিতায় তুলে ধরেছেন। জাতির জনকের নির্মম হত্যাকাণ্ড তাদের ব্যথিত, ক্ষুব্ধ করেছে। আর প্রতিক্রিয়া ধ্বনিত হয়েছে কবিতায়। জাহিদুল হকও এ বৃত্তের বাইরে যাননি। নতজানু বোধে পরিমিত শব্দে লিখেছেন- ‘হঠাৎ রঙিন গোলাপ দেখে/মুজিব বলে ভুল করি।/কোথায় পেলি অমন কুসুম/সোনার বাংলা আ-মরি।/কোথায় পেলি পদ্মা- মেঘনা/কার নামে সে কুলুকুলু,/মসজিদে তোর প্রাণের আজান/মন্দির তোর উলু।’

সরলবোধ, স্বপ্নময়তায় তার কবিতার শরীর নির্মিত হয়েছে বরাবর। এর মধ্য দিয়ে তিনি ক্রমশ পেরিয়ে গেছেন এক অন্তর্লীন অন্ধকার। করেছেন আলোময় ভুবনের সন্ধান।

জাহিদুল হক কবিতার পাশাপাশি গল্প, প্রবন্ধ ও গান রচনা করেছেন। সবমিলে তার ১৮টির মতো গ্রন্থ রয়েছে। গীতিকার হিসেবে তিনি ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়েছিলেন। তার একটি বহুল প্রচারিত শ্রুত, জনপ্রিয় গান হলো- ‘আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়/তবু কেন ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়/কখনো নদীর মতো তোমার পথের পানে/বয়ে বয়ে যায়।’ সুবীর নন্দীর গাওয়া এ গান ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। এখনো তা সংগীতপ্রিয় মানুষের মুখে ধ্বনিত হয়।

জাহিদুল হকের সৃজনশীল প্রতিভা নানাভাবে বিকশিত হয়েছে। সাহিত্যের ডামাডোল বলতে যা বোঝায়, তিনি এসবের সঙ্গে খুব একটা জড়িত থাকতেন না। নিজেকে গড়েছেন নিজের মতো। হয়তো-বা তাই তার কবিসত্তা অন্তর্লীন আবেগে প্রসারিত হয়েছে। তার হৃদয়ের গহীনে প্রোথিত ছিল কবিতার শেকড় ও চলাচলের অবাধ প্রান্তর। সেই পথ ধরেই তিনি হেঁটে গেছেন, পেরিয়ে গেছেন অনেক পথ।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close