নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২৩ মার্চ, ২০২৪

ঢাকার রাস্তায় ভাঙাচোরা বাস সংশ্লিষ্টরা নির্লিপ্ত

রাজধানী ঢাকার সড়কে ভাঙাচোরা লক্কড়ঝক্কড় বাসের কারণে মাঝেমধ্যেই নানা দুর্ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে আলোচনা হলেও বাসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। এ দায়িত্ব আসলে কার সে প্রশ্নই রয়েছে। এ লক্কড়ঝক্কড় বাসের বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বুধবার ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একটি র?্যাম্প খুলে দেওয়া উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘বারবারই বলা হলেও বাসের চেহারা বদলাচ্ছে না। সরকারের গাফিলতির কী আছে? আমি মন্ত্রী কি নিজে গিয়ে বাস রং করব?’

এর আগে গত কয়েকদিন ধরেই সামাজিক মাধ্যমে ঢাকার রাস্তায় চলাচল করছে এমন কিছু ভাঙ্গাচোরা গাড়ির ছবি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছিল। সে প্রেক্ষাপটেই সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এমন মন্তব্য করেছিলেন।

পরে বৃহস্পতিবারও এক সভায় লক্কড়ঝক্কড় বাসের প্রসঙ্গ তুলে ফিটনেসবিহীন বাস সড়কে না চালানোর জন্য বাস মালিকদের অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘ঢাকায় চলাচল করা লক্কড়ঝক্কড় গাড়িগুলো বাংলাদেশের উন্নয়নকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। যখন বিদেশিরা বাংলাদেশে আসে এবং আমাদের লক্কড়ঝক্কড় গাড়ি দেখে, তখন আমাদের খুব লজ্জা হয়। এগুলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়নকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। পরিবহন মালিকদের এদিকে নজর দিতে হবে। কাদের আরো বলেছেন, যে তাকে পরিবহন মালিক সমিতির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে ঢাকার বাইরে থেকে ফিটনেসবিহীন গাড়ি ঢাকায় ঢোকে।

‘আমি তো বলব বাইরে থেকে সিটিতে লক্কড়ঝক্কড় গাড়ি কম আসে। বরং সিটিতেই অনেক লক্কড়ঝক্কড় গাড়ির কারখানা আছে। আমি সেগুলো নিজের চোখে গিয়ে দেখেছি। ঈদের আগে সেগুলোতে রং লাগাতে দেখেছি, যে রং আবার ১০ দিনও থাকে না। তবে মন্ত্রী তার বক্তৃতায় নিজেই বিআরটিএর সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। যদিও বিআরটিএ বলেছে, তারা লক্কড়ঝক্কড় বাসের বিরুদ্ধে প্রতিদিনই অভিযান চালায়। কিন্তু এসব বাস কীভাবে ফিটনেস সনদ পায় সে প্রশ্নের উত্তর নেই তাদের কাছেও।

বিশেষজ্ঞরা এবং বাস মালিক সমিতির নেতারাও বলছেন বাসের রং করার দায়িত্ব মন্ত্রীর না হলেও রাস্তায় আনফিট বাস চলাচল বন্ধ করার দায়িত্ব সরকারেরই। সড়ক দুর্ঘটনা ও গণপরিবহনবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হাদীউজ্জামান বলেছেন, লক্কড়ঝক্কড় বাসকে ফিটনেস সনদ দেয় সরকারি প্রতিষ্ঠান বিআরটিএ। আর সেই ফিটনেস সনদ নিয়ে এরা রাস্তায় নেমে সংশ্লিষ্টদের ‘নানাভাবে ম্যানেজ’ করে।

‘সড়কে নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা আর বায়ুদূষণের জন্য এ ভাঙ্গাচোরা বাসগুলোই দায়ী। অনেক বাস এতোই ভাঙ্গাচোরা যে দেখতেই খারাপ লাগে। অথচ এদের বিরুদ্ধে কেউ কোনো ব্যবস্থা নেয় না। এর দায়িত্ব সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোরই, যার মধ্যে বিআরটিএ গুরুত্বপূর্ণ। এটি তো মন্ত্রীরই অধীনে।’

হাদীউজ্জামান আরো বলেন, মেট্রো রেল বা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো বড় অবকাঠামোতে সরকার যতটা যত্নশীল ঢাকার সড়ক ব্যবস্থাপনায় তা দেখা যায় না বলেই কেউ আইন মানে না। ‘এখানে বাস মালিকদের অনুনয় বিনয়ের সুযোগ নেই। সরকার নিয়ম বা আইন করবে এবং সংশ্লিষ্টদের সেটি মেনেই বাস চালাতে হবে। এই বাস দেখার দায়িত্ব সরকারের।’

মূলত সরকারের দুটি প্রতিষ্ঠান ঢাকার সড়কে যানবাহন চলাচলের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। একটি হলো বিআরটিএ আর অন্যটি হল পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ। এর মধ্যে বিআরটিএ ফিটনেস সনদ ও রুট পারমিট দেওয়ার কাজ করে। একটি বাসের বত্রিশটি বিষয় পর্যবেক্ষণের পর তাদের ফিটনেস সনদ দেওয়ার কথা থাকলেও ভাঙ্গাচোরা বাসগুলো কীভাবে এ সার্টিফিকেট পায়, তা নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে।

রাস্তায় ট্রাফিক বিভাগের সংশ্লিষ্টদের ফিটনেসহীন বাস জব্দ করতে খুব একটা দেখা যায় না। ট্রাফিক বিভাগ বলেছে অনুপযোগী বা আনফিট যানবাহন রাস্তায় দেখলেই আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছে তারা। যদিও অভিযোগ আছে মোটরসাইকেল বা প্রাইভেট কার ধরার বিষয়ে পুলিশের মধ্যে যতটা উৎসাহ কাজ করে, ভাঙাচোরা বাসের বিষয়ে তা দেখা যায় না।

ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কার্যকরী সভাপতি আবুল কালাম বলেন, ‘ঢাকায় যত বাস চলাচল করে তার মধ্যে মাত্র ১ থেকে ২০ শতাংশের অবস্থা খারাপ। মালিক, শ্রমিক, সমিতি, যাত্রী, বিআরটিএ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সবাই মিলে কাজ না করলে লক্কড়ঝক্কড় বাস ও বাসের নৈরাজ্যের অবসান হবে না।’

কিন্তু মালিকরা কেন ভাঙ্গাচোরা বাস রাস্তায় নামাচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কোনো গাড়ি এক দিনে লক্কড়ঝক্কড় হয় না। এগুলো যাদের ধরার কথা ধরে না কেন? এসময় যারা ফিটনেস দিল, দায় তো তাদের।’ অর্থাৎ বাস মালিকরাও অনেকে মনে করেন কিছু মালিক যে লক্কড়ঝক্কড় বাস চালানোর সুযোগ পাচ্ছে সেটি পাচ্ছে বিআরটিএয়ের কারণেই। ‘কোনো গাড়ি ১০ বছরে ফিটনেস সনদ নেয় না। সরকারকে ট্যাক্স দেয় না। রুট পারমিট নাই। কিন্তু তারাও তো রাস্তায় চলছে। কীভাবে চলছে? কারা তাদের চলতে দিচ্ছে?’ ‘এখানে বৈধভাবে চলতে গেলে রাস্তায় প্রতিদিন মামলা খেতে হয়’-একজন বাস মালিক বলেন নাম প্রকাশ না করার শর্তে।

আবুল কালাম বলেছেন, ‘আইন প্রয়োগের দায়িত্ব যাদের তারা ভাঙা বাস জব্দ করে না কেন? তারা তো জব্দ করে বিআরটিএ-কে জানানোর কথা। বিআরটিএ এগুলো চলতে না দিলে তারা চলে কীভাবে?’

বিআরটিএ’র মুখপাত্র মাহবুব ই রাব্বানী বলেন, বিআরটিএ মোবাইল কোর্টসহ নানা ধরনের অভিযান পরিচালনা করছে এবং প্রতিদিনই আনফিট যানবাহনকে জরিমানা করা হচ্ছে। কিন্তু সবাই মিলে আইনকে শ্রদ্ধা না করলে এ সমস্যার সমাধান কীভাবে হবে? কিন্তু আনফিট বা লক্কড়ঝক্কড় যানবাহন ফিটনেস সনদ পায় কীভাবে, সে প্রশ্নের কোনো সদুত্তর তার কাছে পাওয়া যায়নি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close