সাইফুদ্দিন সাইফুল

  ২৫ জানুয়ারি, ২০১৯

মধুসূদনের স্বদেশ চেতনা বাঙালি জাতীয়তাবোধ

মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত ব্যক্তিজীবনে হিন্দু না মুসলিম এবং মুসলিম না খ্রিস্টান ছিলেন, এটা বড় কথা না। কথা হলো, তিনি ছিলেন খাঁটি বাঙালি মানুষ। বাংলা তার মাতৃভাষা, বাঙালি জাতীয়তাবোধ তার বিশ্বাসের জায়গা। পৃথিবীর সব দেশে সব কালে প্রকৃত ভালো লেখকরা তার সাহিত্যের মধ্যে স্বদেশ চেতনা ও জাতীয়তাবোধের চেতনাকে ধারণ করে থাকেন। মধুসূদনও দক্ষতার সঙ্গে এটাকে ধারণ করে নিপুণ হাতে অনবদ্য সাহিত্য

সম্ভার সৃষ্টি করেছেন।

একজন বিদগ্ধ সচেতন নিরপেক্ষ পাঠক মাত্রই জানেন, আমাদের বাঙালি রেনেসাঁর কালজয়ী প্রতিভাবান শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে মধুসূদনের সৃজনশীল বৈচিত্র্যময় সাহিত্যে স্বদেশ চেতনার চিন্তা, ভাব ও ভাবনার ঐকান্তিক রূপ-রসের কত বেশি বিকাশ ঘটেছে। আর তাই সুদূর ভার্সাই নগরে থেকেও কবি তার স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা, দেশের কথা, শৈশব জীবনের হাজারো মধুময় স্মৃতি এতটুকু ভুলে যাননি। তিনি তার অমর সৃষ্টি ‘কপোতাক্ষ নদ’ কবিতায় স্বদেশের একটি নদের জলকে গর্ভধারিণী জননীর দুধের সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে প্রবল আবেগে আপ্লুত হয়ে এভাবেই মনের অভিব্যক্তি ব্যক্ত করেছেনÑ ‘সতত, হে নদ, তুমি পড় মোর মনে!/সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে।’ ‘বহু দেশে দেখিয়াছি বহু নদ-দলে,/কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে?/দুগ্ধ-স্রোতরূপী তুমি জন্মভূমি-স্তনে!’

আসলে এ কথা আজ সর্বজনবিদীত, মধুসূদন তার সাহিত্যে বাঙালি জাতীয়তাবোধকে অনেক বেশি জাগ্রত ও বিনির্মাণ করেছেন। ফলে বাংলা কাব্যজগতে মধুসূদনের আবির্ভাবের কারণেই বাংলা সাহিত্যে বাঙালির মনে মননে ও বিশ্বাসে এক নতুন আশা-আকাক্সক্ষার দীপ্ত আলো আলোকিত হয়ে ধরা দিয়েছিল। তার ‘কপোতাক্ষ নদ’ কবিতাটি তারই জলন্ত উদাহরণ হয়ে কালের সাক্ষী হয়ে আছে।

বাংলা সাহিত্যে অনেক বড় বড় কবি-সাহিত্যিকের আবির্ভাব হয়েছে এবং তারা বাংলা ভাষায় কাব্য কথাসাহিত্য গদ্য ইত্যাদি নির্মল সাহিত্যের জন্ম দিয়েছেন। কিন্তু দেশের কোনো নদীকে কাব্যে তুলে ধরেছেন কয়জনা তার হিসাব মেলে না। অথচ মধুসূদন তার কবিতায় তার শৈশব কৈশোর ও যৌবনের স্মৃতির সাক্ষী প্রিয় কপোতাক্ষ নদকে এক দুর্লভ জীবন্ত রূপ দান করেছেন। এখানেই মধুসূদনের বিশেষ শক্তিময়তা ও সত্তা লুকায়িত রয়েছে।

মূলত মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্যকে একেবারে স্বদেশ প্রেমের রঙে রাঙিয়ে উন্মুক্ত নীলাকাশের গায়ে রংধনুর মতো অপরূপ সৌন্দর্যের নান্দনিক এক লীলাক্ষেত্র তৈরি করেছেন। আর এখানেই স্বদেশ চেতনা ও বাঙালি জাতীয়তাবোধ সম্পূর্ণ আপন সত্তা পরিপূর্ণ অখ- ভাব ও ভাষা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। এটাকে অস্বীকার করা যাবে না। কবি মধুসূদনের চিন্তা-চেতনায়, ভাবনায়-বিশ্বাসে ও তার সাহিত্যে স্বদেশ চেতনা এবং জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটেছিল বলেই তিনি আজ আধুনিক বাংলা কবিতার জন্ম দিতে সক্ষম হয়েছেন। কেননা, একজন যুগসচেতন কবি হিসেবে মধুসূদনের অবদান বাংলা কাব্যকে অনেক বেশি সমৃদ্ধ ও বিকশিত করেছে।

অবশ্য আমরা এ কথা নিশ্চিত করে বলতে পারি, বিগত উনিশ শতকের বাংলা কবিতার নবজাগরণের অন্যতম ব্যক্তিত্ব এবং শক্তিমান প্রধান কবি মধুসূদনের ক্ষণকালের বর্ণাঢ্য যাপিত জীবনে একদিকে যেমন স্বদেশ চেতনার যারপরনায় উন্মেষ ঘটেছে, তেমনি আবার তার গোটা বৈচিত্র্যময় সৃজনশীল সাহিত্যকর্মের মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবোধের প্রসার অত্যাধিক লাভ করেছে। মোটকথা, স্বদেশ চেতনা ও বাঙালি জাতীয়তাবোধ নিরেট মৌলিকসত্তার মতো কবিকে জাগিয়ে তুলেছে। আর সবকিছু মিলেই কবি মধুসূদনকে এক অনন্য রূপে কালের সামনে দাঁড় করিয়েছে। তার চেতনায় স্বদেশ ভাবনা বিস্ময়করভাবে প্রকাশ হয়েছে। আর তাই তার সাহিত্যে স্বদেশ চেতনা প্রতিটা পাঠককে মুগ্ধ ও অবাক করেছে। আসলে স্বদেশ চেতনা ও জাতীয়তাবোধ মধুসূদনকে এতটাই আলোকিত করেছে, তিনি সমাজ ও ধর্মের প্রচলিত প্রথাকে ভাঙতে ও অস্বীকার করতেও পিছপা হননি। অনেক প্রথাকেই তিনি প্রশ্নের সম্মুখীন দাঁড় করিয়েছেন। যদিও এই জন্যে তাকে সমাজের কাছ থেকে কটূক্তি বদনাম শুনতে হয়েছে। তার প্রতি বাঁকা চোখে তাকানো হয়েছে। কিন্তু এতকিছুর পরেও মধুসূদন নো-কেয়ার করে তার সাহিত্যভা-ারকে সমৃদ্ধ করে আগামীর দিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। মধুসূদনকে উপেক্ষা করলে বাংলা সাহিত্য, বাংলা কাব্য, বাংলা মহাকাব্য আপন শক্তিতে দাঁড়াবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে। কাজেই যত দিন বাংলা সাহিত্য-কাব্য-নাটক ও মহাকাব্য থাকবে, তত দিন মধুসূদন মহিরুহ হয়ে সৃজনশীলতার আলো ছড়াবেন। বাংলা সাহিত্যে প্রথম মহাকাব্য রচনা করে বাংলা কাব্যকেই সম্পূর্ণ নতুনরূপে তুলে ধরেছেন। বিশ্বকে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, আমরা বাঙালিরা দেশপ্রেমে, চেতনায়, জাতীয়তাবোধে অন্যদের চাইতে অনেক অনেক বেশি স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছি এবং তা পারিও বটে।

অবশ্য এটা ঠিক, কবি মধুসূদন তিনি পাশ্চাত্য অনুসারে অনুকরণে (ইতালির কবি পেত্রার্ক সনেটের জনক) চতুর্র্দশপদী কাব্য রচনা করেছেন। তবে তিনি তার কবিতাকে নিজের বিশ্বাস ও আস্থা থেকেই রচনা করেছেন। তিনি নিজের ভাষার, সংস্কৃতির, ইতিহাস-ঐতিহ্যের, স্বজাতির প্রতি দ্বায়বদ্ধতা থেকে সচেতনভাবেই সতত কাব্য রচনা করেছিলেন। এই জন্যে আমরা তার গোটা কাব্যজগতে দেশপ্রেমের ছোঁয়া স্বজাতির প্রতি ভালোবাসা আপন ভাষার প্রতি বিশ্বাস ও নিজের সংস্কৃতির প্রতি অকাট্য শ্রদ্ধা এবং আন্তরিকতার প্রকাশ দেখতে পাই। এই জন্যে দূর দেশে বাস করেও মাতৃভাষাকে তিনি ভুলে যাননি। মাতৃভাষার প্রতি তার ভালোবাসা কিছুতেই মøান হয়নি। আর তাইতো তিনি মাতৃভাষার বন্দনা করতে গিয়ে এক অনন্য সার্থক সুন্দর চমৎকার কবিতা রচনা করেছেন। তিনি নিজ ভাষা সংস্কৃতি ঐতিহ্যকে ভুলে অন্যের পরধনে লোভ করাটাকে চরম ঘৃণা করে ক্ষেপে গিয়ে তাই ‘বঙ্গভাষা’ কবিতায় মূল্যায়নটা করেছেন যথার্থইÑ ‘হে বঙ্গ, ভা-ারে তব বিবিধ রতন;/তা সবে (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,/পরধন লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ/পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি;/মজিনু বিফল তপে অবরণ্যে বরি;/কেলিনু শৈবালে;

ভুলি কমল কানন!’

মহাকবি মধুসূদন দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে এবং জাতীয়তাবোধে নিজেকে শামিল করে তার সকল সাহিত্যকর্মকে এক অনন্যরূপে অসাধারণ আঙ্গিকে নতুনের স্পর্শে অভিনব নির্মাণ করে কালের হাওয়ায় আগামীর চেতনায় বাংলার সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বদরবারে ছড়িয়ে দিয়েছেন। যেহেতু পাশ্চাত্য ভাষা-শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতার প্রতি কবি মধুসূদন অধিক পরিচিত ছিলেন, সেহেতু তিনি স্বদেশ চেতনা ও বাঙালি জাতীয়তাবোধে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলা ভাষা ও বাংলা কাব্যকে পরাধীনতার শিকল ছিড়ে বের করে এনেছিলেন। এখানেই তার কাব্য রচনার স্বার্থকতা খুঁজে পাওয়া যায়। এবং স্বদেশ চেতনা জাগ্রত হয়েছে।

হ্যাঁ এটা ঠিক, মধুসূদন তিনি তার নিজের ভাষা-সাহিত্য-স্বজাতির প্রতি অবজ্ঞা-অবহেলা করেছেন, মাতৃভাষাকে বাদ দিয়ে পরভাষায় সাহিত্য সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন, আপন ধর্ম-সংস্কৃতিকে বদলিয়ে অন্যের ধর্ম সংস্কৃতিকে গ্রহণ করেছিলেন; এখন প্রশ্ন হলো, তার কেন এই অবজ্ঞা, কেন এই অবহেলা? এটা কি শুধুই পরধর্ম ভাষা সংস্কৃতি গ্রহণ করে বিশ্বের মাঝে বড় একজন কবি বা লেখক (এলিয়ট, কিটস, বায়রণ, শেকসপিয়র) হওয়ার জন্যেই করেছেন, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য অথবা চিন্তা-চেতনা লক্ষ্য ছিল! আজ নতুন করে এই বিষয়টি নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।

অতএব কবি মধুসূদনের গায়ে হরহামেশা যে অপবাদ বা ছিল, আমরা এঁটে দিচ্ছি, সেটা কতটুকু জেনে বুঝে ভেবে করছি তাও ভাবতে হবে। আসলে আমরা একটু খেয়াল করলে দেখতে পাবো, তিনি যখন জন্মেছেন তখন বাংলা কবিতার আকাল চলছিল এবং বাংলা সাহিত্য মৃতপ্রায় অবস্থার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছিল। এমতাবস্থায় মধুসূদন এসে বাংলা কবিতার হাল ধরলেন। বাংলা কাব্যকে নতুন

করে জন্ম দিলেন।

কবি মধুসূদন তার বন্ধুবর রাজনারায়ণ বসুকে লেখা (বিলেতে যাওয়ার পূর্বে) এক চিঠিতে তিনি তার ‘বঙ্গভূমির প্রতি’ কবিতায় মাতৃভূমির প্রতি তার নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ও পরম কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। কবি যে এই বঙ্গভূমি মাতৃভূমি মায়ের একজন দাস ও মা মাটি দেশ যেন তাকে না ভুলে মনে রাখে এবং কবি যেন বিস্মৃতির একেবারে আড়াল হয়ে না যান সেকথা একান্তে নিবেদন করেছেনÑ ‘রেখো, মা, দাসেরে মনে, এ মিনতি করি পদে।/সাধিতে মনের সাদ,/ঘটে যদি পরমাদ,/মধুহীন করো না গো তব মনঃ কোকনদে।’ ‘সেই ধন্য নরকুলে,/লোকে যারে নাহি ভুলে,/মনের মন্দিরে সদা সেবে সর্ব্বজন।’

মহাকবি মধুসূদনের চিন্তায় ও বিশ্বাসে স্বদেশ চেতনা ও বাঙালি জাতীয়তাবোধ কতটা প্রভাব ফেলেছে এবং সেটা অতিব শক্ত অবস্থান করে আছে তারই বাস্তব পেক্ষাপট ও চরম সত্যতা মেলে ‘কপোতাক্ষ নদ’ ‘বঙ্গভাষা’ ‘বঙ্গভূমি’সহ আরো অনেক অনেক কবিতার পরতে পরতে। একজন লেখক দূরদেশে বসে নিজের দেশের একটি নদকে এতটাই ভালোবেসেছেন এবং মনে রেখেছেন, সে নদের স্বচ্ছ কাচের মতো জলকে গর্ভধারিণী জননীর বিশুদ্ধ পবিত্র দুধের সঙ্গে তুলনা করেছেন। দেশের একটি নদ বা নদীকে ভালোবাসা, পবিত্র আসনে বসানোর মধ্যেই মূলত গভীর দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ষ্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে ভাষাতো মায়ের মতো। কাজেই, মাকে যেমন অস্বীকার করা যায় না, তেমনি ভাষাকেও কোনো প্রকারেই অস্বীকার করা যায় না। আর ভাষার প্রতি অবহেলা অবজ্ঞা করাটা নিজের সঙ্গেই বিশ্বাসঘাতকতা করার শামিল। কবিতো এমন সত্য ইঙ্গিতই অকপটে বলেছেন।

কলকাতার লোয়ার সার্কুলার সড়কের পাশে মহাকবি মধুসূদনের সমাধিস্থল। কবির এই সমাধি ফলকে লেখা (মধুসূদনের মৃত্যুর কিছুদিন আগে নিজ স্বহস্তে) তার এপিটাফে দৃঢ় বিশ্বাস ও অধিকার নিয়ে মনের কথা বলেছেনÑ ‘দাঁড়াও, পথিক-বর, জন্ম যদি তব/বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এ সমাধিস্থলে।’

প্রিয় পাঠক, একটু ভেবে দেখুন, এখানে এই কবিতায় কবি তিনি তার সমাধিক্ষেত্রে লিপিবদ্ধ এপিটাফে ‘দাঁড়াও’-এর পরিবর্তে দাঁড়ান কথাটি বলতে পারতেন কিন্তু বলেননি। বলেছেন, দাঁড়াও অর্থাৎ নিজ বঙ্গদেশের কোনো বঙ্গ পথিকের কাছে আপন অধিকারের অভিব্যক্তি এভাবে সম্বোধন করেছেন। আসলে নিজ দেশের, দেশের মানুষের, ভাষার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা-ভালোবাসা-প্রেম-বিশ্বাস ছিল বলেই তিনি এমন দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করতে পেরেছেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close