দিলরুবা খাতুন, মেহেরপুর

  ২১ মার্চ, ২০২০

‘আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প’

প্রতিবন্ধী ডেইজির ভাগ্যবদল

মেহেরপুরে শারীরিক প্রতিবন্ধী ডেইজি খাতুন। সে এই প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। সমাজ তথা গ্রামে সে এখন দারিদ্র্য বিমোচনে রোল মডেল। সরকারের দারিদ্র্য বিমোচনে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ ১০ উদ্যোগের অন্যতম উদ্যোগ হচ্ছে ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্প। মেহেরপুরের আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পের সদস্য শারীরিক প্রতিবন্ধী ডেইজি খাতুন। ডেইজি খাতুনের শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন জুগিয়েছে ‘আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প’-এর ঋণে হাঁস, মুরগি ও ছাগল পালনের মাধ্যমে।

মেহেরপুর সদর উপজেলার আমদহ ইউনিয়নে সাহেবপুর একটি ছোট্ট গ্রাম। গ্রামের শ্রমজীবী অশেক বিশ্বাস ও গৃহবধূ মাছুরা খাতুনের দুই মেয়ের মধ্যে ডেইজি খাতুন বড়। শারীরিক প্রতিবন্ধী হওয়ায় শুধু অসচ্ছল পরিবারেরই নয় প্রতিবেশী ও সমাজের কাছেও বোঝা হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ডেইজি খাতুনের ইচ্ছাশক্তি ও আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প তাকে ঘুরে দাঁড়াতে সহায়তা করেছে। দরিদ্রতা এবং শারীরিক প্রতিবন্ধকতা জয় করে সে এখন স্বাবলম্বী। সে ২০২০ সালে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। শ্রমজীবী বাবা যখন মেয়ের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে পারছিল না তখন ডেইজি খাতুনের চলার পথ সুগম করে দিয়েছিল ‘আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প’। শারীরিক প্রতিবন্ধী ডেইজি ২০১৭ সালে এই প্রকল্প থেকে ১০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে একটি ছাগল ও ছয়টি মুরগি কিনে পালন শুরু করে। লালন পালন করে সেই ছাগল ১৭ হাজার টাকায় বিক্রি করে সে ঋণ শোধ করে। এরপর ১৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ছাগল কিনে। এরপর এই প্রকল্প থেকে ২৫ হাজার টাকা ঋণ নেয়। সেই ঋণের টাকায় ফের ছাগল পালন করে এখন তার বাড়িতে ৯টি ছাগল, ১০টি হাঁস ও মোরগ-মুরগিতে বাড়ি ভরে গেছে। হাঁস-মুরগির ডিম বিক্রি করে নিজের লেখাপড়াসহ পরিবারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে ডেইজি। প্রতি মাসে সে এখন ২০০ টাকা করে সঞ্চয় জমা করছেন।

তাদের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। এ প্রকল্পের আওতায় সে হাঁস-মুরগি ও ছাগল পালনের মাধ্যমে নিজের লেখাপড়ার খরচ, পারিবারকে সহযোগিতার পাশাপাশি আয়বৃদ্ধি করছেন। কথা হয় ডেইজির সঙ্গে। তিনি জানান, শ্রমজীবী বাবার সংসারে নিজেকে বোঝা মনে হতো। লাঠিতে ভর করে চলতে-ফিরতে হয়। স্কুলেও সাথীদের মতো চলতে পারতাম না। সমবয়সিরা যখন ছোটাছুটি করে খেলা করত তখন আড়ালে আড়ালে কাঁদতাম। ভাবতাম আমার বিয়ে হবে না প্রতিবন্ধকতার কারণে। এখন বিয়ের কথা ভাবি না। ভাবি আমি তো লাঠিতে ভর করে হলেও চলতে ফিরতে পারি। টেলিভিশনে আমার বাড়ি আমার খামারের কথা শুনে ইউপি মেম্বারের মাধ্যমে প্রকল্পে যোগাযোগ করি। সেখানে সদস্য হয়ে ঋণ পাই। সেই ঋণ আমার ভাগ্য বদলে দিয়েছে। এখন ভাবি প্রতিবন্ধী কোটায় যদি সরকার একটি চাকরি দেয়।

সাহেবপুর গ্রামের ডেইজি খাতুন এখন এই প্রকল্পে একটি আলোচিত নাম। সরেজমিনে তাদের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, তার মা মাছুরা হাঁস-মুরগি আর ছাগলের যতেœ ব্যস্ত। বাবা শ্রম বিকাতে মাঠে গেছেন। ডেইজি গেছে জেলা শহরে। বাড়ি ফিরতেই তার পালিত হাঁস প্যাক প্যাক করে জানান দিল তাদের খাবারের কথা। ধানের কুড়া পানি মিশিয়ে দিলেন হাঁসগুলোকে। সকালে সংগ্রহ করে রাখা কাঁঠাল পাতা দিলেন ছাগলকে। ডেইজির মা মাছুরা জানান, এসব পালনের মাধ্যমে তারা এখন ভালোই আছেন। কষ্টের মধ্যেও মেয়ের লেখাপড়াসহ জীবন চালিয়ে নিচ্ছেন।

আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পের মাঠ সহকারী সাইফুল ইসলাম বলেন, সাহেবপুর গ্রাম উন্নয়ন সমিতির সদস্যদের মধ্যে ডেইজি খাতুন শুধু নিজ গ্রামেই নয়, আশপাশের গ্রামগুলোতেও সে এই প্রকল্পের রোল মডেল। আমদহ ইউপি চেয়ারম্যান আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, প্রধানমন্ত্রীর আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প আমার ইউনিয়নের নিজ পরিবারের ভাগ্য পরিবর্তন করে নিয়েছে ডেইজি। আমিও অনুপ্রাণিত হয়েছি গৃহপালিত প্রাণিসম্পদ পালন সম্প্রসারণ করার। তিনি আরো বলেন, ছাগল পালনে এখানে কোনো খরচ নেই। ছাগল মাঠে চরে খেয়ে জীবন ধারণ করে। আর হাঁস পাশের নদী থেকে খাবার খেয়ে ডিম দেয়। হাঁস ও ছাগল পালন খুবই লাভজনক। তাই এ এলাকার মানুষ যাতে হাঁস ও ছাগল পালন করে স্বাবলম্বী হয় সেই পদক্ষেপ নেব। আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পের উপজেলা সমন্বয়কারী মো. মনওয়ার হোসেন বলেন, আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পে সদর উপজেলায় ৪ হাজার ১৪১ জন সদস্যর ১ কোটি ৩৪ লাখ ২৭ হাজার ১১ টাকা সঞ্চয় জমা আছে। সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পের সভাপতি মাসুদুল আলম বলেন, আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পটি সফলভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রকল্পের অধীনে গঠিত সমিতির প্রতিটি সদস্যের বাড়ি আজ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অর্থনৈতিক ইউনিট হিসেবে গড়ে ওঠেছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই সুচিন্তিত উদ্যোগ সীমান্তবর্তী জনপদের দরিদ্র মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। সাহেবপুর গ্রাম সমিতির সদস্য ডেইজি খাতুন এ প্রকল্পের সুবিধা গ্রহণ করে আত্মনির্ভরশীল হয়েছে। প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে সমাজে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার তার এই প্রত্যয়ের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরে আমরা গর্বিত।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close