নাহিদ হাসান রবিন

  ২২ মার্চ, ২০১৯

চেয়ে নেওয়া দুঃখ

কোনো মানুষই পরিচয় নিয়ে জন্ম নেয় না। জন্ম নেওয়ার পরে তার বেড়ে ওঠার সঙ্গে বাড়তে থাকে পরিচিতি। নানাভাবে নানা মানুষের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠে। মিথুনের সঙ্গে তন্দ্রার পরিচয় হয় লেখালেখির সূত্র ধরে। মিথুন ও তন্দ্রা দুজনই লেখালেখি করে। এ অঙ্গনে দুজনেরই একটা ভালো

পরিচিতি আছে।

তখন ফেব্রুয়ারি মাস, কনকনে শীত। মিথুন সকালের নাশতা সেরে বাসার অদূরেই তার প্রকাশনা অফিসে যাচ্ছিল। সেসময় মোবাইল ফোনটা বেজে ওঠে। পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করতেই লাইনটা কেটে যায়। মিথুন ভাবলো রাস্তার মধ্যে কল ব্যাক না করে অফিসে বসে কল করবে। অফিসে বসে চা খেতে খেতে মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখে আননন নাম্বার। নাম্বারটা ডায়াল কলে আনতেই আবার কল আসে ওই নাম্বার থেকে। রিসিভ করতেই এক মায়াবী নারী কণ্ঠÑ ঢাকা থেকে তন্দ্রা বলছিলাম। আপনি কি মিথুন সাহেব বলছিলেন?

Ñজ্বি বলছিলাম। তন্দ্রা মানে; তন্দ্রা রহমান?

Ñঠিক ধরেছেন।

Ñতা কি মনে করে?

Ñমাঝে মাঝে আপনার কবিতা পড়ার সুযোগ হয়। আপনার লেখা খুব ভালো লাগে। তাই ভাবলাম যে মানুষটি এত সুন্দর লিখতে পারে তার সঙ্গে একটু কথা বলি।

Ñএমন আর কি লিখি। আপনি তো অনেক ভালো লেখেন।

Ñসে যা হোক, আপনার সঙ্গে কথা বলে ভালো লাগলো। মাঝে মাঝে কথা বলা যাবে তো?

Ñকেন নয়, অবশ্যই যাবে।

Ñঢাকায় আসলে বাসায় আসবেন। অনেক খুশি হবো।

দু’দিন পরের কথা। মিথুন তার প্রকাশনা অফিসে বসে আছে। বাইরে অনেক শীত। সন্ধ্যা হওয়ার এখনো অনেক বাকি কিন্তু কুয়াশা দেখে মনে হচ্ছে এখনই সন্ধ্যা নামবে। মিথুন ঘর থেকে বের হয়ে মোড়ের চায়ের দোকানিকে চা দিতে বলে। দোকানি এসে চা দিয়ে যায়। মিথুন চা খেতে খেতে পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে। কখন যে একটা এসএমএস এসেছে বুঝতেই পারে নাই। এসএমএস ওপেন করে। তন্দ্রার এসএমএস। লেখা আছেÑ কথা বলা যাবে কি? মিথুন দেখলো এসএমএসটা বিশ মিনিট আগে এসেছে। মিথুনের বুঝে উঠতে দেরি হয়, এখন তার কি করা উচিত। এসএমএস করবে না কল করবে। টেবিলের উপর থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে চুমুক দেয়। একেবারে ঠান্ডা হয়ে গেছে। দোকানিকে ডেকে আরেকটা চা দিতে বলে। এবারের চা টা বেশ গরম। শরীরটা একটু তাজা মনে হচ্ছে। তন্দ্রাকে কল করে। তন্দ্রার মোবাইলের সুন্দর ওয়েলকাম টিউন মিথুনকে নিয়ে যায় এক স্বপ্নের ভুবনে। কি সুন্দর কবিতা। ‘আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে, আমি চাই কেউ আমার জন্য অপেক্ষা করুক।’ কবিতাটা শেষ না হতেই ওপাশ থেকে কেটে দেওয়া হয়। মিথুন ভাবে হয়তো ব্যস্ত আছে। কিন্তু না; সঙ্গে সঙ্গে কল ব্যাক করে তন্দ্রা। মিথুন রিসিভ করে বলেÑ আপনার রুচির প্রসংশা করতে হয়।

Ñকেন বলুন তো?

Ñঅসাধারণ একটা ওয়েলকাম টিউন সেট করেছেন।

Ñকবিতার পথে হাঁটাহাঁটি করি তাই আর কি।

Ñতা কি মনে করে স্মরণ করেছেন?

Ñএকটা কবিতা শোনাতে চাই।

Ñতাহলে আর দেরি কেন, হয়ে যাক।

তন্দ্রা কবিতা শোনায়। তন্দ্রার মায়াবী কণ্ঠের আবৃত্তি মিথুনের হৃদয়ে গেঁথে যায়। মনে হয় তন্দ্রা যেন হাতছানি দিয়ে তাকেই ডাকছে। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি চিরন্তন দুর্বলতার কারণে মিথুনও ঘরের বউকে ভুলে দুর্বল হয়ে পড়ে আরেকজনের বউ তন্দ্রার উপর।

মাঝে মাঝে ফোনে তাদের কথা হয়, কেউ নতুন কোনো কবিতা লিখলে ফোন করে শোনায়। যা লেখকরা করেই থাকে। কিন্তু মানুষের মন তো। কখন কি চায় বলা যায় না। মিথুনেরও তাই হলো। দিনে দিনে তন্দ্রার প্রতি প্রচ- দুর্বল হয়ে পড়ে। তন্দ্রা অবশ্য এসবের কিছুই জানে না। তন্দ্রা মিথুনকে একজন লেখক হিসেবেই জানে।

বইপত্র বা পত্র-পত্রিকা প্রকাশনার কাজে মিথুনকে প্রায়ই ঢাকায় যেতে হয়। সে সুবাদে ঢাকার অনেক লেখকের সঙ্গেই তার সখ্যতা গড়ে উঠেছে। সপ্তাহের দু-একদিন শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে জমে ওঠে তাদের আড্ডা। তন্দ্রা অবশ্য কখনো বাইরের কোনো আড্ডায় আসে না। তবে যারা এ আড্ডায় বসে, তাদের অনেকের সঙ্গেই তার পরিচয় আছে। মাঝে মাঝে বাসায় ডেকে নিয়ে তাদের সঙ্গে লেখালেখিবিষয়ক কথা বলে।

একদিন আড্ডায় বসেছিল মিথুন এমন সময় তন্দ্রার ফোন আসে। মিথুন আড্ডা থেকে উঠে বাইরে গিয়ে ফোন

রিসিভ করে।

Ñকেমন আছেন?

Ñভালো। আপনি?

Ñআমিও ভালো।

Ñ কোথায় আছেন?

Ñআপনার শহরেই।

Ñতাই না কি। তাহলে বাসায় আসুন না। এ সময় একেবারে ফ্রি আছি।

Ñযাওয়া যায়।

Ñতাহলে আর দেরি নয়, এখুনি চলে আসুন।

মিথুন ঠিকানা অনুযায়ী ধানমণ্ডির বাসায় চলে যায়। মেইন গেটের একপাশে শ্বেত পাথরে লেখা ‘তন্দ্রা রহমান’ আরেক পাশে লেখা ‘কষ্ট ভবন’। মেইন গেট খোলা, মিথুন ভেতরে ঢুকে পড়ে। সামনে বিশাল বাগান। ঢাকা শহরে এত জায়গাজুড়ে বাড়ি হয় কল্পনাই করা যায় না। রঙ বেরঙের মৌসুমি ফুল ফুটে আছে। তাছাড়া ঝাউ, ক্রিসমাসট্রি, সাইকাস, পাতাবাহার ইত্যাদি গাছে ভরে আছে বাগান। মিথুনকে দেখে একজন লোক এগিয়ে আসে, মনে হয় বাড়ির কেয়ারটেকার বা মালি হবে। মিথুনকে বলেÑ আপনি কি মিথুন সাহেব?

Ñজ্বি।

Ñম্যাডাম আপনার কথা বলেছেন। যান ম্যাডাম উপরে আছেন।

মিথুন উপরে উঠতে থাকে। সিঁড়ির দুপাশে টবে লাগানো নানান গাছ। ক্যাকটাস, অর্কিড, মানিপ্লান আরো কত রকমারি গাছ। দেখেই মনে হয় কোন রুচিশীল মানুষের কাজ। মিথুন গিয়ে দাঁড়ায় দরজার সামনে। একবার নিজেকে দেখে নেয়। মিথুন আজ একটা সর্ট পাঞ্জাবি ও ডেনিমের প্যান্ট পরেছে। পকেট থেকে হেয়ার ব্রাশ বের করে চুলগুলো ঠিক করে নেয়। মনের মধ্যে এক অদৃশ্য ভালো লাগা দোলা দিয়ে যায়। কলিং বেল টেপে। দরজা খুলে দেয় তন্দ্রা। দুজনের চোখের কোনে হাসির ঝিলিক। তন্দ্রা বলেÑ আসুন আসুন মিথুন। মিথুন ড্রইংরুমে ঢুকে রুমের চারদিকে চোখ বুলায়। একপাশে দুটি বুক সেল্ফ রাখা। সেল্ফে সাজানো খ্যাতনামা লেখকদের বই। একপাশে সোফা। দেয়ালে টানানো হাতে তৈরি কয়েকটি ওয়ালমেট। এককোণায় বড় টবে লাগানো ক্যাকটাস। সোফার পাশে কাঁচের গোল টেবিলের উপর রাখা সুন্দর একটা বনসাই। সব মিলে পরিপাটি একটা ড্রইংরুম।

ওরা সোফায় পাশাপাশি বসে। তন্দ্রা একটা কালো রঙের ম্যাক্সি পরেছে। কপালে বড় কালো টিপ। ঘন কালো চুলগুলো ফ্যানের বাতাসে মৃদু নড়ছে। চোরাবালির মতো চোখ। ফর্সা শরীরে কালো পোশাক, যেন দেবীর মতো লাগছে। মিথুনের চোখ গিয়ে থেমে যায় তন্দ্রার রক্ত রাঙা ঠোঁটের ওপর।

বসে বসে তাদের অনেক কথা হয়। তন্দ্রা ট্রেতে করে নানা রকম মিষ্টি নিয়ে আসে। দুজন একসঙ্গে মিষ্টি খায়। তারপর মিথুন উঠে দাঁড়ায়, বলেÑ আজ আসি।

Ñআবার আসবেন কিন্তু।

সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছে মিথুন। কিন্তু তার মন পড়ে আছে তন্দ্রার কাছে। তার পা যেন উঠছে না। আজ ওদের প্রথম দেখা। মিথুনের মনে হচ্ছে কেন আরো আগে তাদের দেখা হলো না। মিথুনের মন আবেগের মহাসাগরে সাঁতার কাটছে। তার স্বপ্নের রাজ্যে এখন শুধু তন্দ্রার বসবাস। কিছুই ভালো লাগছে না।

সেদিন আর কোনো কাজ করতে ইচ্ছে করে না। গাড়ি ধরে বাড়ি রওনা হয়। পরিচিত পথ, ঢাকা থেকে কুমিল্লা খুব বেশি সময় লাগে না। কিন্তু আজ মিথুনের পথ যেন শেষ হচ্ছে না।

ওদের পরিচয় ছ’মাস হতে চলেছে। এর মধ্যে ওরা আপনি থেকে তুমিতে এসেছে। একদিন কথায় কথায় মিথুন তন্দ্রাকে বলেছিলÑ আর কিছু না দাও, একটু দুঃখ দিও। সেদিন মিথুনের কথায় তন্দ্রা কোনো উত্তর না দিয়ে শুধু হেসে দিয়েছিল। এই ছয়মাসে তাদের আরো অনেক কথা হয়েছে, দেখা হয়েছে। তন্দ্রা ভেবেছে মিথুন তার একজন ভালো বন্ধু। কিন্তু মিথুন তন্দ্রার আচরণে ভেবেই নিয়েছে

তন্দ্রা তার অন্য কিছু।

দেখতে দেখতে বছর ঘনিয়ে আসছে। মিথুন তার ঢাকার দু-একজন বন্ধুকে তন্দ্রার কথা একটু আধটু বলেছে। সে বুঝতেই পারে নাই এই বন্ধুরাই একদিন তার বড় কোনো ক্ষতি করবে।

বিষয়টা এখন মিথুনের বন্ধুদের কারণেই লেখক অঙ্গনের অনেকেই জানে। এনিয়ে অনেক কানাকানি হয়। তন্দ্রার কোনো দোষ না থাকলেও তাকে নিয়েও নানা মন্তব্য হয়। একসময় কথাগুলো তন্দ্রার কানেও যায়। তন্দ্রাদের এই শহরে একটা পরিচিতি আছে। তন্দ্রার স্বামী আবদুর রহমান বড় ব্যবসায়ী। শহরের সবাই তাকে সম্মান করে। নিজের সুখ, সম্মানের কথা ভেবে তন্দ্রা সরে দাঁড়ায় মিথুনের কাছ থেকে। কিন্তু মিথুন সরে যাওয়ার কোনো পথ খুঁজে পায় না। এখন তন্দ্রার সঙ্গে মিথুনের আর কোনো যোগাযোগ নেই। তন্দ্রা তার স্বামী, সংসার নিয়ে ব্যস্ত দিন কাটাচ্ছে। অন্যদিকে মিথুন তার চেয়ে নেওয়া দুঃখ বুকে ধরে পাগলের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে পথে প্রান্তরে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close