মো. রাজু খান, ঝালকাঠি

  ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

অযত্নে ‘দাশের ভিটা’ শুকিয়ে গেছে তিন নদী

ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার বামনকাঠি গ্রাম। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ধানসিঁড়ি নদী। নদীতীরের গ্রামটিতে একটি পরিত্যক্ত ভিটায় রয়েছে কিছু গাছপালা। পুকুর থাকলেও ঘাট ভাঙাচোরা। স্থানীয়ভাবে এটি ‘দাশের ভিটা’ নামে পরিচিত। ধারণা করা হয় বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃৎ ও রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের পৈতৃক ভিটা। ফলে তাঁর পৈতৃক ভিটা দেখতে আসেন দেশ-বিদেশের পর্যটক। তবে এই বিরান ভিটা দেখে হতাশ হওয়া ছাড়া তাঁদের আর কোনো উপায় থাকে না।

সরেজমিনে দেখা যায়, ভিটির ধ্বংসপ্রাপ্ত চিহ্ন কোনোমতে আছে। কিছু গাছপালা এবং একটি ঘাট বাঁধানো পুকুর ছাড়া অবশিষ্ট আর কিছুই নেই। বামনকাঠি এলাকার রমজান আলী (৭৩) বলেন, ৩০ বছর আগেও দাশের বাড়িতে অধি দাশ ও ভোলা দাশ নামে কবির দুই জ্ঞাতি স্বপরিবার বসবাস করতেন। তখন একটি ডাকাতির ঘটনায় দুই ডাকাত গণপিটুনিতে নিহত হওয়ার পর তাঁরা পুলিশি হয়রানির ভয়ে ঘরবাড়ি বিক্রি করে ভারতে চলে যান। এরপর থেকে ছাড়া ভিটায় পরিণত হয়েছে কবির জন্মস্থান।

এলাকার আরেক প্রবীণ ব্যক্তিত্ব আলী শিকদার বলেন, ‘ঢাকা ও কলকাতা থেকে বহু লোক কবির বাড়ি দেখতে আসেন। কিন্তু তাঁরা শুধু জঙ্গল দেখে ফিরে যান। আমরা বিব্রত হই।’ একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করে এটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানান তিনি।

জীবনানন্দ দাশের জীবন ও সাহিত্য নিয়ে এক যুগের বেশি সময় ধরে গবেষণা করছেন রাজাপুর ডিগ্রি কলেজের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মো. সোহরাব হোসেন। তার দাবি, কবির ‘আবার আসিব ফিরে’ কবিতায় উল্লেখ করা তিনটি নদী ধানসিঁড়ি, রূপসিয়া ও জাঙ্গালিয়ার অবস্থান কবির পৈত্রিক ভিটার কাছেই। তিনি বলেন, বেশ কয়েক বছর ধরে ঘেঁটে জানতে পেরেছি, ফরিদপুরে নদীভাঙনের শিকার হয়ে কবির বাবা ও দুই চাচা ঝালকাঠির বামনকাঠি গ্রামের সেন বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে ছিলেন। এখানেই জীবনানন্দ দাশের জন্ম ও শৈশবের অনেক সময় কেটেছে। কিন্তু তাকে নিয়ে যথাযথ চর্চা ও প্রচার না থাকায় এই এলাকার অনেক মানুষের কাছেই তিনি রয়ে গেছেন বিবর্ণ স্মৃতি হিসাবে। এটা এলাকাবাসীর জন্য লজ্জার।’ তবে বিভিন্ন নথি ঘেঁটে জীবনানন্দ দাশের পৈত্রিক নিবাস তৎকালিন ঢাকার বিক্রমপুর থেকে বরিশালে স্থানান্তরিত হওয়ার তথ্য জানা গেছে। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় ধানসিঁড়ির রূপ-লাবণ্যের কথা উঠে এসেছে। দেশ-বিদেশে পেয়েছে পরিচিতি। সেই নদী এখন মরাখাল। একসময়ের খরস্রোতা ধানসিঁড়ি নাব্য হারিয়ে ও দুইপাশ দখলে সংকুচিত হয়ে গেছে। নদীটি রাজাপুরের বাগড়ি বাজার থেকে সুগন্ধা নদীতে গিয়ে মিশেছে। এ ছাড়া জীবনানন্দ দাশের বাড়ির উত্তরে প্রবাহিত ছিল রূপসিয়া নামে আরেকটি নদী। রাজাপুর বাজার থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দৈঘ্যের যে নদীটি বিষখালী নদীতে মিশেছে, সেটির নাম জাঙ্গালিয়া। এই তিনটি নদীই এখন প্রায় মৃত। তিন দশক আগেও আট কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ধানসিঁড়ি ছিল রাজাপুর উপজেলার সঙ্গে ঝালকাঠির নৌপথে যাতায়াতের একমাত্র সংযোগ সূত্র। এ নদী ধরেই রাজাপুরের লোকজন তখন ঝালকাঠি ও বরিশালে যাতায়াত করতো।

প্রায় আট কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ধানসিড়ি নদীর রাজাপুর অংশের অবস্থা বড়ই করুন। সর্বত্র কচুরিপানা আটকে আছে। ধানসিঁড়ির দুই পারে কয়েকশ হেক্টর উর্বর জমি আছে। কিন্তু নদীটি মরে যাওয়ায় সেচের অভাবে তা এক ফসলি জমিতে পরিণত হয়েছে। এসব জমিতে বর্ষা মৌসুমে আমন ধানের আবাদ করতে পারলেও শীত মৌসুমে পানি না থাকায় বোরোসহ শীতকালীন কোনো ফসলের আবাদ করতে পারছেন না কৃষকেরা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সর্বশেষ ২০১০-১১ অর্থবছরে প্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে ধানসিড়ি নদীর উৎস মুখ থেকে সাড়ে ৭ কিলোমিটার পশ্চিমে খননের একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। ওই সময় নদীর সাড়ে চার কিলোমিটার পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) মাধ্যমে ৮৪ লাখ টাকা ব্যয়ে রাজাপুর অংশের পিংড়ি-বাগড়ি-বাঁশতলার মোহনা পর্যন্তু খনন করা হয়েছিল। নিয়মিত বরাদ্দ না দেওয়ায় পরের সাড়ে তিন কিলোমিটার আর খনন করা হয়নি।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আফরোজা বেগম পারুল বলেন, রূপসী বাংলার কবিকে বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে উদ্যোগ নেওয়া একান্ত প্রয়োজন। পুনরায় ধানসিঁড়ি নদী খননে ও কবি জীবনান্দন দাশের পৈত্রিক স্মৃতি সংরক্ষণে স্থানীয় প্রশাসনের পাশাপাশি জনপ্রতিনিধি ও সুশীল সমাজের সার্বিক সহযোগিতার আহ্বান জানান তিনি।

জেলা প্রশাসক মো. হামিদুল হক জানান, রূপসী বাংলার কবিকে বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তাঁর পৈতৃক ভিটা সংরক্ষণের জন্য সরেজমিন পরিদর্শন করে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে লিখিত আবেদন করা হয়েছে। তিনি জানান, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কবি জীবনানন্দ দাশের জন্ম বার্ষিকী উপলক্ষ্যে ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে ১৮ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৪ টায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে থেকে বর্ণাঢ্য র‌্যালি, গাবখান-ধানসিড়ি-বিষখালী ও সুগন্ধা নদীর মোহনা তীরের প্রস্তাবিত ইকোপার্কে এক মেলা অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে স্কুল, কলেজ শিক্ষার্থীদের জন্য কুইজ প্রতিযোগিতা ও বিকেলে ঘুড়ি উড়ানো উৎসব অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া পরের দিন মঙ্গলবার বিকেলে ঘোড়ার দৌড় প্রতিযোগতা, জীবনানন্দ দাসের জীবন ও কর্মের উপর অতিথিবৃন্দের আলোচনাসভা, বিজয়ীদের পুরস্কার বিতরণ, জীবনানন্দ দাশের কবিতা আবৃতি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close